বন্ধুদের আড্ডার ঠিক মাঝ পর্বে এসে মন এবং মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে গেল তন্ময়ের। কিছুক্ষন আগে সৌমেনের সাথে বেশ একটা বাজে ঝগড়াও হয়ে গেছে। যদিও সবার হস্তক্ষেপে সেটা মিটমাট হলেও রাগটা দুজনের মধ্যেই আছে বুঝা যাচ্ছে। এই আড্ডায় থাকার আর একবিন্দুও ইচ্ছা নাই তার। কিন্তু হুট করে উঠে চলে আসাও যাচ্ছে না। রাখি ভাবী মানে সজলের বউ খুব রাগ করবে। আজ অনেক আয়োজন করেছেন উনি। চাকরী আর সংসারের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে ভার্সিটি আর কলেজ জীবনের খুব কাছের কিছু বন্ধুর সাথে মাঝে মাঝে এমন একটা আড্ডার আয়োজন করে তন্ময়রা। সপ্তাহে একটা দিন ঠিক করে সবার কাছে জানিয়ে দেয়া হয়। জায়গা ঠিক হয় কারো না কারো বাসা। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবার বাসাতেই আড্ডার আসর বসে। বন্ধুদের মাঝে বেশির ভাগ বিবাহিত। কাজেই যার বাসায় আড্ডা বসে তার দায়িত্ব থাকে নাস্তা-পানির আয়োজন করার। অধিকাংশ সময়ে আড্ডা চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। রাতের খাবার আয়োজন থাকে তাই প্রায় সময়।

কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা তন্ময়। তখনি শিলার ফোন। ফোনটা ধরেই খিটমিটে গলায় বললো, 'হ্যালো'
ওপাশ থেকে কিছু কথা শোনার পর ছোট্ট করে কিন্তু বেশ জোড়েই বললো, 'আচ্ছা আমি এখুনি আসছি'. জোড়ে বলার উদ্দেশ্য সবাই যাতে শুনতে পায় আর বুঝতে পারে যে বাসা থেকে জরুরী ফোন এসেছে বলে ওকে চলে যেতে হচ্ছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে ওর উদ্দেশ্য সফল। রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, কিরে? কোন সমস্যা??
-হ্যাঁ দোস্ত। শিলা ফোন করে বললো, মা-র শরীর নাকি বেশী ভালো না। বাসায় যাওয়া দরকার।
ওর বন্ধু মহলের সবাই জানে ওর মা বেশ কিছুদিন থেকেই হার্টের অসুখে ভুগছেন। কাজেই কেউ আর তেমন একটা অবাক হলনা। রুমি বললো, 'বাসায় চলে যা তাড়াতাড়ি। আর কোন সমস্যা হলে জানাস।
এই কথাটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলো তন্ময়। 'আচ্ছা যাই তাহলে'- বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।

রাস্তায় এসে বেশ জোরে একটা দম নিয়ে নিজেকে হালকা করে সিগেরেট ধরালো তন্ময়। নিজের এই ছোট খাটো অভিনয়ে সে নিজেই মুগ্ধ। বন্ধুদের আড্ডা থেকে বের হবার জন্য এই মিথ্যা কথাটুকু বলা তার খুব দরকার ছিল। আসল ঘটনা হল ফোন তার বউ শিলা করেছিল এবং তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছিল এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু মায়ের অসুখের কথাটুকু বাড়িয়ে বলে আড্ডা থেকে সে নিজেই বের হয়ে এসেছে। এখন হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। কি করা যায় ভাবছে সে। রাত মাত্র তার কিশোর বয়সে পা রেখেছে। ঘড়িতে ৮টা বাজে। যদিও শিলা তাড়াতাড়ি ফেরার কারণ হিসাবে মায়ের ওষুধ নিয়ে আসার কথা বলেছে তবুও তন্ময়ের এখুনি বাসায় যেতে মন চাচ্ছে না। বাসায় গেলেই তো আবার সেই অভিনয়ের পালা শুরু হবে। সুখী থাকার অভিনয়। ভালো থাকার অভিনয়। গত ১টা বছরের কিছু বেশি সময় সে এই অভিনয়ই তো করে আসছে। মায়ের পছন্দে শিলাকে বিয়ে করার কিছুদিন পর থেকে এই কষ্টটার শুরু। যদিও গায়ের রঙ কালো আর চেহারাটা খুব সাধারণ ছাড়া শিলার বাকি সব কিছুই অসাধারণ। তার মাকে শিলা ঠিক নিজের মায়ের মত যত্ন করে। বাসার সবকিছু একহাতে সামলানোর পরেও তার মুখে হাসি লেগেই থাকে। এমনকি সিগারেটের ধোয়ায় বেডরুম অন্ধকার করে রাখলেও ও কিছু বলে না। ওর হাতের রান্নাও ভালো। যদিও প্রায় প্রতিদিনই খেতে বসে রান্না খারাপ হয়েছে বলে শিলাকে বাজে কথা বলে সে। কোনোদিন ঝাল বেশি হয়েছে বলে তো কোনদিন লবন বেশি। বেচারি প্রথম প্রথম মন খারাপ করে কাঁদত। ইদানিং কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকে। তন্ময়ের মনে হয় এই শিলার জন্যই ওর জীবনটা এমন কষ্টের। আজকেও ঠিক এই কারণেই বন্ধুদের আড্ডা থেকে উঠে চলে আসা। ব্যাপারটা আসলে সম্পূর্ণ তার নিজের মানসিক সমস্যা এটা জানে তন্ময়। তবুও সে মানতে পারেনা। ঘটনা আসলে খুব সামান্য। বাসার উদ্দশ্যে রিকশায় বসে আরেকটা সিগারেটে টান দিতেই আড্ডার কথাটা মনে পরে তার।

আজকের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল বউ নিয়ে। কার বউ কত সুন্দর, কে কত গুনবতী এইসব। তবে রাখি ভাবীকে আজকে হিসাবের মধ্যে আনা হয়নি কারণ আজকে উনার বাসাতে আড্ডা। এই বউ সম্পর্কিত ব্যাপারটা এলেই তন্ময় চুপসে যায়। সে কোন কথা বলে না। চুপকরে অন্যদের কথা শোনে। আজও সে চুপ করেই ছিল। শিলার ব্যাপারে তার একধরনের হীনমন্যতা আছে। তার বন্ধুর সবার বউ-ই বেশ সুন্দরী। বিশেষকরে সৌমেনের বউ এর প্রশংসা ওর বন্ধু মহলে সব থেকে বেশি। গীতি ভাবী খুব সুন্দর। যাকে বলে সেই রকম সুন্দর। ৫ মাস আগের বিয়ে করা বউ নিয়ে সৌমেনের গর্বটা খালি চোখেই বেশ বোঝা যায়। শিলার কথা ভুলেও কেউ ওদের আড্ডায় উচ্চারণ করে না। সবাই জানে শিলা বেশ কালো এবং তন্ময় এই ব্যাপারে কথা বললে রাগ করে এটাও সবাই জানে। তবুও আজ সৌমেন তন্ময়কে খোঁচাটা দিয়েই দিল। সৌমেন বেশি কিছু বলেনি। সে শুধু বলেছে, সবার কপাল কি কালি দিয়ে মাখা থাকে নাকি? কি বলিস তন্ময়? এই কথার পরেই সেই বিশ্রি ঝগড়াটা শুরু হল। বাজে কথা যা বলার বেশি তন্ময়ই বলেছে। সৌমেন চুপ করেই ছিল। এখন তন্ময়ের বেশ খারাপ লাগছে। কালকেই সৌমেনের বাসায় যেয়ে ক্ষমা চাইবার সিদ্ধান্ত নিলো তন্ময়।

বাসায় ঢুকে তন্ময় দেখে শিলা তার মায়ের মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে। আজকের যুগে এই দৃশ্য খুবই বিরল। তবুও এই চমৎকার ঘরোয়া শান্তির ছবি ওর কাছে কোন আবেদন বহন করে না। খাবার টেবিলে মেজাজ খারাপের প্রভাব আরো ভালোভাবেই পরে। খাবার মুখে দিয়েই তন্ময় চিৎকার করে ওঠে, 'এটা কি রান্না করেছো? এই খাবার কুত্তাও মুখে দেবে না।
আজ অনেকদিন পরে শিলা বাথরুমে শাওয়ার ছেড়ে মনের সুখে কাঁদল। গায়ের রঙ এর জন্য ওর কষ্ট কোনদিন যাবেনা।

পরের দিন তন্ময় অফিস শেষ করেই গেল সৌমেনদের বাসায়। কলিং বেল দেবার কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দিলেন সৌমেনের বাবা। তন্ময় অবাক হয়ে দেখলো বুড়ো মানুষটা দরজা খুলতে হেঁটে আসার কষ্টে হাঁপাচ্ছে। তার চোখ লাল হয়ে গেছে। তন্ময় উনাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিতেই কানে এল সৌমেন আর গীতি ভাবীর উত্তেজিত কন্ঠ।

গীতি ভাবী চিৎকার করছে, 'আমি তোমাকে বিয়ের রাত থেকেই বলেছি ওই বুড়োটাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসো। আমি ওকে টানতে পারবো না। তুমি শোননি।
- উফফ আস্তে বল। বাবা শুনবে।
- আস্তে বলবো মানে? শোনার জন্যই তো বলছি। ঐ বুড়ার জন্য আমি আমার জীবন নষ্ট করতে পারবো না।

তন্ময় প্রচন্ড অবাক হয়ে ভাবছে চেহারা সুন্দর হলেই কি মানুষ এমন বাজে মানসিকতার হয়? আড়চোখে সৌমেনের বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো মানুষটার দু গাল বেয়ে প্রচন্ড কষ্টের জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখে মুখে চরম অসহায়ত্ব। তন্ময় আর থাকতে পারলো না।

সেদিন রাতের খাবার টেবিল। শিলা সাধারণত তন্ময়ের খাওয়া শেষ হলে খায়। তন্ময় শেষ কবে ওকে একসাথে খেতে বলেছিল ও মনে করতে পারেনা। কিন্তু আজ তাকে তন্ময়ের অনুরোধে একসাথে খেতে বসতে হয়েছে। মনে মনে সে প্রস্তুত হয়েই আছে একটা ঝাড়ি খাওয়ার।

তন্ময় খাবার মুখে দিয়ে শিলার দিকে তাকালো।
- কাল তো ছুটির দিন। সকালে তোমার ঐ স্পেশাল ঝোল ঝোল সব্জি খিচুড়িটা রান্না কর না। অনেকদিন খাইনা।
প্রচন্ড অবাক হয়ে শিলা তন্ময়ের চোখের দিকে তাকালো। তন্ময়ের চোখের দৃষ্টি খুব অদ্ভুত। ভালোবাসা আর অনুতাপ মিলে মিশে গেলে দৃষ্টিটা একটু অদ্ভুতই হয়।
 
Top