এক.
:- রাতুল, একটু বুঝতে চেষ্টা কর... মাত্র তো অল্প কয়েকটা দিনের ব্যাপার ।
:- হৃদি, তোমার আন্দাজ পর্যন্ত নেই তুমি কি বলছ ।
valobasar golpo
:- কি এমন বলেছি ? মালিহার সাথে কিছুদিন প্রেমের অভিনয় করবে... এই তো ।
:- কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি । আমি কেন শুধু শুধু মৃত্যু পথযাত্রী ঐ মেয়েটাকে ধোঁকা দেবো ?
:- এখানে ধোঁকার কথা আসছে কেন ? মেয়েটার ক্যান্সার, ডাক্তার ওর সময় বেঁধে দিয়েছে । বড়জোর মাস ছয়েক বাঁচবে আর । তাছাড়া তুমি তো জানই, মেয়েটা সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই তোমাকে মনে মনে ভালবাসে । কখনো প্রকাশ করেনি...এই যাহ ! তোমার কি উচিত না জীবনের শেষ কয়েকটা দিন এই মেয়েটার পাশে একটু দাঁড়ানো ?
:- তুমি কি এসব মালিহার জন্য করছ ? নাকি তোমার নিজের জন্য ?
:- দেখো রাতুল... আমাদেরকে বাস্তববাদী হতে হবে । মালিহার বাবার অনেক টাকা, আর মালিহা তাদের একমাত্র মেয়ে । কিছুদিনের মধ্যে সেও মারা যাচ্ছে । এত টাকা তারা কি করবে ? তুমি যদি এই শেষ সময়টাতে মালিহার পাশে থাকো তবে মালিহার মৃত্যুর পর আঙ্কেল সমস্ত সম্পত্তি তোমার নামে করে দেবে । একটু ভাবো রাতুল, আমরা একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছি । সব হয়ত পূরণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু আমরা যদি আঙ্কেলের টাকাটা পেয়ে যাই তাহলে খুব সহজে আমাদের প্রতিটি স্বপ্ন আমরা সত্যি করতে পারবো ।
:- ছিঃ হৃদি ! তুমি এতটা নীচ জানা ছিল না আগে ।
:- সাধু সেজো না রাতুল । তাছাড়া নীচ হওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন ? আমি তো এসব আমার নিজের জন্য করছি না । আমি যা করছি সব তো আমাদের জন্যই, আমাদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর জন্যই করছি ।
:- তাই বলে এভাবে....
:- রাতুল, মানুষ তার ভালবাসার মানুষের জন্য কত কিছুই না করে, তুমি কি আমার জন্য এটুকু করতে পারবে না ? অল্প কয়েকটা দিন ঐমেয়েটার সাথে অভিনয় করতে পারবে না ? এই তোমার ভালবাসার নমুনা ?
:- ভালবাসার দোহাই দিলে ? ঠিক আছে, তবে তাই হবে । আমি কালই মালিহার সাথে দেখা করবো ।
:- থ্যাঙ্কু রাতুল । আলাভু !
নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রাতুলের । কিন্তু হৃদির আতিশায্যে সেটা সে খেয়াল করল না ।

দুই.
:- কি বললে রাতুল ? তুমি আমাকে ভালবাসো ! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না !
:- বিশ্বাস করো মালিহা, সত্যি বলছি আমি । সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই তোমাকে ভালবাসি ।
:- কচু । তাহলে বলনি কেন ?
:- সাহস হয় নি । যদি ফিরিয়ে দাও...
:- কিন্তু কোন দিন তো ভালবাসার দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে একটু তাকাও ও নি ।
:- ভয় হত আমার, ভীষণ ভয় হত । তোমার চোখের ঐ গভীরতায় আমি খড়কুটোর মত ভেসে যেতাম । তাই তাকাতে ভয় হত ।
:- আর হৃদি ? ওর সাথে এত মাখামাখি কেন তোমার ?
:- আরে হৃদি ? ধুর ! ও তো আমার স্কুল ফ্রেন্ড । আমরা একসাথে খেলেছি, পড়েছি, বড় হয়েছি । ওর সাথে তো একটু ঘনিষ্ঠতা থাকবেই । তবে ও জাস্ট আমার ফ্রেন্ড । এর বেশী কিছু না ।
:- তুমি সত্যিই আমায় ভালবাসো তো রাতুল ?
:- সত্যি বলছি মালিহা । বল, আমি কি করলে তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে ?
ধীর পায়ে রাতুলের দিকে এগিয়ে এল মালিহা । তারপর আলতো করে রাতুলকে জড়িয়ে ধরল ।
:- কিছু করতে হবে না । তুমি মুখে বলেছ, এটাই যথেষ্ট । আই লাভ ইউ, রাতুল ।
:- লাভ ইউ টু, মালিহা ।
বলার সময় রাতুলের কন্ঠটা একটু কেঁপে উঠল । কিন্তু আনন্দের আতিশায্যে মালিহা সেটা খেয়াল করল না ।

তিন.
ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটা কক্ষ । অসংখ্য যন্ত্রপাতিতে ঠাসা কিন্তু ছিমছাম । কেবিনে একটাই বেড । মালিহা তাতে শুয়ে, পাশে বসা রাতুল । মালিহার শীর্ণ একটি হাত রাতুলের হাতে বন্দি ।
:- রাতুল...
:- হু ।
:- আমি মরে গেলে তুমি আমাকে ভুলে যাবে । তাই না ?
:- চুপ করো তো ।
:- আমাকে তুমি ভুলে যেও রাতুল । টুকটুকে লক্ষী একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করো, যে তোমাকে অনেক ভালবাসবে ।
:- তুমি থামবে ?
:- জানো রাতুল, আমার না একটুও মরতে ইচ্ছে করছে না । তোমার সাথে অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে ।
:- কিচ্ছু হবে না তোমার । আমি তোমার সাথে আছি ।
:- সত্যি বলছ ?
:- হ্যা সত্যি বলছি । আমরা একসাথে অনেক বছর বাঁচব ।
:- জানো রাতুল, আমার না একটা স্বপ্ন আছে ! আমাদের যখন বিয়ে হবে তখন আমাদের এত্তগুলা বাচ্চা হবে । ৬ টা ! তারা সারাদিন আমাদের ড্রয়িং রুমটা মাতিয়ে রাখবে । আমরা অনেক অনেক ভালবাসা দিয়ে তাদের বড় করবো । তাই না রাতুল ?
:- হ্যা তাই । তোমার প্রতিটি স্বপ্ন আমি পূরণ করবো । তোমার কিচ্ছু হবে না । আমি তোমার কিচ্ছু হতে দেবো না । আমার সমস্ত ভালবাসা দিয়ে আমি তোমাকে আগলে রাখবো । তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না ।
:- সত্যি বলছ ?
:- হ্যা সত্যি বলছি । এখন বেশী কথা বলো না । লক্ষী মেয়ের মত ঘুমাও ।
মালিহার মাথাটা রাতুল নিজের কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরল । মালিহাও আর কথা বাড়াল না । লক্ষী মেয়ের মত রাতুলের কোলে চুপটি করে শুয়ে থাকল ।
রাতুল এরই ফাঁকে অন্য একটা জিনিস লক্ষ করল । এ পর্যন্ত সে যতবার মালিহাকে ভালবাসি বলেছে, যতবার মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছে- প্রত্যেকবারই তার গলা একটু হলেও কেঁপে উঠেছে । কিন্তু এই প্রথম বারের মত তার গলা কাঁপে নি ।

চার.
:- বাবা রাতুল...
:- জি আঙ্কেল ?
:- মালিহা ছিল আমাদের একমাত্র মেয়ে । আজ সে নেই, কিছুদিন পর আমরা বুড়ো-বুড়িও চলে যাবো । আমার এত প্রপার্টি... কি হবে এসবের ? তাই আমি চাইছিলাম তুমি এর দায়ভার গ্রহণ করো ।
:- না আঙ্কেল । আমি এটা পারবো না ।
:- দেখো বাবা, আমাদের কোন ভবিষ্যত নেই । এক মেয়ের সাথে সাথে আমাদের সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু তোমার সামনে পুরো জীবন পড়ে রয়েছে । তুমি হচ্ছ সেই ছেলে যাকে এই পৃথিবীতে মালিহা সবচেয়ে বেশী ভালবাসত । তুমি তো আমার ছেলের মতই । আমার মেয়েটা যদি আজ বেঁচে থাকত তাহলে তোমার সাথেই তো তার বিয়ে হত । মালিহাই বলেছিল, তার মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি যাতে তোমার নামে উইল করে দিই ।
:- কিন্তু আঙ্কেল, আমি....
:- তুমি আর আপত্তি করো না বাবা । ধরে নাও, এটাই আমার মালিহার শেষ ইচ্ছে ছিল । আমি উকিল সাহেবকে বলে দিয়েছি । তিনি তোমাকে পাওয়ার অব অ্যান্টর্নির সব কাগজ পত্র বুঝিয়ে দেবেন ।
কাঁপা কাঁপা হাতে রাতুল উইলের কাগজ নিল ।
তার চোখে দুফোঁটা অশ্রু দেখা গেল ।
নাহ ! এ অশ্রু আনন্দের অশ্রু না । এ অশ্রু অভিষ্ট লক্ষ অর্জনের অশ্রু না ।
এ অশ্রু গভীর হতাশার । এ অশ্রু তীব্র কষ্টের.....

পাঁচ.
:- আই লাভিউ... লাভিউ... লাভিউ... রাতুল....!
হৃদি দৌড়ে এসে রাতুলকে ঝাপটে ধরল । কিন্তু রাতুল নিশ্চুপ, নিথর ।
:- কি ব্যাপার ? কোন সমস্যা ?
:- নাহ ।
:- তাহলে মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মত করে রেখছ কেন ?
:- এমনি ।
:- আচ্ছা বাদ দাও । আমাদের উদ্দেশ্য তো সফল । এখন বল বিয়েটা কবে হচ্ছে ?
:- হচ্ছে না ।
:- মানে ?
:- মানে খুব সহজ । আমি তোমাকে বিয়ে করছি না ।
:- রাতুল, জোক করো না । আমি কিন্তু সিরিয়াস ।
:- আমি তো সিরিয়াসলিই বলছি ! আমি তোমাকে বিয়ে করছি না ।
:- বাহ ! সম্পত্তি পাওয়ার আগে আমাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না । আর সম্পত্তি হাতে আসতেই আমাকে ভুলে গেলে ?
:- ধরে নাও.... তাই ।
:- রাতুল, ইউ ক্যান্ট ডু দিস টু মি ।
:- আই ক্যান ।
:- আমাকে তুমি ভালবাসো । আমার সাথে এমনটা করতে পারো না তুমি !
:- হৃদি, আমি তোমাকে ভালবাসি না । তোমার প্রতি আমার যে আকর্ষণটা ছিল সেটা হচ্ছে মোহ । মালিহার নিষ্পাপ ভালবাসার সংস্পর্শে এসে আমার সে মোহ কেটে গেছে । বেটার হবে, যদি আমাকে তুমি ভুলে যাও ।
:- একটা কথা শুনে রাখ রাতুল । এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম কিন্তু ভাল হবে না । আমি মালিহার আব্বুকে সব বলে দেবো । বলে দেবো যে তুমি সম্পত্তির লোভেই মালিহার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছ । তখন তিনি তোমার পাওয়ার অব অ্যান্টর্নি ক্যান্সেল করে দেবেন ।
রাতুল কিছুক্ষণ হৃদির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল । তারপর সে হো হো করে হেসে উঠল । হাসতে হাসতেই বলল- তা তুমি করতেই পারো । তবে আমার মনে হয়না তিনি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন । কারণ, গত ছয়টি মাস তিনি মালিহার বেডের কাছে আমাকেই পড়ে থাকতে দেখেছেন, তোমাকে নয় !

মুখে হাসির রেশটি ধরে রেখে রাতুল ধীর পায়ে হৃদির দিকে এগিয়ে গেল । কন্ঠে যথাসম্ভব মমতা ফুটিয়ে বলল- হৃদি, তুমি যদি ভেবে থাকো আমি সম্পত্তির জন্য তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, তবে তোমার ধারণা ভুল । প্রশ্নটা এখানে ভালবাসার, সম্পত্তির নয় !
হৃদির অনুসন্ধানী দৃষ্টির সামনে রাতুল বলে চলল- জানো হৃদি, মালিহা বাচ্চাদের ভীষণ পছন্দ করত । তাদের জন্য সবসময়ই কিছু করতে চাইত । আমার সাথে তো পুরো হাফ ডজন বাচ্চা নেয়ার প্রোগ্রাম বানিয়েছিল সে ! আমি ওকে ভালবাসি । মৃত্যুশয্যায় ওকে কথা দিয়েছিলাম, ওর সব স্বপ্ন আমি পূরণ করবো । তবে ওর এই স্বপ্নটা আমি কিভাবে অপূর্ণ রাখি বল ? এজন্য ওর স্বপ্ন পূরণের চমত্‍কার একটি ব্যবস্থা করেছি । কি করেছি জানতে চাও ?
:- কি ?
:- "অনির্বাণ" একটি বেসরকারি সামাজিক সংস্থা । এটি পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে । তাদের থাকার ব্যবস্থা করে, শিক্ষার ব্যবস্থা করে, জীবিকার ব্যবস্থা করে । মালিহাদের বর্তমান বাড়িটা ছাড়া আঙ্কেলের কাছ থেকে প্রাপ্ত পুরো সম্পত্তিটা আমি অনির্বাণের ডোনেশান ফান্ডে জমা করে দিয়েছি ।
:- রাতুল....!
:- হুম হৃদি । মালিহার জন্য তো আমি কিছু করতে পারি নি । তবে ওর স্বপ্ন পূরণের জন্য এই কাজটা করার সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনি । আঙ্কেলের সামনেই আমি কাজটা করেছি । তারও পূর্ণ সমর্থন ছিল এতে । চাইলে তুমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো ।
:- রাতুল....
:- হুম । আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, ব্যাপারটা এখানে ভালবাসার, সম্পত্তির নয় । তবে একটা থ্যাংকস্ তো তুমি পেতেই পারো । তোমার জন্যই তো মালিহার কাছে গিয়েছিলাম । পেয়েছিলাম প্রকৃত ভালবাসার আস্বাদ ।
:- রাতুল আমি....
:- একটা কথা বলব হৃদি ?
:- হুম বল ।
:- ভালবাসা এক অদ্ভুত সম্পর্কের নাম । এটি কখন, কবে, কোথায়, কিভাবে, কার সাথে হয়ে যায়- এটা বোধহয় স্বয়ং স্রষ্ট্রাও জানে না । তাই ভালবাসাকে কখনো চ্যালেন্জ্ঞ করতে নেই । তাহলেই হারতে হয়, হারাতে হয় ।
রাতুল চলে গেল ।
হৃদি একবার পেছন থেকে ডেকে থামানোর চেষ্টা করেছিল ।
কিন্তু রাতুল শোনে নি । রাতুল থামে নি ।
রাতুলরা কখনো থামে না । তারা চলে যায় ।

শেষ.

ড্রয়িং রুমের মেঝেতে রাতুল শুয়ে আছে । তার চারপাশে ছয়টা বাচ্চা, বিভিন্ন বয়সী । তাদের কিচিরমিচিরে পুরো ঘর যেন ছোট্ট এক পাঠশালায় রূপ নিয়েছে ।
রাতুলই ওদের তুলে এনেছে বিভিন্ন অরপানেজ থেকে । এখন রাতুলই ওদের বাবা, রাতুলই ওদের মা । রাতুলের ভালবাসায়ই ওরা বড় হচ্ছে স্বর্গীয় এই ভালবাসার উদ্যানে ।
মালিহা নেই তো কি হয়েছে ?
তার স্বপ্ন তো আছে, তার স্মৃতি তো আছে ।
একটাই তো জীবন মাত্র ।
কাটিয়ে দিতে আর কি লাগে ??
 
Top