valobasa valobasa
রাত ৩ টের কাছা কাছি, করিডোর দিয়ে হেটে যাচ্ছে ছেলেটি, জুতোর শব্দ আর্তনাদের মত শুনাচ্ছে। একটা ট্রাউজার আর টি শার্ট পড়া ছেলেটি। কানে ইয়ারফোন লাগানো। করিডোর ধরে চলে এসেছে সিঁড়ির কাছে। নেমেএল সিঁড়ি দিয়ে নিচে। চারপাশ জুড়ে নিসতব্ধতা। গেটের বাইরে চলে এল ছেলেটি। হাসপাতালের গেটের বাইরে এসে দুদিকে তাকিয়ে হুডি টা টেনে দিয়ে হাটা শুরু করলো সামনের দিকে। টং এ গিয়ে চা আর সিগারেট খেতে চাইলো। চারপাশে খুব একটা খেয়াল করা হয় নি। চা খেয়েই সিগারেট জালিয়ে বেড়িয়ে পড়ে টং থেকে। হঠাৎ করেই মনে হল কেউ পিছনে হাঁটছে, কানে থাকা ইয়ারফোনেরকারনে এতক্ষন খেয়াল করে উঠতে পারে নি। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হাতে ধরা জলন্ত সিগারেট নিয়ে ঘুরে তাকালোছেলেটি, ঘুরে মনে হল ডাক্তার এশা ! চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি এসে ভর করে শুভ্রর মুখে ! এই মেয়ে এইখানে এখন কি করছে? দেখলেই চেঁচামেচি শুরু করবে, যেদিন ডিউটি থাকে সারাদিন ক্যাচ ক্যাচিয়ে মাথা খারাপ করে ফেলে।


হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে এশার ডাক পিছন থেকে, এই যে শুনছেন... শুভ্র আরও গতি বাড়িয়েদিল। এই যে, আপনাকে বলছি দাঁড়ান, ছুটে আসছে বলে মনে হচ্ছে পায়ের আওয়াজে। ততক্ষণে হাসপাতালের গেটের কাছে চলে এসেছে শুভ্র। নিরুপায় হয়ে দাড়িয়ে পড়তে হল শুভ্রকে। মাথার হুডিতে তখন ও শুভ্রর মুখ ঢাকা। শুভ্র যা ভেবেছিল সেরকম হল না ঘটনা, মেয়েটিএসে বলতে শুরু করে – “আপনি আমাকে দেখে পালাচ্ছিলেন কেন? শরীরের অবস্থা যতদূর জানিখুব একটা ভালো না তাও কেন বের হয়েছিলেন?”

- ইয়ে মানে ডক্টর, চা খেতে বের হয়েছিলাম
- সাথে টা টাও তো খেতে দেখলাম
- জি, মানে
- সিগারেট খেলেন না একটু আগে, আপনার না নিষেধ আছে সিগারেটখাওয়ায়
-
- কিছু বলছেন না কেন?
- জি ছিল
- তবে খেলেন কেন?
-
- থাক আর বলতে হবে না, এখন গিয়ে কি করবেন? ঘুমাবেন?
- না ঘুম আসছে না গিয়ে বারান্দায় একটু বসবো
- তাহলে আমার সাথে আসুন
- কোথায়?
- ওদিকের টং এ গিয়ে চা খাব, রাতের ডিউটি শেষ, একা একা ভালোলাগছে না, আপনার সাথে একটু গল্প করবো

বাধ্য ছেলের মত শুভ্র গিয়ে বসলো,দোকানে এশা আর শুভ্র ছাড়া আর কেউ নেই, এত রাতে অবশ্য থাকার কথা না। চা খেতে খেতেশুরু হল দুজনের কথা, ক্রমেই বেড়ে চলে, এমন ভাবে কথা চলতে থাকে যেন অনেক দিন ধর একে অপরকে চেনে জানে। রাত শেষ হয়ে প্রায় ভোর হয়ে আসে, টং থেকে হাটতে হাটতে দুজন ফিরে আসে হাসপাতালে। বইতে স্বাক্ষর করে চলে যায় এশা আর শুভ্র ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন ও প্রায় একই রকম ঘটনা,গতদিনের মত আজ টং এ বসে আড্ডা চলছে। কথায় কথায় এশা জিজ্ঞেস করে বসে শুভ্রর পরিবারের কথা, এতদিন হাসপাতালে অথচ কেউ থাকে দেখতে এল না, শুভ্রর অতীত স্মৃতিরকথা। শুভ্র চুপ করে থাকে, এশা ভাবে হয়তো তার বাবা মা কেউ নেই, এসব জানতে চেয়ে হয়তোকস্ট দিয়ে ফেলেছে। এশা পরক্ষনেই বলে “আপনাকে বোধহয় কস্ট দিলাম, থাক বলতে হবে না”। শুভ্র বলে ওঠে “নাহ এতদিনের ধুলোজমা ইতিহাসের খাতা কেউ আজ জানতে চেয়েছে... শুভ্র বলতে শুরু...

ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি, আপন বলতে ছিল কাজের মানুষ। বাবা সারাদিন অফিস, ব্যবসা। মা স্কুল, অন্যসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিনে বাসায় থাকা হত না আমার বলা চলে, সেই সকাল বেলা বের হতাম আর রাতে ফিরতাম। ঈদ, শুক্রবার কিংবা এরকম কোন দিন ছাড়া মনে হয় না বাসার সবার সাথে বসে একসাথে খেয়েছি। সবাই দূরে দূরে থাকতো। স্কুলে পেরেন্টসে ডে তে সবার বাবা-মা আসতো, আমার সাথে কেউ থাকতো না, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম আমি। বছর শেষে প্রতি ক্লাসেরফার্স্ট সেকেন্ডের পুরষ্কার দেয়া হত, সবার বাবা-মা সাথে থাকতো, আমার সাথে কেউ থাকতো না। সেবার ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় আমি বৃত্তি পেয়েছি, ট্যালেন্টপুলেআসে নি, সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছিলাম। মনে আছে আমার সেদিন আমাকে ভাত খেতে দেয়া হয়নি, পরের ৭দিন আমার জন্যে খাবার ছিল কেবল দুইবেলা, তাও পান্তা ভাত আর একটা পোড়ামরিচ দিয়ে। স্কুল থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল সবার বাবা-মা গিয়েছিল, সবাই বাবা-মারসাথে ছবি তুলেছে, আমার সাথে কেউ ছিল না। সারাদিন একা একা থাকতাম, পড়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি শুরু করি। ক্লাস নাইনের শেষ দিকে তখন কিছুটা সটকে গেলাম আমার পথ থেকে, লাইন ছেড়ে বেলাইনে চলতে শুরু করি। সিগারেট-গাজা ধরি, পড়ালেখা ছেড়েই দিয়েছিলাম, মোটামুটি রেজাল্ট করে ক্লাস টেনে উঠে পড়ি।

আমায় দেখার মত কেউ ছিল না, সারাদিন বড়ভাইদের সাথে পড়ে থাকতাম। উচ্ছনের প্রায় শেষ সীমানায় চলে গিয়েছিলাম। আমার সাথেক্লাসের কেউ কথা বলতে চাইতো না, সবাই কেমন করে যেন তাকাতো। এরই মধ্যে একদিনফিজিক্স ক্লাসে আবির স্যারের হাতে চরম মার খেলাম, কেন মার খেয়েছিলাম জানি না। ক্লাশ শেষে উনি ওনার রুমে ডেকেছিলেন, গিয়েছিলাম ও, স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,প্রথেম পিঠে হাত বুলাচ্ছিলেন তারপর বিশ্রী ভাবে শরিরে হাত দিতে শুরু করেন, আমিছাড়িয়ে নিতে চাইলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমো দিতে চাইলেন, কোন রকমে ছাড়িয়ে নিয়েবের হয়ে গেলাম। পরিদন ক্লাসের পর আবার ডাকলেন, আমি যাব না যাব না করেওগেলাম, উনি হুমকি দিলেন ওনার কথা না শুনলে উনি ব্যবস্থা নেবেন। স্কুলে যাওয়া ছেড়েদিলাম। কোচিং এ যাওয়া হত না ঠিকমত, মাঝে মাঝে যেতাম। পারভেজ স্যার খেয়াল করেছিলেনহয়তো উনি ডাকলেন আমাকে, ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন কি হয়েছে? আমি কিছুই বললাম না শুধুকাঁদলাম, বাচ্চাদের মত অঝোরে কাঁদলাম। নাদিয়া নামের একটা মেয়ে স্যারকে ডেকে নিয়েগেল, স্যার একটু পড় এলেন। আমার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বললেন “বাবা তুই কাঁদিসনা, আমি আছি” আমার আরও কান্না পাচ্ছিল। আমার বাবা-মাও কোনদিন আমাকে এরকম কথা বলেননি। প্রি টেস্টে ফিজিক্স পরীক্ষা কিছুটা খারাপ হয়েছিল, তার জন্যে আবির স্যার এরজন্যে আরও সুবিধা হয়েছিল ইচ্ছে করে ফেল করিয়ে দিলেন আমাকে। রাগ আর চেপে রাখতে পারিনি মারতে চলে গিয়েছিলাম, ফলস্বরূপ আমাকে টিসি ধরিয়ে দেয়া হল। পারভেজ স্যার এরকারনে রক্ষা পেলাম সে যাত্রা। নাদিয়া বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিল, নাদিয়া আর পারভেজস্যার এর সহায়তায় ফিরে আসি আমি, আবার পড়াশুনা করি। সে বছর গ্রেডিং পদ্ধতি চালুহয়েছে, এ+ নামের সেই তকমা আমার জোটে নি, এ পেয়েছিলাম। যার কারনে বাসা থেকে আমার খোজ খবর রাখা যেন পুরাই বন্ধ হয়ে গেল। ভালো কোন কলেজের ফর্ম আনা হোল না আমারজন্যে, কোন টাকাও মেলেনি ফর্ম কেনার জন্যে। এলাকার কলেজে পড়ার জন্যে ভর্তি ফরম কেনার জন্যে ২০০টাকার দরকার ছিল, তাও জোটেনি, এক বন্ধুর থেকে ধার করে এনে ভর্তিফরম কিনেছিলাম। দুইটা সরকারি কলেজ থেকে ফর্ম তুলেছিলাম তার একটায় ভর্তি হলাম, ভর্তিতে প্রায় ১২০০ টাকার মত দরকার ছিল, সব পারভেজ স্যার দিয়েছিলেন।

ভর্তি হলাম কলেজে, বাইরে থেকেমনে হত সব ভালোই চলছিল কিন্তু বাসায় আমার সাথে সবার দূরত্ব বেড়েই চলেছে। সেবার কি যেন এক কারনে কলেজে সবার গার্ডিয়ান নিয়ে যেতে বলেছিল,যথারীতি বাবা-মা কেউ যেতে রাজি হয়নি, ভাইয়া রাজি হলেও তাকে যেতে দেয়া হয় নি।বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমাকে কখনো গল্পের বই পড়তে দেয়া হয় নি, টিভিও দেখতে দেয়া হয় নি। যদি কখনো গান শুনতাম কেউ এসে হাজির হয়ে যেত, বকা ঝকা চলত “তোর এত সাহসতুই গান শুনিস” সেদিন কলেজ থেকে ফিরতে ৫মিনিটের মত দেরী হয়েছিল, গরমের কারনে ঘামেভিজে চুপ চুপে হয়েছিলাম, বাসায় ফিরতেই বাবা বকা ঝকা শুরু করেন, গালি গালায করতেকরতে জিজ্ঞেস করেন “কলেজ বাদ দিয়ে খেলার মাঠ থেকে ফিরলাম কিনা” শুধু বলেছিলাম চলেনকলেজে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসবেন। আমাকে প্রচন্ড মারা হয়, বাসা থেকেও বের করে দেয়াহয়। নিজেকে এই প্রাচীন আমলের টাকায় কেনা দাস মনে হত।

বাসা থেকে বের হয়ে আসি, সারা রাতঅন্য এলাকার মসজিদে পার করি, বাসার কেউ একবারের জন্যে খোঁজ নেয় নি, পরদিন সন্ধ্যায়বাসায় ফিরে আসি কিন্তু ঘরে ঢুকতে দেয়া হল না, দুদিন ধরে কিছু খাওয়াও হয়নি আমার। কইথাকবো, কি খাবো কিছুই জানি না আমি। নাদিয়া আর সাব্বির কিভাবে যেন আমার কথা জেনেযায়, ওরা দুজন আমাকে নিয়ে অন্য এলাকার একটা খাবার দোকানে চলে যায়, খাবারের অর্ডারনিয়ে, সাব্বির আর আমাকে খেতে বলে আসছি বলে বের হয় নাদিয়া। খাওয়া শেষ করি আমি,প্রায় মিনিট বিশ পর নাদিয়া আসে, আমরা কলেজের মাঠে গিয়ে বসি। নাদিয়া কাঁদছে আমারকথা জেনে। আমার হাতে হাজার চারেক টাকা ধরিয়ে দেয় মেয়েটা, তার এতদিনের জমানোসবটাকা। সাব্বির তার সাথে মেসে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। মাসে ৩০০টাকা ছিল মেসভাড়া, কই টাকা পাব? কই খাব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। ওরা বলেছিল আমাকে লজিন এরব্যবস্থা করে দেবে, কিন্তু ওরা পারে নি, কোন রকম দুজনকে পড়ানের ব্যবস্থা করেদিয়েছিল। না খেয়ে থাকবার চেয়ে আধপেটা খাওয়া অনেক ভালো।

নাদিয়া একসময় আমায় ভালোবেসে ফেলে,কিন্তু ওকে আমার লাইফের সাথে জড়াতে চাইনি মোটেও, যার নিজের লাইফের ঠিক নেই সে আবারআরেকজনের দায়িত্ব কি নেবে? আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম নাদিয়া কে সেদিন। সে সেদিন আমায়জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল, ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল তবু কেন যেন পারলাম না। মাস তিনেক পরনাদিয়ার বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের দিন খুব কস্ট লাগছিল মনে হচ্ছিল উপর ওয়ালা খুব দামি কিছুআমার থেকে ফেরত নিয়ে গেলেন। কতদিন পর ভালো খাবার পেয়েছিলাম কিন্তু একটুও মুখে নিতেপারি না। নাদিয়ার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, যেন সব দোষ আমার। আমার জন্যেইএমন হয়েছে। বাসায় এসে পাগলের মত কাঁদলাম। দেখতে দেখতে টেস্ট পরীক্ষা চলে আসেকিন্তু বড় ভাইদের পাল্লায় পড়ে বিপথে চলে গিয়েছিলাম, টাকার দরকার ছিল, ওরা যা করতেবলত করে যেতাম। এক সময়ে চলা কমিয়ে দেই তাদেরসাথে, তারা গালি গালায করে কথা বলতে শুরু করে, একবার বেশ মারধোরও করে। তাই বাধ্য হয়ে তাদের সাথে কাজ করি। কোন রকমে এইচ এস সি পার করে এদিকে চলেআসি। এদিকে এসে পড়াশুনা শুরু করি। মাঝে একবার বাবা মায়ের সাথে দেখা করবো বলে বাড়িগিয়েছিলাম কেউ দেখা করে নি, বাড়িতে ঢুকতে দেয় নি। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা দাড়িয়েছিলাম। বড় ভাইদের সাথে কাজ ছেড়ে দেয়ায় ওরে আমাকে সেদিন পেয়ে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মারধোর করে দুদিন বেধে রেখে ছেড়ে দেয়। আর কোনদিন বাড়ির দিকে যাই নি। পড়াশুনা করতেথাকি সাথে কয়েকটা টিউশনি করি চালিয়ে নিচ্ছিলাম। নাদিয়াকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ত,মেয়েটা আর সাব্বির না থাকলে আমার আর বেঁচে থাকা হত না, রাস্তার একটা কুকুর ও আমারচেয়ে ভালো থাকে তাকেও অন্তত না খেয়ে থাকতে হয় না। মাঝে মাঝে ভাবি কি এমন অপরাধ করেছিলাম বাবা-মা আমার সাথে এমন করলেন? ভালো রেজাল্ট কি সব? আমার বন্ধু বলতে এক সিগারেট আর আমার ভাঙ্গা গিটার, আমি তাদের ছাড়লেও তারা আমায় ছাড়ে না। সিগারেট খেতেখেতে ভিতর টা একেবারেই পচে গেছে বোধহয়।

এশা কিছু বলছে না, চোখ দিয়ে পানিঝরছে... মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল শুভ্র, এশার দিকে তাকাতেই...
- কি ব্যাপারডাক্তার সাহেব? আপনি কাঁদছেন? ডাক্তাররা তো কশাই হয় জানতাম, এভাবে কাঁদছেন কেন?
- ডাক্তাররা কি মানুষ না? আবেগ নেই আমাদের?
- বাদ দিন ওসব কথা, আপনার সম্পর্কে বলবেন না কিছু
- নাহ, আজ আর কিছু বলবো না, সকাল হয়ে আসছে, কাল বলবো।আপনার ভাঙ্গা গিটার টা কোথায়?
- কেন বলুন তো? ওটা কেবিনে আছে
- কাল নিয়ে আসবেন, এখন চলুন...

পরের দিন রাতে টং থেকে চা খেয়ে,সিগারেট নিয়েছে শুভ্র, হাতে গিটার টা, পাশাপাশি হাটছে দুজন। কিছুদূর যাবার পর একযায়গায় বসে তারা। আজ হাসপাতালের ভিতরের দিকে পুকুরের পাড়ে বসেছে।

- আপনার এটা একটু বাজাবেন?
- ঠিক আছে, গান জানেন আপনি?
- ছোট বেলায় ছায়ানটে যেতাম, পড়ে আর যাওয়া হয় নি

গিটার টুং টাং শব্দ তুলে বেজেচলেছে, সাথে তাল মিলিয়ে সিগারেট খেয়ে চলছে শুভ্র, মাঝে মাঝে বেশ কাশছে। কিছুক্ষনবাজানোর পর থেমে যায় শুভ্র।

- আপনার কি মন খারাপ? কিছু বলছেন না যে...
- আপনি বাজাচ্ছিলেন, তাই শুনছিলাম। নিবিড়ের কথা মনে পরছিল,ও খুব ভালো বাজাতো
- তাকে ভালোবাসতেন বুঝি?
- হুম তাকে খুব ভালবাসতাম
- বাসতাম বলছেন যে, এখন আর বাসেন না?
- নাহ
- কেন?
- সে অনেক কথা
- বলা যায়?

বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়েছিলাম, অনেক আদরে পেতাম। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, মা মারা যান। বছর না পেরোতেই বাবাআবার বিয়ে করেন। সৎ মা এর সংসারে আমি, বুঝতেই পারছেন কেমন গেছে দিনগুলো। অনেক কস্টকরে মেডিক্যালে চান্স পাই, সৎ মা আমাকে পড়তে দিতে চান নি, এত টাকা কেন আমার জন্যেখরচ করবে? বাবা কাউকে না জানিয়ে আমার জন্যে ব্যাংকে টাকা জমিয়ে ছিলেন, সে টাকাদিয়েই আমার পড়াশুনা হয়েছে আর বসায় বলা হয়েছে বৃত্তির টাকা। হঠাৎ করে সৎ মা আমারজন্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেন, রিকশাওয়ালা,ফেরিওয়ালা কারো হাতে তুলে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। সৎ মায়ের কারনে বাবাও কিছু বলতেননা, আমিও কিছু বলি নি, নিজেকে বুঝিয়েছি বাবা আমার জন্যেই ওনাকে এনেছিলেন কিন্তুআমার ভাগ্যটাই খারাপ। সৎ মায়ের এক মেয়ে এক ছেলে ছিল। ছেলেটা তার বোনের বদলে আমাকেইবেশি ভালোবাসতো। বাইরে কোথাও কিছু খেলে মায়ের চোখ যেভাবেই হোক ফাকি দিয়ে নিয়েআসতো। ও সবাইকে ফাকি দিয়ে আমার কাছে আসতো, বুবু বলে সারাটা খন মাতিয়ে রাখতো, আমিওভুলে যেতাম আমার সব কস্ট। সব ওর সাথেই বলতাম। নিবিড়ের কথা ওকে বলেছিলাম, বসায়জানালাম মানলো না, অন্যজায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ভাইটা আমার বাসা থেকে ১৫ হাজারটাকার মত চুরি করে, আমাকে নিয়ে এসে নিবিড়ের হাতে তুলে দেয়, কাঁদছিল আর বলছিল “আমারবুবুকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম, আমার বুবুকে দেখার মত আর কেউ নেই” ওই ই শেষ আরকোনদিন দেখা হয় আমার ভাইটির সাথে। নিবিড় একটা বাসা ভাড়া করে দেয়, আমিও চালিয়েনিচ্ছিলাম। দিন কে দিন নিবিড় বদলে যেতে থাকে, একদিন শুনি নিবিড় বিয়ে করেছে, আরযোগাযোগ করি নি ওর সাথে।

এইতো বেশ আছি, চোখের জল মুছসে এশা... এত রাগী একটা মানুষআর কেমন তার অতীত। শুভ্র বেশ কাশছে, বাইরে আজ কুয়াশাও আছে বেশ।

- চলুন
- কোথায়?
- আপনাকে কেবিনে রেখে আসি, আপনার শরীর খারাপ হচ্ছে আরও
- নাহ কিছু হবে না
- অনেক গুলো সিগারেট খেয়েছেন তার উপর ঠাণ্ডা বেশ, ডাক্তারহয়ে রোগীকে এইভাবে ছাড় আরতো দিতে পারি না, চলুন চলুন...
- এত তাড়াহুড়ো করছেন যে?
- কাল থেকে রাতে ডিউটি নেই, কয়েকদিনের ছুটি আছে
- ও আচ্ছা
- হুম আপনার সাথে গল্প করা হবে না

গত দুদিনে শুভ্রর অবস্থা আরও খারাপ হয়, সিগারেট খেতেখেতে ফুসফুস ছাই করেই ছেড়েছে সে, শ্বাস করতে বেশ কস্ট হচ্ছে, কেবিনে সে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাঃ এশার চেহারা টা ভাসছে যেন চোখের সামনে, মেয়েটার আজ ডিউটি নেই। নাদিয়াকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, ডা এশা থাকলে একবার খবর দেয়ার চেস্টা করতো নাদিয়া আর সাব্বিরকে। আজ সে মন থেকে বলছে আমি বাঁচতে চাই, আল্লাহ আরএকটা দিন আমাকে বাঁচাও। একটা অস্ফুট স্বর ডাঃ এশা আমি বাঁচতে চাই, আমার চিকিৎসাকরবেন না?

অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে থাকে, আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হয় শুভ্রকে... ঘণ্টা খানেক পর তাকে ক্লিনিক্যাল ডেড ঘোষণা করা হয়। বাড়ির কোন ঠিকানা রাখে নি শুভ্র, যে ঠিকানা রেখেছিল তাও যে মিথ্যে। হাসপাতালের খরচ আগে থেকেই মিটিয়ে রেখেছিল হয়তো জানতো এমন পরিণতি হবে। কে নেবে এই লাশ? দাফন কাফন সৎকার কে করবে? কর্তৃপক্ষ খবর দেয় কোন দাতব্য সংস্থাকে। লাশ দাফন বেওয়ারিশ হিসেবে... শেষ ইচ্ছেপুরন হয় নি, বলবে কাকে আর পূরণ ই বা করবে কে। নাদিয়াকে দেখার ইচ্ছেও পূরণ হল না,কেউ জানলো না গোপনে শুভ্র ও ভালবেসেছিল নাদিয়াকে, অজানাই রয়ে গেল, মুছে গেল শুভ্র নামের কারো স্মৃতি...

খানিকটা বাস্তব আর অনেকটা কল্পনায় লেখা...


একটা ভালো রেজাল্ট ই সব না, বাঁচার জন্যে একটু খাওয়া আর শান্তির দরকার, তার জন্যে কাড়ি কাড়ি টাকার দরকার নেই। আমরা শেখার জন্যে কেউ পড়ি না, টাকা কামানোর জন্যে পড়ি, একটু ভালো থাকার জন্যে পড়ি, একটু ভালো খাওয়ার জন্যে পড়ি। যে পড়া লেখা একটা লাইফ ধ্বংস করে দেয়, সুইসাইডের পথে হাটায়, তার থেকে কি বের হয়ে আসা যায় না? দরকার নেই কাড়ি কাড়ি টাকার। বড় হয়ে তোমাকে ভালো চাকরি পেতে হবে, অনেকটাকা পেতে হবে, দয়া করে অর্থ লিপ্সার চিন্তা বাচ্চাদের ভেতরে সৃষ্টি করে দিবেন না।
 
Top