চড়কি যত জোরেই ঘোরানো হোক না কেনো কেউ যদি তাতে বসে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে আর কিছুই মনে হবে না তার। জানা কথা। তবুও টিকিট কেটে তাতে চড়া তো হয় তেমন কিছু অনুভূতির জন্যই! তারস্বরে চেঁচিয়ে বেশ মজা পাই ঘোরার সময়। এবারের বাণিজ্য মেলাতে গিয়ে দেখি চড়কি
বসেছে। আট বন্ধু গেছি একসাথে। একসাথেই চড়লাম দুটো দলে ভাগ হয়ে। বিকেলের পড়ন্ত রোদের মিষ্টি আলোতে এমন অনুভূতিটার মজাই আলাদা। চিৎকার করে লোক জড়ো করার ইচ্ছা। ফাজলামীটা ভালোই জমবে মনে হচ্ছে। সব বন্ধু একসাথে থাকার মূহুর্তগুলো আসলেই অসাধারণ। চড়কি ঘোরা শুরু হতে
আমাদেরও চিৎকার শুরু হলো। প্রচন্ড গতিতে যখন শুরু হলো ঘোরা, তখনই চোখ পড়লো একটু দূরে দাঁড়িয়ে হতভম্ব চোখে আমাদের দিকে চেয়ে থাকা কালো জামা পড়া এক মেয়ের দিকে। অনুভূতিকে অনুভব করতে চাওয়া মনে অন্য অনুভূতি তৎক্ষনাৎ এমন করে গ্রাস করলো যে মাথা নীচু হয়ে গেলো নিজেই। দু’বছর আগের স্মৃতিরা টাটকা হয়ে ভুলিয়ে দিলো সব।
এইচ.এস.সি. পরিক্ষা শেষে ছোটখালার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসার সিদ্ধান্তটা এবার পাকাই হয়ে গেলো। ঢাকায় তেমন যাওয়া হয়না কিন্তু ছোটখালা কতোদিন থেকে ডেকেই যাচ্ছে আমাকে। ছোট থেকে মানুষ করে দূরে স্বামীর সংসারে চলে গেছে ঠিকই। তবে এখনো আমার জন্য মন যে কাঁদে তা ছোটখালার প্রতিটা কথাতেই আনুভব করি আমি। যতই রাগ দেখাই এভাবে দূরে যাওয়ার জন্য সামনে গেলে তার চেয়ে বেশী নরম হয়ে যাই আমি। তখন কেঁদে ফেলি। এতো বড় হয়েও কাঁদার ভয়েই শুধু ছোটখালার সামনে আর যেতে চাইনা। তবুও মনটা ছটফট করছিলো একবার দেখার জন্য তাই মাকে বলে এবার একাই ঢাকা যাওয়া।
দু’দিন থেকে ফেরার কথা। পারলে ফিরব আগেই। সামনে যে আবার নওশীনের জন্মদিন! ওকে নিয়ে হাজারটা প্লান আছে যেগুলো ঢাকায় বসে থাকলে আর করা হবেনা। তাই ছোটখালাকে যে করেই হোক রাজি করিয়ে দুদিনের মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে।
এবার প্রথম নয় একা যাওয়া তাছাড়া বড় হয়েছি তো! তবুও আব্বু-আম্মু একেবারে গাড়ির সিট অবধি আমার সাথে আসলো। কতো উপদেশ ধারণ করি এই মাথাতে? তা না বুঝে চলতে লাগলো একের পর এক উপদেশ বাণীর বিরামহীন বর্ষণ। আমি জানালার পাশের সিটে। বাসের দরজা দিয়ে উঠে হাতের ডানে দ্বিতীয় সারিতে। ব্যাকপ্যাক, ল্যাপটপ আর পানির বোতল গুছিয়ে নওশীনকে ম্যাসেজ দিয়ে জানালাম রওনা হচ্ছি। বাস ছাড়লো আর ছাড়ার খানিক পরেই ফিরতি ম্যাসেজে পেলাম যাতে অনেক আদরমাখা ভালোবাসার কিছু কথার সাথে আরো কিছু উপদেশ! যাত্রা শুরু হলো ঢাকার পথে, রাজধানীর পথে। আমার পাশে সাতাশ-আটাশ বছর বয়সী এক যুবক। বেশ হ্যান্ডসাম। পরিচয় পেলাম খানিকপরে। আর্মিতে ক্যাপ্টেন। নাম ইফতি। রংপুরে এসেছিলেন বিয়ের পাত্রী দেখতে। পাত্রী তার ফুফাতো বোন। পরিবারের আর সবাই রংপুরেই রয়েছেন আর তিনি ব্যক্তিগত কাজ সারতে যাচ্ছেন ঢাকাতে। ওখানে ওনারা স্থায়ী বাসিন্দা। কাজ সেরে কয়েকদিনের মাঝে আবার ফিরবেন রংপুরে। তখন এনগেজমেন্ট হবে দুজনের। শুনে বেশ ভালো লাগলো। এ বিষয়ে কথা বাড়ালামনা আর। ফুড ভিলেজে এক সাথে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। সেখানে পৌঁছে একসাথেই খেলাম। দেখলাম বেশ দামী একটি ফোন ইউজ করেন তিনি। তার খাওয়া হয়ে গেলেও আমার খাওয়া তখনো খানিক বাকি। তিনি ফোনটা টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে গেলেন। এরই মাঝে দেখি কল এসেছে ফোনে। একেবারেই সামনে ফোনটি বাজছিলো আর আশে পাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্বেও হাতে নিলাম ফোনটা সাইলেন্ট করবো বলে। খেয়াল হলোনা প্রথমে, পরে দেখেই চমকে গেলাম। হাতের খাবার ছিটকে পরলো কাপড়ে। সেদিকে খেয়াল নেই আমার। স্ক্রীনে যে নাম্বার ভাসছে আলো জ্বালিয়ে তা যে নওশীনের নাম্বার! নামটি সেভ করা জান লেখা দিয়ে! কিছু না বলে কেবল সাইলেন্ট করে ফোনটা রাখলাম। তখনি উনি এলেন। কলের কথা বলতেই উনি বললেন অসুবিধা নেই। আমি উঠলাম ফ্রেশ হতে। কান্না পাচ্ছিলো এতোটাই যে কোথায় পা ফেলছি তাও জানিনা। সবকিছু অবাস্তব লাগছিলো। হয়তো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি ভেবে পানি ছিটালাম মুখে। না ভাংলোনা এই দুঃস্বপ্ন। তখন আমি কেবল এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে বেঁচে আছি আর কিছু না।
বাকী পথ একদম চুপ হয়ে পাড়ি দিলাম। সেই ছেলেটিও কিছুই বললোনা আর। ঢাকায় নেমে ফোন দিলাম ছোটখালাকে।
‘আমি ঢাকায় পৌঁছেছি খালা।‘
‘ভালো করেছিস। এখন তুই থাম ওখানেই। গাড়ি পাঠিয়েছি, এখুনি পৌঁছে যাবে।‘
‘না খালা আমি বাসায় ফিরে যাবো। টিকিটও কেটে ফেলেছি। এখুনি গাড়ি ছাড়বে।‘
‘এই কি পাগলামী শুরু করেছিস তুই?’ মাইর খাবি। ফাজলামী হচ্ছে তাই না‘
‘না খালামনি। আমি ফিরতি গাড়িতে চড়ছি। আবার আসবো।‘
নিরব নামের বারবার উচ্চারণ বাজছিলো কানে। খালাকে আর কিছু বলার সাহস পেলামনা। কল কেটে ফোনটা অফ করলাম। জার্নির সময় বেশী কথা বললে আমার খারাপ লাগে, মাথা ঘোরে। সবাই জানে বলে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেনা। নওশীনও সেটা জানে বলে কল দেয়নি। সেই ম্যাসেজের পর আর কোনো ম্যাসেজও পাইনি। কিন্তু আমার প্রশ্নগুলো আর এই ছোট বিষয়কে ঘিরে নেই। ফোনে উত্তর পেলেও বুঝবনা হয়তো কিছুই। তাই যত দ্রুত সম্ভব ওকে সামনে চাইছি। এসবের অর্থ জানাটা এখন বেঁচে থাকার চেয়ে বেশী জরূরী আমার জন্য।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেলো। একদম বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে ফোন খুললাম। প্রায় একশো ম্যাসেজে ভাসছে ইনবক্স। এনার্জি কুলালোনা দেখবার। আবার ফোন এলো। খালামনির ফোন। ধরলাম কলটা। অনেক কান্নার পরে কান্নাটা শব্দ হারিয়ে ফেলে। অমন করে কাঁদতে কাঁদতে খালামনি চিৎকার করতে লাগলেন আমি কোথায় আছি কি করছি এই বলে। জানালাম বাসায় পৌঁছে গেছি আর এখন একদম দরজার সামনে। আর কিছু বলার ভাষা নেই। হারিয়ে ফেলেছি দুপুরে ফুড ভিলেজের ওই ঘটনার পর থেকে।
বাসায় ঢুকতেই আব্বু-আম্মু ছুটে এলেন। তাদের কোনো কথা কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছিলোনা। আমার চোখে-কানে-বুকে তখন নওশীন ছাড়া আর কিছু নেই।
পরদিন দেখা হলো নওশীনের সাথে। কিছুই জানাইনি ওকে আগে। কেবল ফোন দিয়ে যখন ডাকলাম সকালে তখন ভীষণ অবাক ও। রাতে ফোন ধরিনি বলে খানিক রাগ হলো। বলে দিলাম যে মাথা ব্যাথা ছিলো তাই বন্ধ করে রেখেছি। কিছু বললোনা আর।
কফি হাউজের চেনা কেবিনের একপাশেই বসলাম দুজন। কথাগুলো এমনই ছিলো ওর সাথে আমার।
‘নওশীন তুমি কিছু লুকাচ্ছো আমার কাছে?’
‘কি লুকাবো? নিরব, তোমার কাছে কি লুকাতে পারি আমি?’
দীর্ঘশ্বাস আরো গাড় হলো আমার। কি বলবো ওকে আমি? কান্না ঠেকাতে পারলাম না। একদিকে এতো বড় গোপন সত্য অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষের এই মিথ্যে ছলনা! জীবনের মানে বলতে কিছু বাকি রইলো কি আর?
‘তোমার মামাতো ভাই ইফতি তাই না? দোয়া করি তোমরা অনেক সুখে থাকবে।‘
নওশীনের মুখের দিকে তাকালাম না। তাকালে যে মড়ার মতো ফ্যাকাশে একটা মুখই দেখতে পেতাম জানি। মাথা নিচু করেই বললাম, ‘তুমি কি আরেকবার ভাববে সবকিছু? থাকবে আমার সাথে? প্লীজ? কি করে এতোকিছু হলো কিছুই জানত চাইবোনা আমি। কিছুই মনে রাখবোনা তোমার এই না বলা সত্যকে। তবুও আমার সাথে থাকবে কি প্লীজ?’
ওর মুখে কথা নেই। খানিক পরে বিখ্যাত সেই দীর্ঘস্বাস ফেললো ও। যে শব্দটা আমার বুকটা একদম ছাড়খার করে দেয় প্রতিবার।
‘আমাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিক হয়েছে। এটা আটকানোর সাধ্য আমার নেই। হয়তো নিজেই জেনেছো কোনোভাবে। তবে আমি আমিই জানাতাম তোমাকে। তোমার ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করবার সাধ্য আমার ছিলোনা। তাই তোমার বুকে মাথা রেখেছি। আর সারাজীবন তোমাকেই ভালোবাসবো। কিন্তু আমার পরিবারকেও আমি অবজ্ঞা করতে পারতামনা, আর পারবোওনা।‘
কি শুনছিলাম জানিনা। কেবল মনে হচ্ছিলো রাত নেমেছে সকালের আলোতে। কি বলবো আর ওকে? গালি দেবো? ভালোবাসার মানুষকে কি তা দেয়া যায়? জোর করবো? তাতেও তো বাঁধা এই ভালোবাসাই। তারচেয়ে বরং চুপ থাকাই ভালো। যে নিজের পথকে নিজের মতো করে বেছে নিয়েছে তাকে হাজার বাক্যেও আমার পথে ফেরাবার সাধ্য আমার নেই। প্রতিবারের মতো এবারও ওকে রিকশায় তুলে দিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলাম রিকশাওয়ালার হাতে। ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো হয়তো কিছু শোনার আশায়। আমি নির্বাক। সেবারই শেষ দেখেছিলাম ওকে দু’বছর আগে। নির্বাক বাঁধাতে তার মন আটকেনি আমার কাছে। সবাক বাঁধা কি পারতো ওকে থামাতে? দানা বাঁধা প্রশ্নরা এতোদিন পর ফের উঁকি দিলো ওপরে-নীচে ঘুরতে থাকা দেহ-মনে।
বসেছে। আট বন্ধু গেছি একসাথে। একসাথেই চড়লাম দুটো দলে ভাগ হয়ে। বিকেলের পড়ন্ত রোদের মিষ্টি আলোতে এমন অনুভূতিটার মজাই আলাদা। চিৎকার করে লোক জড়ো করার ইচ্ছা। ফাজলামীটা ভালোই জমবে মনে হচ্ছে। সব বন্ধু একসাথে থাকার মূহুর্তগুলো আসলেই অসাধারণ। চড়কি ঘোরা শুরু হতে
আমাদেরও চিৎকার শুরু হলো। প্রচন্ড গতিতে যখন শুরু হলো ঘোরা, তখনই চোখ পড়লো একটু দূরে দাঁড়িয়ে হতভম্ব চোখে আমাদের দিকে চেয়ে থাকা কালো জামা পড়া এক মেয়ের দিকে। অনুভূতিকে অনুভব করতে চাওয়া মনে অন্য অনুভূতি তৎক্ষনাৎ এমন করে গ্রাস করলো যে মাথা নীচু হয়ে গেলো নিজেই। দু’বছর আগের স্মৃতিরা টাটকা হয়ে ভুলিয়ে দিলো সব।
এইচ.এস.সি. পরিক্ষা শেষে ছোটখালার বাসা থেকে বেড়িয়ে আসার সিদ্ধান্তটা এবার পাকাই হয়ে গেলো। ঢাকায় তেমন যাওয়া হয়না কিন্তু ছোটখালা কতোদিন থেকে ডেকেই যাচ্ছে আমাকে। ছোট থেকে মানুষ করে দূরে স্বামীর সংসারে চলে গেছে ঠিকই। তবে এখনো আমার জন্য মন যে কাঁদে তা ছোটখালার প্রতিটা কথাতেই আনুভব করি আমি। যতই রাগ দেখাই এভাবে দূরে যাওয়ার জন্য সামনে গেলে তার চেয়ে বেশী নরম হয়ে যাই আমি। তখন কেঁদে ফেলি। এতো বড় হয়েও কাঁদার ভয়েই শুধু ছোটখালার সামনে আর যেতে চাইনা। তবুও মনটা ছটফট করছিলো একবার দেখার জন্য তাই মাকে বলে এবার একাই ঢাকা যাওয়া।
দু’দিন থেকে ফেরার কথা। পারলে ফিরব আগেই। সামনে যে আবার নওশীনের জন্মদিন! ওকে নিয়ে হাজারটা প্লান আছে যেগুলো ঢাকায় বসে থাকলে আর করা হবেনা। তাই ছোটখালাকে যে করেই হোক রাজি করিয়ে দুদিনের মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে।
এবার প্রথম নয় একা যাওয়া তাছাড়া বড় হয়েছি তো! তবুও আব্বু-আম্মু একেবারে গাড়ির সিট অবধি আমার সাথে আসলো। কতো উপদেশ ধারণ করি এই মাথাতে? তা না বুঝে চলতে লাগলো একের পর এক উপদেশ বাণীর বিরামহীন বর্ষণ। আমি জানালার পাশের সিটে। বাসের দরজা দিয়ে উঠে হাতের ডানে দ্বিতীয় সারিতে। ব্যাকপ্যাক, ল্যাপটপ আর পানির বোতল গুছিয়ে নওশীনকে ম্যাসেজ দিয়ে জানালাম রওনা হচ্ছি। বাস ছাড়লো আর ছাড়ার খানিক পরেই ফিরতি ম্যাসেজে পেলাম যাতে অনেক আদরমাখা ভালোবাসার কিছু কথার সাথে আরো কিছু উপদেশ! যাত্রা শুরু হলো ঢাকার পথে, রাজধানীর পথে। আমার পাশে সাতাশ-আটাশ বছর বয়সী এক যুবক। বেশ হ্যান্ডসাম। পরিচয় পেলাম খানিকপরে। আর্মিতে ক্যাপ্টেন। নাম ইফতি। রংপুরে এসেছিলেন বিয়ের পাত্রী দেখতে। পাত্রী তার ফুফাতো বোন। পরিবারের আর সবাই রংপুরেই রয়েছেন আর তিনি ব্যক্তিগত কাজ সারতে যাচ্ছেন ঢাকাতে। ওখানে ওনারা স্থায়ী বাসিন্দা। কাজ সেরে কয়েকদিনের মাঝে আবার ফিরবেন রংপুরে। তখন এনগেজমেন্ট হবে দুজনের। শুনে বেশ ভালো লাগলো। এ বিষয়ে কথা বাড়ালামনা আর। ফুড ভিলেজে এক সাথে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। সেখানে পৌঁছে একসাথেই খেলাম। দেখলাম বেশ দামী একটি ফোন ইউজ করেন তিনি। তার খাওয়া হয়ে গেলেও আমার খাওয়া তখনো খানিক বাকি। তিনি ফোনটা টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে গেলেন। এরই মাঝে দেখি কল এসেছে ফোনে। একেবারেই সামনে ফোনটি বাজছিলো আর আশে পাশের মানুষ তাকিয়ে দেখছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্বেও হাতে নিলাম ফোনটা সাইলেন্ট করবো বলে। খেয়াল হলোনা প্রথমে, পরে দেখেই চমকে গেলাম। হাতের খাবার ছিটকে পরলো কাপড়ে। সেদিকে খেয়াল নেই আমার। স্ক্রীনে যে নাম্বার ভাসছে আলো জ্বালিয়ে তা যে নওশীনের নাম্বার! নামটি সেভ করা জান লেখা দিয়ে! কিছু না বলে কেবল সাইলেন্ট করে ফোনটা রাখলাম। তখনি উনি এলেন। কলের কথা বলতেই উনি বললেন অসুবিধা নেই। আমি উঠলাম ফ্রেশ হতে। কান্না পাচ্ছিলো এতোটাই যে কোথায় পা ফেলছি তাও জানিনা। সবকিছু অবাস্তব লাগছিলো। হয়তো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি ভেবে পানি ছিটালাম মুখে। না ভাংলোনা এই দুঃস্বপ্ন। তখন আমি কেবল এটুকু বুঝতে পারছিলাম যে বেঁচে আছি আর কিছু না।
বাকী পথ একদম চুপ হয়ে পাড়ি দিলাম। সেই ছেলেটিও কিছুই বললোনা আর। ঢাকায় নেমে ফোন দিলাম ছোটখালাকে।
‘আমি ঢাকায় পৌঁছেছি খালা।‘
‘ভালো করেছিস। এখন তুই থাম ওখানেই। গাড়ি পাঠিয়েছি, এখুনি পৌঁছে যাবে।‘
‘না খালা আমি বাসায় ফিরে যাবো। টিকিটও কেটে ফেলেছি। এখুনি গাড়ি ছাড়বে।‘
‘এই কি পাগলামী শুরু করেছিস তুই?’ মাইর খাবি। ফাজলামী হচ্ছে তাই না‘
‘না খালামনি। আমি ফিরতি গাড়িতে চড়ছি। আবার আসবো।‘
নিরব নামের বারবার উচ্চারণ বাজছিলো কানে। খালাকে আর কিছু বলার সাহস পেলামনা। কল কেটে ফোনটা অফ করলাম। জার্নির সময় বেশী কথা বললে আমার খারাপ লাগে, মাথা ঘোরে। সবাই জানে বলে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেনা। নওশীনও সেটা জানে বলে কল দেয়নি। সেই ম্যাসেজের পর আর কোনো ম্যাসেজও পাইনি। কিন্তু আমার প্রশ্নগুলো আর এই ছোট বিষয়কে ঘিরে নেই। ফোনে উত্তর পেলেও বুঝবনা হয়তো কিছুই। তাই যত দ্রুত সম্ভব ওকে সামনে চাইছি। এসবের অর্থ জানাটা এখন বেঁচে থাকার চেয়ে বেশী জরূরী আমার জন্য।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেলো। একদম বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে ফোন খুললাম। প্রায় একশো ম্যাসেজে ভাসছে ইনবক্স। এনার্জি কুলালোনা দেখবার। আবার ফোন এলো। খালামনির ফোন। ধরলাম কলটা। অনেক কান্নার পরে কান্নাটা শব্দ হারিয়ে ফেলে। অমন করে কাঁদতে কাঁদতে খালামনি চিৎকার করতে লাগলেন আমি কোথায় আছি কি করছি এই বলে। জানালাম বাসায় পৌঁছে গেছি আর এখন একদম দরজার সামনে। আর কিছু বলার ভাষা নেই। হারিয়ে ফেলেছি দুপুরে ফুড ভিলেজের ওই ঘটনার পর থেকে।
বাসায় ঢুকতেই আব্বু-আম্মু ছুটে এলেন। তাদের কোনো কথা কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছিলোনা। আমার চোখে-কানে-বুকে তখন নওশীন ছাড়া আর কিছু নেই।
পরদিন দেখা হলো নওশীনের সাথে। কিছুই জানাইনি ওকে আগে। কেবল ফোন দিয়ে যখন ডাকলাম সকালে তখন ভীষণ অবাক ও। রাতে ফোন ধরিনি বলে খানিক রাগ হলো। বলে দিলাম যে মাথা ব্যাথা ছিলো তাই বন্ধ করে রেখেছি। কিছু বললোনা আর।
কফি হাউজের চেনা কেবিনের একপাশেই বসলাম দুজন। কথাগুলো এমনই ছিলো ওর সাথে আমার।
‘নওশীন তুমি কিছু লুকাচ্ছো আমার কাছে?’
‘কি লুকাবো? নিরব, তোমার কাছে কি লুকাতে পারি আমি?’
দীর্ঘশ্বাস আরো গাড় হলো আমার। কি বলবো ওকে আমি? কান্না ঠেকাতে পারলাম না। একদিকে এতো বড় গোপন সত্য অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষের এই মিথ্যে ছলনা! জীবনের মানে বলতে কিছু বাকি রইলো কি আর?
‘তোমার মামাতো ভাই ইফতি তাই না? দোয়া করি তোমরা অনেক সুখে থাকবে।‘
নওশীনের মুখের দিকে তাকালাম না। তাকালে যে মড়ার মতো ফ্যাকাশে একটা মুখই দেখতে পেতাম জানি। মাথা নিচু করেই বললাম, ‘তুমি কি আরেকবার ভাববে সবকিছু? থাকবে আমার সাথে? প্লীজ? কি করে এতোকিছু হলো কিছুই জানত চাইবোনা আমি। কিছুই মনে রাখবোনা তোমার এই না বলা সত্যকে। তবুও আমার সাথে থাকবে কি প্লীজ?’
ওর মুখে কথা নেই। খানিক পরে বিখ্যাত সেই দীর্ঘস্বাস ফেললো ও। যে শব্দটা আমার বুকটা একদম ছাড়খার করে দেয় প্রতিবার।
‘আমাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিক হয়েছে। এটা আটকানোর সাধ্য আমার নেই। হয়তো নিজেই জেনেছো কোনোভাবে। তবে আমি আমিই জানাতাম তোমাকে। তোমার ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করবার সাধ্য আমার ছিলোনা। তাই তোমার বুকে মাথা রেখেছি। আর সারাজীবন তোমাকেই ভালোবাসবো। কিন্তু আমার পরিবারকেও আমি অবজ্ঞা করতে পারতামনা, আর পারবোওনা।‘
কি শুনছিলাম জানিনা। কেবল মনে হচ্ছিলো রাত নেমেছে সকালের আলোতে। কি বলবো আর ওকে? গালি দেবো? ভালোবাসার মানুষকে কি তা দেয়া যায়? জোর করবো? তাতেও তো বাঁধা এই ভালোবাসাই। তারচেয়ে বরং চুপ থাকাই ভালো। যে নিজের পথকে নিজের মতো করে বেছে নিয়েছে তাকে হাজার বাক্যেও আমার পথে ফেরাবার সাধ্য আমার নেই। প্রতিবারের মতো এবারও ওকে রিকশায় তুলে দিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলাম রিকশাওয়ালার হাতে। ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো হয়তো কিছু শোনার আশায়। আমি নির্বাক। সেবারই শেষ দেখেছিলাম ওকে দু’বছর আগে। নির্বাক বাঁধাতে তার মন আটকেনি আমার কাছে। সবাক বাঁধা কি পারতো ওকে থামাতে? দানা বাঁধা প্রশ্নরা এতোদিন পর ফের উঁকি দিলো ওপরে-নীচে ঘুরতে থাকা দেহ-মনে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন