মাধবপুর ষ্টেশন এ বসে আছে রাতুল মাষ্টার একটা পেপার হাতে নিয়ে । মাধবপুর গ্রামের নামকরা শিক্ষক সে । তার পাশে বসে আছে তার একমাত্র ভাতিজি রিমা । মোবাইল এ হেড ফোনে গান শুনছে আর ট্রেন এর জন্য অপেক্ষা করছে । রাতুল মাষ্টার ভাতিজির দিকে তাকিয়ে ভাবছে দেখতে দেখতে মা বাবা মরা
প্রেম
মেয়েটা কত বড় হয় গেছে । ডাক্তার হয়েছে । এখন পি এইচ ডি করার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে । তাই রিমা কে এয়ারপোর্ট এ নিয়া যাওয়ার জন্য তারা ঢাকা যাচ্ছে । দাদা বৌদির মৃত্যুর পর রাতুল মাষ্টার এর এই এক ভাতিজি ছাড়া আপন বলতে আর কেউ ছিল না । শত কষ্ট সহ্য করে তাকে সে মানুষ করেছে । সেই সব পুরনো দিনের কথা মনে করে রাতুল মাষ্টার এর চোখে জল এসে গেলো । তাই সে চশমাটা খুলে চোখের জল মুছে জামার কোনা দিয়ে চশমাটা মুছতে লাগলো ।
এখনো পালটালে না । এখনো এভাবে চশমা পরিস্কার কর তুমি ।হটাত করে রাতুল মাষ্টার এর পিছন থেকে একটা মহিলা কণ্ঠ বলে উঠলো । রাতুল মাষ্টার তারাতারি পিছন ফিরল । দেখল তার পিছন পায়েল দাড়িয়ে
পায়েল কে দেখে রাতুল মাষ্টার পুর অবাক হয়ে গেলো ।
রাতুল মাষ্টার ঃ তুমি এখানে ?
পায়েল ঃ হ্যাঁ । বেড়াতে এসেছিলাম ।
রাতুল ঃ ওহ । ভালো ।
পায়েল ঃ কেমন আছো তুমি ?
রাতুল ঃ ভালই । তুমি ?
পায়েল ঃ আমিও ভালো আছি । স্বামী সংসার নিয়ে ভালই আছি ।
রাতুল ঃ ভালো
পায়েল ঃ পাশে বসা মেয়েটি কি তোমার মেয়ে ?
রাতুল ঃ হ্যাঁ । আমার একমাত্র মেয়ে রিমা ।
পায়েল ঃ আর তোমার বউ ? সে কোথায় ?
রাতুল ঃ নেই
পায়েল ঃ ওহ । সরি
রাতুল ঃ না ঠিক আছে
পায়েল ঃ রাতুল তোমার কি সেই দিন গুলোর কথা আজ মন আ পরে ?
রাতুল ঃ না । মনে পরার কি আছে ?
পায়েল ঃ হ্যাঁ । তোমার তো মনে পরবেই না । তুমি তখন যেমন নিষ্ঠুর ছিলে এখনো তাই আছো । একটু বদলাও নি । তোমাকে ভালোবাসা তাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল । কেন তুমি এমন ছলনা করলে আমার সাথে ? কেন?
রাতুল ঃ সব কেনর কোন উত্তর হয় না
পায়েল ঃ থাক তোমাকে উত্তর দিতে হবে না । আমার ট্রেন এসে গেলো । আমি যাই । ভালো থেকো তুমি ।
রাতুল ঃ তুমিও ভালো থেকো ।
পায়েল ঃ আমার ভালো থাকা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না । আমার স্বামী আমাকে অনেক ভালো রেখেছে । সে তোমার মত নিরদয় নয় ।
এই বলে পায়েল সেখান থেকে চলে গেলো । আর রাতুল মাষ্টার তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল । রিমা এতক্ষণ ধরে সব দেখছিল আর শুনছিল । পায়েল চলে যাওয়ার পর সে তার কাকাকে জিজ্ঞাসা করলো এই মহিলা কে ?কেন সে তাকে এত কথা বলে গেলো ? এভাবে অপমান করলো ?
রাতুল ঃ কেউ নারে মা ।
রিমা ঃ না কাকা ; আজ তোমাকে বলতে হবে কে এই মহিলা ? কেন সে এভাবে তোমাকে অপমান করলো ? আর কেনই তুমি অনেক রাত শুধু এই মহিলার ছবি হাতে নিয়ে চোখের জল ফেলতে ?
রাতুল মাষ্টার পুরো অবাক হয়ে যায় ।
রাতুল ঃ তারমানে তুই সব দেখতি ?
রিমা ঃ হ্যাঁ কাকা । আমি সব দেখতাম । কিন্তু কখনই তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার মত সাহস হয়নি আমার । কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে ।কে ইনি ? কি হন তোমার ? কেন তুমি রাতের পর রাত কাঁদতে ওনার ছবি দেখে ?
রাতুল অনেকক্ষণ রিমার দিকে তাকিয়ে থাকলো । তারপর সিধান্ত নিল আজ ওকে সব বলার ।এতদিনের জমাত বাধা কষ্ট গুলো আজ ওকে বলে নিজের মন কে হাল্কা করবে ।
রাতুল ঃ ওর নাম পায়েল । আমরা এক সাথে ভার্সিটিতে পড়তাম । নবীন বরন অনুষ্ঠানে ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ? সবসময় ছেলেদের সাথে থাকার কারনে আমি কোন মেয়ের সাথে সহজেই মিশতে পারতাম না । কিন্তু ও আমার সেই জড়তা আস্তে আস্তে কেটে দেয় ।আস্তে আস্তে আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু হয় গেলাম । ও ছিল খুব চঞ্চল প্রকৃতির । গান , আড্ডা , সবকিছু দিয়ে মাতিয়ে রাখতো সবাইকে । শেষ পর্যন্ত এমন হল ওর সাথে কথা না বললে , ওকে না দেখলে আমি ঠিক থাকতে পারতাম না । সব কিছু কেমন যেন অস্থির লাগতো । আমি বুঝতে পারলাম যে আমি ওর প্রেমে পরে গিয়াছি । কিন্তু আমি মুখ ফুটে ওকে কিছু বলতে পারতাম না । যদি এটা করতে গিয়ে আমি ওর বন্ধুত্ব হাঁড়াই সে ভয়ে কিছুই বলতাম না । প্রতিদিন সবার চোখের আড়ালে একটা লাল গোলাপ ওর ব্যাগে আমি রেখে দিতাম ।আর সেই ফুল গুলো নিয়ে ও বান্ধবীদের সাথে খুব মজা করতো ।
এভাবেই আস্তে আস্তে পুরো চারটা বছর আমরা একসাথে কাটালাম । আমরা খুব ভালো বন্ধু হয় গিয়েছিলাম । সব সময় আমাদের একসাথেই দেখা যেতো । কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ও শুধু হেসে বলত আমরা শুধু বন্ধু আর কিছু নয় । ওর কথা শুনে আমার মনের কথা বলার সাহস পেতাম না ওকে । এভাবে ভার্সিটি শেষ হয় এলো । শেষ দিন হলে ফেরার পর আমি আমার বইএর ভিতর একটা চিঠি পেলাম । সেটা খুলে পড়তে বসলাম ।

রাতুল,

এতোটা বছর আমরা দুজন একসাথে ছিলাম । কতোটা সময় আমরা দুজনে একাকি পার করেছি । কিন্তু কখনই তুমি আমার মনের কথা গুলো বুঝতে পারো নি । সেই নবীন বরনের দিন থেকেই যে আমি তোমাকে আমার মনের মণিকোঠায় থাই দিয়াছি । কিন্তু তোমার বন্ধুত্ব হারানর ভয়ে আমি তোমাকে কিছু বলিনি । আমি জানতাম না কে আমাকে প্রতিদিন লাল গোলাপ দিতো । কিন্তু আমি সব সময় ভাবতাম এটা তোমার দেওয়া । কিন্তু তোমাকে যখন বলতাম তুমি হেসে উরিয়ে দিতে । এতে আমার হৃদয় টা প্রচণ্ড হাহাকার করতো । কিন্তু তারপরেও আমি তোমাকে কিছু বলিনি । কিন্তু আজ আর না বলে আমি পারলাম না । আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি । আমি তোমার সেই স্বপ্ন দেখা বউটির মত তোমার ঘর কে আলোকিত করতে চাই । তুমি কি নেবে আমায় আপন করে ভালোবাসার নীড়ে ? যেখানে শুধু তুমি আমি , রব মোরা দুজনে । আমি তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম । বিকাল ৫ টায় আমার ট্রেন । আমি তোমার জন্য ষ্টেশন এ অপেক্ষা করব । তুমি যদি একটু আমাকে তোমার মনে থাই দিয়ে থাকো তাহলে আমাকে এসে বাধা দিও । আমি সারা জীবনের জন্য তোমার কাছে থেকে যাবো । আর তুমি যদি না আসো তাহলে আমি বুঝবো তুমি কখনই আমাকে তোমার মনে থাই দাও নি । কিন্তু আমি চাই না সেটা সত্যি হক । তাই আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব ।

ইতি
পায়েল

চিঠিটা পড়ে আমি কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে যাই । যাকে আমি এতদিন এতো ভালবেসেছি , যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন বেঁধেছি সেও আমাকে এতোটা ভালবাসে তা আমি ভাবতে পারিনি । হটাত ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে দেখি বিকাল ৪।৩০ টা বাজে । আমার হাতে আমার ভালবাসাকে বাঁচানোর জন্য শুধু আধা ঘণ্টা সময় ছিল । আমি তখনি বের হয়ে যাই । একটা সি এন জি নিয়ে ষ্টেশন এর দিকে যেতে থাকি । চালককে বারবার তারাতারি চালাতে বলছিলাম । হথাত করে পিছন থেকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত পাই একটা । আর নিজেকে আবিষ্কার করি রাস্তার পাশে । আমার চারপাশ রক্তাক্ত । আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৫ টা বাজতে আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি । এরপর আস্তে আস্তে সব অন্ধকার হয়ে যায় । পুরো ৫ মাস পর আমি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়িতেয় ফিরি । খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ততদিনে পায়েলের তার বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে । তাই আমি আর ওকে কিছু জানাতে যাই নি । গ্রামের স্কুলে মাস্টারি শুরু করে এখানেই থেকে গেলাম । এর ভিতর একদিন খবর আসলো মা বাবা দাদা বৌদি সবাই রোড অ্যাকসিডেন্ট এ মারা ঘেছে । একমাত্র তুই বেঁচে ছিলি । বাড়ি সম্পত্তি সব বিক্রি করে তোকে নিয়ে এখানে চলে আশি আমি । তোকে নিয়ে বেঁচে থাকি আমি ।

সব শুনে রিমার চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে । সে তখন বলে ,

রিমাঃ তুমি কেনও আজ পায়েল অ্যান্টি কে সব বল্লেনা ? কেনও তার করা এতো অপমান তুমি নিরবে সহ্য করলে ? কেনও বল্লেনা না আমি তোমার আপন মেয়ে নই । কেনও বল্লেনা ?

রাতুল মাষ্টারঃ দেখ মা সব কিছুরি সময় থাকে । তখন যদি সেটা না করা হয় তখন টা অর্থহীন হয়ে যায় । পায়েল আজ আমাকে ভুলে ওর স্বামী সংসার নিয়ে অনেক সুখে আছে । আর আমি চাই ও যেন সবসময় সুখে থাকুক । ওকে সব বলে ওর মনে কোন দুঃখের কালিমা দিতে চাইনি । তাই ওর একটা কথারও কোন উত্তর দেই নি । আর আমি তো ভালোই আছি । তোকে নিয়ে , আমার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে । তোরাই তো এখন আমার সব রে । তোদের জন্যই তো আমি বেঁচে আছি এখন ।

সেদিন যদি কেউ মাধবপুর ষ্টেশন এ খেয়াল করতো তাহলে দেখতে পেতো তাদের গ্রামের রাতুল মাষ্টার আর তার ভাতিজি রিমার চোখ দিয়ে অঝর ধারায় বর্ষণ হচ্ছিলো । যা তাদের অতীতের সব বেদনাগুলোকে ধুয়ে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলো ।

 
Top