অনুভূতি
মাহিন এবং নীরা পার্কের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে। পাশাপাশি বসলেও দুজনের কেউ কাউকে দেখছে না, কারো মুখেই কোন কথা নেই। ঐ দূরের নীল আকাশটাতে ঘন কালো মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘের আড়ালে সূর্যটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ক্রমশই চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে।

নীরা মাহিনকে তাড়া দেয়, "আমাকে দেখা শেষ হয়েছে? আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিটাও বোধহয় চলে আসবে। তুমি কি আমাকে কিছু বলবা? আমার এখন যেতে হবে।"

মাহিন একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ তুলে অসহায় চোখে নীরার দিকে তাকায়। নীরার চোখে চোখ পড়তেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কান্নায় চোখ ভিজে যায়। অনেক চেষ্টা করেও কান্না চেপে রাখতে পারছেনা। নীরাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, পরক্ষনেই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর গলা চেপে ধরেছে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছেনা। মাহিন নীরাকে কিছু বলতে এসেছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কিছুই মনে পড়ছে না। ভেতরটা কেমন যেন শূন্য মনে হচ্ছে। ওর ইচ্ছে করছে নীরার হাতটা একটু ছুঁয়ে দিতে।

আচ্ছা, ও যদি এখন নীরার হাত ধরতে চায় নীরা কি ওকে হাত ধরতে দিবে? আশ্চর্য্য এই হাত ধরে দিনের পর দিন ওরা কত ঘুরে বেড়িয়েছে। আর আজ কতই না সঙ্কোচ কাজ করছে। পাশাপাশি থেকেও আজ দুজনে কত দূরে। এখন আর মাহিন চাইলেই নীরার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেনা।

মাহিনের ইচ্ছে করে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলতে, তুমি কেন বোঝ না তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি? আর কতটা ভালোবাসলে তুমি আমার হবে? আর কতটা ভালোবাসলে তোমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে শুধু আমিই থাকবো? আর কতটা ভালবাসলে তোমার কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অপূর্ন জীবনটা পূর্নতা পাবে?

মাহিন শধু ভেবেই যায় কিন্তু নীরাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। অনেক সাহস সঞ্চয় করে শেষমুহূর্তে বলেই ফেলে, তোমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা তোমার সাথে কি আমার আর কখনোই দেখা হবেনা?

"মাহিনের মুখে এমন কথা শুনে নীরা চেঁচিয়ে ওঠে। এই কথা বলতে তোমার একটুও লজ্জা হয়না? দেখা হবেনা কেন? অবশ্যই হবে। তুমি যখন চাইবে তখনই হবে। আমি স্বামী সংসার ফেলে তোমার ডাকে ছুটে যাব। ফাইজলামির আর জায়গা পাওনা? আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমার মত ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ানো। এটা আমি এখন বুঝতে পারছি। খবরদার তুমি আমার সাথে আজকের পর থেকে যোগাযোগ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবে না।"

মাহিন কিছু বলতে চায় কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। মাথা নিচু করে রাখে। গরীব ঘরে জন্ম নেয়াই আজন্ম পাপ। ইচ্ছা থাকলেও নীরাকে ও কখনো কিছু দিতে পারেনি। কখনো বের হলে নীরাই সব খরচ করে মাহিন তখন লজ্জায় সঙ্কোচে মাথা নিচু করে রাখে। নীরা ঠিক কাজই করছে, বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করছে। নীরাকে ও কখনো সুখী রাখতে পারত না। এক দুই বেলা না থেয়ে থাকলেও ওর কোন সমস্যা নেই। কিন্তু নীরার মত বড় ঘরের মেয়েকে ও কিভাবে না খাইয়ে রাখবে? সবকিছুরই শেষ আছে ঠিক তেমনি ভালোবাসারও শেষ আছে। একদিন হয়ত নীরা বিদ্রোহ করে বসত। না পাওয়ার চেয়ে পেয়ে হারানোর কষ্ট সব সময়ই তীব্র হয়। দরকার কি এত ঝামেলা করার? নীরা বিয়ে করুক, সুখে থাকুক। নীরার সুখই ওর সুখ। নীরার মত মেয়ে করুনা করে এতদিন ওর সাথে ছিল এটাই ওর জন্য অনেক বেশি কিছু। এর বেশি কিছু ওর কাছে প্রত্যাশা করাও পাপ।

ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নীরা উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করেছে। মাহিন বেঞ্চে ঠায় বসে আছে। নীরা হেঁটে যাচ্ছে, মাহিন ওকে আটকানোর কোন চেষ্টাই করল না। চেষ্টা করেই বা লাভ কি? আজ থেকে ওদের দুজনের রাস্তা আলাদা। নীরা কয়েক কদম হেঁটে যাবার পর হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ফিরে তাকায়। মাহিনের মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। আগের মত একি জায়গায় বসে আছে। আশ্চর্য্য মাহিন নামের মেরুদন্ডহীন ছেলেটার জন্য ওর খুব কান্না পাচ্ছে। দৌড়ে ওর পাশে গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে। চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি মিলে নীরার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। ওকে দেখতে নিশ্চয়ই এখন অনেক বিভৎস লাগছে। আর এটা দেখে মাহিন মনে মনে হাসছে, আর খুব মজা পাচ্ছে……
 
Top