তৃপ্তির সঙ্গে এক রাত্তিরপুরবে নীরব ইশারাতে একদা নিদ্রাহীন রাতে
হাওয়াতে কী পথে দিলি খেয়া –
আষাঢ়ের খেয়ালের কোন খেয়া।’ (রবিঠাকুর)রঞ্জা শহরে না থাকলে মিথ্যে এমন উদাসী হাওয়ার ভিজে দিন। মিথ্যে হয়ে যায় মেঘ মেদুর রান্না-বাটি, খাট-পালঙ্ক, এক চিলতে সিঁড়ির নিকশ কালো অন্ধকার! দুর্বহ মনে হয়, কলকাতার পথে পথে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো। খুব একলা লাগে, ঘুমের মধ্যে। ঠোঁটের ওপর প্রতিটা কামড়ে নিজের-ই একাকী দাগ দেখে! রঞ্জা নেই মানেই নির্লজ্জ ফকিরের ওর স্মৃতিতে সমর্পণ!
কোনও কোনও সম্পর্ক তো এটাও দাবি করে; যে কাছে নেই, নিয়ত তারই সঙ্গে থাকো! নিষ্ঠ হয়ে কেবল ভাবো সেই ‘চিরসখা’-র কথা। রঞ্জা কলকাতায় নেই! কিন্তু ঝরঝর মুখর এই বাদর দিনে শার্সির ধারে, একটি নিতান্ত আটপৌঢ়ে কোটা শাড়িতে, ছোট হাতার প্লেট-মুড়ে সেলাই করা লো-কাটের ব্লাউজে ওর চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা, বা তুমুল শ্রাবণের বৃষ্টির বন্দিশে ওর মারফতি মাতোয়ারা হয়ে উঠে রেলিং-এর বাইরে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার শুদ্ধ ছবি ফকিরের মনে যেমন গাঁথা! কে জানে এই স্মরণিয়া অসুখের কি নাম দেবে তোমরা? তোমরা কি কেউ জানো? জানলে বলো প্লিজ!

জুঁইয়ে মোড়া ওর এলো খোঁপা ভাঙার; যামিনী পটে জড়ানো স্মৃতিতে মশগুল ফকির এখন। সে সব ভাবতে ভাবতেই একাকী নিশিঠেকের ‘টিপ টিপ বরসা পানি’-র পথে পাড়ি। ট্যাক্সির এফ এম’এ সত্তরের ‘অজনবি’ চলছে। ‘ভিগি ভিগি রাতো মে’। ,-সাইনে যেন সেই দৃশ্যসুখ। নিভৃত ছাদে রাজেশ-জিনাতের বৃষ্টি ভিজে জলখেলা। ‘দমকত বিদ্যুত’- এ জিনাতের ভয়-বিহ্বলা মুখ!

যেতে যেতে এও একরকম অলীক সুখ যাপন। এক্সাইড থেকে ভবানীপুরের দিকে যেতে মনে পড়ল রঞ্জা বলেছিল তৃপ্তির কথা। তৃপ্তি! এই শহরের তৃপ্তিকে চেনেন? না, না। তাকে না চিনলে, খোঁজাটা মিছিমিছি। এ শহরে তৃপ্তির সঙ্গ সুখের জন্য ৩১ এ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রোডে থামতে হবে আপনাকে। ঠিক, এবারের নিশি কিন্তু বকুল ঝরানো ভিজে হাওয়ার এই সন্ধে রাতে, নির্মেদ তৃপ্তির নিজস্ব নিখিল নিয়েই। ঝিলমিল সে মেয়ের সঙ্গে নিশিঠেক।

রঞ্জা ঠিক জানে, এখন ফকির নিশিতে যাবে। সাগরপার থেকে হোয়্যাটস অ্যাপের চ্যাট উইন্ডোতে লিখল ‘এমন কি তোমার আঙুল/ শরীরের ঘাটে ঘাটে তানপুরার জলধ্বনি/ কিভাবে বাজায়।’ উত্তরে কি লিখব? কেউ কি বলবে এমনতরো মতিচ্ছন্নে যাবার কথার উত্তর? লিখলুম, …যেন ‘চিঠির ভাঁজে পা গুটিয়ে শুয়ে থাকে কোন খরস্রোত’।,!

ওর পাঠানো ভিজে লিপস্টিক ঠোঁট! গ্লস! জানি, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সতর্ক চোখ এড়িয়ে ট্যাবের স্ক্রিনে ওর এই লালি ঠোঁটে, চুপি চুপি ঠোঁট ছোঁওয়ালেই বৃষ্টি ভেঙে পড়বে ভুবনডাঙায়!

খাস কলকাতার মধ্যে এখনও এমন একটি পানশালা, ভাবাও যায় না! ভিড় থিকথিক যদু বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতেই মনে হল, দ্রাঘিমা ডিঙোনো ভিড়ের সমুদ্রে এসে পড়লাম বুঝি। এক পান-দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই দুটো দোকান বাদে একটা বৃহন্নলা গলির কথা বলল। এগোতে সাতমহল! পিছোতে সা…! না, পিছনে তাকানোর ফুরসত কোথায়? গলিপথে একটু এগোতেই নেমে এল ছিপছিপে তৃপ্তি। বিপজ্জনক ওর চাহনি। চোখের সুরমায় যেন নিশিকুঠুরির সুধা নিমন্ত্রণ। সিঁড়ি ভাঙছি… হাজারদুয়ারে যাওয়ার সাবেক দিনের কেঠো সিঁড়ি। পিঠখোলা গুজরাতি ঘাগরা চোলিতে ও যেন গুরু নিতম্বের দোলনমায়ায় ডেকে নিল ওরই খাসমহলে।

তৃপ্তির কাছে এলে এমন অভ্যর্থনা জুটবে সবার। মনে হল, তৃপ্তির এই সিঁড়িতে সময় যেন থেমে আছে। এর নির্মাণে, সৃষ্টির ছন্দে অপূর্ব সে যতি। চতুর্দিকে কালের ক্ষত, তবু বিস্ময়ে কাছে ডেকে নেয় আদরে। ঈর্ষাতুর গরিমায়। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে, রাত ১১টা, সঙ্গসুখের জন্য খোলা এই উষ্ণ আহ্বান। কোনও বিরক্তি নেই যেন এঁদের। সেই ১৯৩৫। ,!

সিঁড়ি ফুরিয়ে এক ফালি বারান্দা। লাগোয়া তৃপ্তির খাসমহল। ভিতরে পা রাখতেই মনে হল, যেন ষাট-সত্তরের দশকের কোনও হলিউডি ছবির সেটে এসে পড়েছি। ঝিমধরা আলোয় চোখ সইতে সময় নিল কয়েক লহমা। কোনও আড়াল নেই কোথাও। কলকাতার এই সময়ের রজনীনিলয়ের সঙ্গে এর কোনও মিলও নেই। শহর বদলে লাল থেকে সবুজ হলেও, তৃপ্তি আছে সেই তৃপ্তিতেই। দেখনদারির থেকে তৃপ্তির আকর্ষণ এটাই যে, এখানকার সাবেক কলকাতার নেশা ঝিলমিল পাঁইট পরিবেশ। যেন মোদো-মাতালদের জমজমাট শুঁড়িখানা!

- লার্জ বিপি। খাবার কী মিলবে?

উর্দিধারী মধ্যবয়স্ক টেন্ডার রঙচটা প্লাই-এর টেবিলে সফেদ জল-গ্লাস আর কাঁচা ছোলার বাটি রাখতে রাখতে ফরফর করে উত্তর দিল,

- চিলি চিকেন, চিকেন কাবাব, চিকেন কষা, সিদ্ধ ডিম…

- কাবাব! স্রেফ এক প্লেট কাবাব। টিস্যু দিও।

মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছি। রঞ্জা এখানে এলে খুব এনজয় করত। কিন্তু ওকে এখানে যে আনা যাবে না, সেটা বলেছিল অনির্বাণ। অনির্বাণকে মনে আছে? রুদ্রর সঙ্গে… ! রুদ্র এখন প্রবাসে, নতুন চাকরি নিয়ে সুন্দরী বউয়ের সঙ্গে দরবার জমিয়েছে দিল্লিতে।

- একটা সিগারেট হবে?

দীর্ঘ চুমুক দিয়ে সবে সিগ্রেট ধরিয়ে চৈতন্যে ধুঁয়ো দিচ্ছি, ঠিক সেই সময় বেয়াড়া এই আব্দারটা ফকিরের কানে এল। বহুদিন পর, নিশিঠেকে এমন করে কেউ সিগ্রেট চাইল। মানে অচেনা কেউ। যেদিক থেকে অনুনয়টা এল, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, এক সু-শোভন বৃদ্ধ। নেশাতুর চোখের নেশা পড়ে এগিয়ে দিতেই হল। একটা সফেদ সুখকাঠি।

বাইরে বোধহয় আবার তুমুল বৃষ্টি এল। খোলা জানলা দিয়ে তৃপ্তির ভিতরমহলে বাদলের ছাট এসে ঢুকছে। কারও হুঁশ নেই, থাকা কি খুব দরকার? হুঁশ নিয়ে নেশা হয় নাকি!

চতুর্দিকে চূড়ান্ত হট্টগোল, কোনও রাখঢাক নেই কারও। বীরভূমের সাঁওতাল পল্লীতে মাতালশালগুলোর পরিবেশ যেন। যেন বা, নিখাদ বাংলা ঠেক। ভিতরের কম আলোতেই কোনও কোনও টেবিলে চলছে ইস্কাবনের বিবি আর গোলামের টেক্কা-বাজি। ঝনঝন করে কখনও কানে এসে পড়ছে গ্লাস ভেঙে পড়ার শব্দ। চারপাশে ধোঁওয়া, শুধু ধোঁওয়া। এক্ষুনি বুঝি বুকের ভেজানো দরজা ঠেলে এসে দাঁড়াবে কেউ!

কোথা দিয়ে যে দুটো পেগ উধাও! জমাটি রান্না এঁদের। বেশ বুঝতে পারছি ফকিরের একলা টেবিলের উলটো দিকে এসে বসেছে ঝিলমিল সেই মেয়ে। ওর উদ্ধত শরীরে ঢাকা-না-ঢাকা চোলির খেলা দেখছে চারপাশের আড়চোখ। ফের একটা লার্জ অর্ডার করে রঞ্জাকে নিরুপায় হয়ে লিখলাম পিলু রাগে গাঁথা, রবিঠাকুরের বর্ষার গানের আভোগ, ‘বুঝি এলি যার অভিসারে মনে মনে দেখা হল তারে,/ আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া-/ আপনায় লুকায়ে দেয়া-নেয়া’!

ক্রমশ…

-আবীর মুখোপাধ্যায়
 
Top