হালুয়ার ঘ্রানে চারিদিক যেন ম ম করছে। আজ বাসায় বিশেষ অতিথী আসছে। সূদুর ইংল্যান্ড থেকে। সেই অতিথীর জন্যই এতসব আয়োজন। তবে বিদেশ থেকে আসা অতিথীদের হালুয়া খেতে কত টুকুভালো
কথার আড়ালে
লাগবে বুঝতে পারছেন না অপরাজিতার মা!
সাত সকাল বেলাতেই মা চুলো জ্বেলেছেন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায় তবুও তিনি রান্না করেই যাচ্ছেন। ব্যস্ততার মাত্রাটা এমনই যে কিছুক্ষন আগে ক্ষেপে গিয়ে তিনি অপরাজিতাকে উত্তম- মধ্যম ঝাড়ি দিয়ে গেলেন।
অপরাজিতার মা’র পুরোনো অভ্যেস, তিনি যখন অতিমাত্রায় সাংসারিক কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন তখন অপরাজিতাকে ঝাড়ি দেন। অপরাজিতা- এই বাড়ির ছোট মেয়ে। এইবার এইচএসসি দিবে।
প্রচন্ড মেধাবী আর পড়ুয়া মেয়ে বলতে যা বোঝায় এক কথায় অপরাজিতা তাই। এসএসসি তে প্রত্যেকটা বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছিল সে। তার বেশি ভাল লাগে ইংরেজী পড়তে। তার ইচ্ছে এইচএসসি পাশ করে সেও তার আপুর মত বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবে, ইংরেজী সাহিত্যের উপর।
আজ মোটেও ভালোমত পড়তে পারছে না অপরাজিতা। একে তো মায়ের বকুনী অন্যদিকে অনেকদিন পর আপুর সাথে দেখা হবার উত্তেজনা। সব মিলিয়ে আজ যেন একটু উদাস উদাস লাগছে নিজেকে।
আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। রাতেই তো আসছে আপু। আচ্ছা ওর মিতা আপু আর দুলাভাই কি ওর জন্যে কোনো উপহার নিয়ে আসছেন? নাকি তারাও এসে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মত শুধু পড়াশোনারই খোঁজ নিবেন!
এই সব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আবার মায়ের ডাক শুনতে পেল অপরাজিতা।
-এই অপরাজিতা, আজকের দিনটাতেও কি বই এ মুখ গুজে বসে থাকা লাগবে নাকি! কাজ কাম না করিস, ঘরটা গোছালেও তো পারিস, নাকি?
-হু করছি। বলেই অপরাজিতা উঠে গেল পড়ার টেবিল থেকে। আজ আর পড়া হবে না। তার থেকে বরং মাকে একটু সাহায্যই করা যাক।
রাত নয়টা উনচল্লিশ মিনিটে আপু আর দুলাভাই বাসায় আসলো। বাসায় ঢুকার পরেই মা আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু কড়ে দিলেন। ঠিক যেন হারিয়ে যাওয়া সন্তান ফিরে পেয়েছেন তিনি।
খুব অল্পতেই কান্নাকাটি করে অপরাজিতা মা। আর মাকে কাঁদতে দেখলে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা সে। এজন্যই মায়ের এই কান্না স্বভাব পছন্দ না তার।
আলিঙ্গনে থাকা মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে অপরাজিতা। হঠাৎ পিঠে একটা হাত পড়ল। ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকিয়েই দুলাভাইকে দেখতে পেল। দুলাভাইয়ের নাম নাহিদ।
-কী, বোনের জন্যই কাঁদবে, আমরা কেউ না?
দুলাভাইয়ের এই প্রশ্নে ভীষন লজ্জা পেল অপরাজিতা। সে ওড়নার আঁচলে চোখ মুছে নিল।
-বাহ! বেশ দেখতে হয়েছ তো! এত সুন্দর মেয়ে তো আমি লন্ডনের সাদা চামড়াতেও দেখিনি।
অপরাজিতার সারা শরীরে নজর রাখতে রাখতে কথাগুলো বললেন দুলাভাই। লজ্জায় মা আর বোনের কাছে ছুটে গেল সে। দুলাভাই এগিয়ে এসে অপরাজিতার মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।
রাতের খাওয়া শেষে গল্প শুরু হয়! কত-শত গল্প জমে আছে, দুই বোন আর তাদের মায়ের।
একসময় গল্পে যোগ দেয় দুলাভাই। বেশীরভাগ গল্পই অবশ্য ইংল্যান্ড নিয়ে। ওখানে মানুষ কেমন, ঠান্ডা কেমন! ঠান্ডায় মানুষজন কি করে এই সব হাবিজাবি। গল্পের এক পর্যায়ে অপরাজিতার হাতে একটা মোবাইল ফোনের প্যাকেট ধরিয়ে দেয় দুলাভাই।
মিতা আপা জানায়, অপরাজিতার দুলাভাই বিদেশ থেকে দুটো মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছে।
একটা নিজের বোন শায়লার জন্য আরেকটা অপরাজিতার জন্য। ফোন নিয়ে অপরাজিতার মা আপত্তি করতেই দুলাভাই অভিমানের সুরে বলেন-‘আপনি কেন আপত্তি করবেন মা। অপরাজিতা আর শায়লার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য করি না। এই দু’টো আমার আদরের বোন।’
এই কথা শুনে মা আর আপা হাসলেও ভীষণ কান্না পায় অপরাজিতার। খুশির আবেগে কান্না। ইশ! এত ভাল হয় মানুষ। একটা ভাই না থাকার যে কষ্ট প্রতিদিন মনে আসত সেই কষ্টটাকে আজ বিদায় জানাল সে। দুলাভাই-ই তার ভাই। মায়ের পেটের আপন বড় ভাই।
.
সবাই ঘুমাতে গেছে। গল্পে গল্পে কেটে গেছে অনেক সময়। সারাদিন একদম পড়া হয়নি। নিজের রুমে ঢুকে তাই অপরাজিতা ঠিক করেছে ভোর চারটা পর্যন্ত পড়বে।
আড়াইটার দিকে অপরাজিতার ঘরে ঢুকলেন দুলাভাই। হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল- ‘পড়ছ নাকি? কোন সাবজেক্ট পড়ছ?’
‘ফিজিক্স পড়তেছি। ভাইয়া, কিছু লাগবে?’
‘আরে না না তোমার উঠতে হবেনা। তুমি পড়তে থাক, আমি এমনি দেখতে এলাম তোমাকে। ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম...’-কথাটা শেষ না করেই অপরাজিতার পাশে বসলেন দুলাভাই। একদম গা ঘেঁষে।
অপরাজিতা বিব্রত মুখে দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিল। সে পড়ায় মনযোগ দিতে চাইল। হঠাৎ দুলাভাই উঠে গিয়ে দরজাটা আটকে দিলেন। হতম্ভব হয়ে দুলাভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে সে। দুলাভাই হাসছে। ভয়াবহ সেই হাসি। এমন হাসির দুলাভাইকে চেনে নে অপরাজিতা।
ঘটনাটা ঘটে গেল চোখের পলকে। নিজেকে একটা নোংরা আবর্জনা মনে হল অপরাজিতার। যার উপর শকুনের মত হামলে পড়েছে দুলাভাই। ইশ! কী নিষ্ঠুর মানুষ! কী বেঈমান মানুষ!!
কাকে বলবে সে এই অপমানের কথা। কেউ কি বিশ্বাস করবে? সামান্য একটু লালসার কাছে এভাবেও পরাজিত হয় শ্রদ্ধা, বিশ্বাস আর ভালবাসা!
বারান্দাটায় একলা দাঁড়িয়ে আছে অপরাজিতা। সামনের রাস্তায় একটা ছোট্ট সজনে গাছ। রাস্তার পাশেই বারান্দা হওয়াতে রাস্তার লাইটের আলো বারান্দায় এসে পড়ছে। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। খানিক বাদে নিভে যাবে শহর আলো কড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যম্পপোষ্ট। নিভে যাবে কিছু ভালবাসা।
লোকে লোকারণ্য অপরাজিতাদের বাড়ি। বারান্দায় জমা হয়েছে মহীলাদের ভীড়। ওখানে কাঁদছেন অপরাজিতার মা আর বোন মীরা। উঠানে রাখা খাটিয়াতে সাদা কাপড়ের নিচে শুয়ে আছে অপরাজিতা। সে দেখছে চোখে মুখে কৌতুহল নিয়ে চেনা অচেনা লোকজন তাকে দেখতে এসেছে।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হতে চলল, লোক সমাগম কমছে না, বরং বাড়ছেই। ফাঁসির মরা বলে কথা। পুলিশ এসে ফিরে গেছে। বিদেশি ডলারে তাদের ম্যানেজ করেছেন দুলাভাই। মাস্টার সাহেবের মেয়ে ফাঁস নিয়েছেন। মান-সম্মানের ব্যাপার। এটা নিয়ে টানা হেঁচড়া করা যাবে না।
আসছেন নানা পত্রিকার সাংবাদিক। কথা বলছেন তারা দুলাভাইয়ের সাথে। দুলাভাই জবানবন্দী দিচ্ছেন, খুব ভাল মেয়ে ছিল অপরাজিতা। তার আত্মহত্যার কোন কারণ নেই। তবু কেন এমন হল??? কেন চলে গেল অপরাজিতা?
কাঁদছেন দুলাভাই। মনমত কিংবা রহস্যজনক উত্তর নয়া পেয়ে মাথা চুলকাচ্চে সাংবাদিকরা।
সাদামাটা গল্পের আড়ালে হর হামেশাই পরাজিত হয় হাজার-শত অপরাজিতা। রহস্যের জাল খুলতে গিয়ে কোনদিন এই সাদামাটা গল্পের মূলভাব খুঁজে পায় না কেউ।
 
Top