গরুর মাংসের জনসংখ্যার ভারে ক্রমে জীর্ণ হয়ে আসছে পৃথিবীর আলেয়ান। কাপড়ের অজস্র ফুটো দিয়ে দৃশ্যমান অগণিত সমস্যা। সবচেয়ে বেশি নগ্ন হয়ে আছে খাদ্য ঘাটতি। জাতিসংঘ বলছে ২০৫০ সালের পর ৯০০ কোটি মানুষের খিদে কিছুতেই
মেটাতে পারবে না পৃথিবীর শস্যক্ষেত। তাই গবেষকদের পরামর্শ—বদলে ফেলুন রেসিপি। মেন্যুতে নিয়ে আসুন কীট, পতঙ্গ, শৈবাল
পোকার জন্য ২০০ পৃষ্ঠা
খাবার হিসেবে গরুর মাংসের বিকল্প হতে পারে ঘাসফড়িং। দুটোই আপনাকে একই ধরনের পুষ্টির জোগান দেবে। শুনে যাদের গা খানিকটা গুলিয়ে এসেছে তাদের জন্য খবরটা হলো, মেক্সিকোতে এই ঘাসফড়িং রীতিমতো একটা বিলাসী খাবার। টাকা থাকলেও দেখা যাবে জোগানের অভাবে খেতে পারছে না। অথচ আমাদের আশপাশে কত অবহেলায় পড়ে আছে এই সব কীটপতঙ্গ। পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার সময় ঘুণাক্ষরেও মনে হয় না যে এর পেছনেই হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের বাজারে গিয়ে দরকষাকষি করে ঘাম ঝরাতে হতে পারে। আর কেউ মনে না করুক, জাতিসংঘ এমনটাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। এ বছরের মে মাসে সংস্থাটির ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন ওরফে ফাও তাদের ২০০ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রতিবেদনে কিন্তু ফাও কথা বলেনি। বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষের প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় যেখানে ইতিমধ্যে পোকামাকড় আছে, সেখানে বাকিরাও খেতে শুরু করলে খাবার নিয়ে চিন্তাই করতে হবে না কাউকে। প্রতিবেদনের সার কথাটি হলো, বেশি করে পোকা খান, শস্যের ওপর চাপ কমান। আর ভবিষ্যতে খাদঘাটতির সঙ্গে লড়াইতে জিততে পোকামাকড়ের বিকল্প নেই।
পোকার পুষ্টিকথা
সবাইকে পোকা খেতে উত্সাহী করার পেছনে কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত, পোকার চাষ করতে গরু ছাগল বা মুরগির মতো খরচ নেই। আদতে এর চাষেরই দরকার নেই। এদের খাবার-পানি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না বলে শুষ্ক অঞ্চলেও পাওয়া যায় ভূরি ভূরি। অন্যদিকে পোকামাকড়ে যে পরিমাণ পুষ্টিগুণ রয়েছে তা আনুপাতিক বিচারে গরু-মুরগির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। হিসেবে দেখা গেল কিছু ক্ষেত্রে পোকাই বেশি পুষ্টিকর। ১০০ গ্রাম ঘাসফড়িংয়ের ভিতর প্রোটিন আছে ২০.৬ গ্রাম, ১০০ গ্রাম গরুতে আছে ২৭.৪ গ্রাম। আবার একশ গ্রাম ঘাসফড়িংয়ে ৩৫.২ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকলেও গরুতে তা এক ফোঁটাও নেই। এমনকি ঘাসফড়িংয়ে গরুর চেয়ে বেশি আয়রন আছে। ১০০ গ্রাম গরুর মাংসের চেয়ে ১০ গুণ বেশি আয়রন আছে দুটো রেশম মথে। রান্না করা ১০০ গ্রাম শুঁয়োপোকা আমাদের প্রতিদিনকার জিংক, আয়রন, থিয়ামিন ও কপারের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
সব পোকা বা কীটই যে খাওয়া যাবে তা নয়। এ পর্যন্ত খাবার হওয়ার যোগ্য পোকামাকড় পাওয়া গেছে ১৪শ প্রজাতির। আর রেসিপিটা যুত্সই হলে স্বাদের দিক দিয়ে কে কাকে ছাড়িয়ে যায় তা আঁচ করা কঠিন। অবশ্য ইদানীং লন্ডনেও যে হারে ঘাসফড়িং ফ্রাই খাওয়ার চল শুরু হয়েছে তাতে উত্তরটা পরিষ্কার। ঘাসফড়িং একা নয়। দলটা বেশ ভারি। তবে দেশভেদে একেক কীটের চাহিদা একেক রকম। আফ্রিকার দেশগুলোতে শুঁয়োপোকা আর পঙ্গপালের চাহিদা বেশি। জাপানে ভিমরুল খেতে হলে পকেট ভারি হওয়া আবশ্যক। আর থাইল্যান্ডে চাইলে ঝিঁঝিঁ পোকার স্যুপ অর্ডার করতে পারবেন।
পোকার বিপদ
আর বাকি সব প্রাণীর মতো পোকারাও অসুস্থ হতে পারে। কিন্তু তাদের জন্য নেই কোনো হাসপাতাল, নেই পোকার ডাক্তারও। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের কীটপতঙ্গের চাষ করা হলেও সেগুলোর ওপর নজর রাখা কষ্টসাধ্য। আবার কিছু বুনো প্রজাতির পোকামাকড় আছে যেগুলোর দেহে হয়তো ঘাপটি মেরে আছে কঠিন কোনো রোগের ভাইরাস। অবশ্য, এই পোকামাকড় যেখানে মুরগির ও শূকরের অন্যতম খাবারও, তাই এর খামার গড়ে তোলাটা এক দিক দিয়ে লাভজনক হবেই। তা ছাড়া ২০০ কোটি লোক যেখানে নিয়মিত নানা জাতের পোকা সাবাড় করে যাচ্ছে, সেখানে ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও বিশদ গবেষণা আশা করাই যায়।
টেস্টটিউব বার্গার
স্টেম সেল থেকে অঙ্গ তৈরির বিষয়টি এখন অতি সাধারণ ঘটনা। ব্যাপারটা অনেকটা ফটোকপি করার মতোই। একটি মাস্টার কোষ থেকে তৈরি হতে থাকে ওই ধরনের অজস্র কোষ। শুধু প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সরবরাহ করে দিলেই হলো। একইভাবে গরুর শরীর থেকে স্টেম সেল নিয়েও বানানো যায় গরুর মাংসের কোষ। এ খাবারটাকে সরাসরি অপ্রাকৃতিক তালিকায় ফেলে দেবেন অনেকে। তবে এটাও ঠিক যে কোনো কিছুই প্রকৃতির বাইরে নয়। তাছাড়া স্টেম সেল থেকে কোষ বৃদ্ধির ব্যাপারটা তো শতভাগ প্রাকৃতিক ঘটনা। পার্থক্য হলো, যে ঘটনাটা প্রাণীর শরীরের ভিতর প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে, হুবহু সেই ঘটনাই ঘটানো হচ্ছে ল্যাবরেটরিতে। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়ায় বানানো হয়েছে গরুর মাংসের বার্গার। একটি করে স্টেম সেল নিয়ে তৈরি হয়েছে সুতার মতো এক ফালি করে মাংস। আর একটি বার্গারের জন্য লেগেছে প্রায় তিন হাজার ফালি। খরচ শুনলে অবশ্য দমে যাবেন। গবেষণাগারে তৈরি একটি বার্গারের জন্য খরচ হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার পাউন্ড। অবশ্য এর পুরোটাই ব্যয় হয়েছে গবেষণার আগাগোড়ার নানান খুঁটিনাটি কাজে। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, একবার কারখানার মতো একটা কিছু দাঁড়িয়ে গেলে ভবিষ্যতে টেস্টটিউবে তৈরি মাংস সোজা চলে যাবে সুপারশপে।
শেষ আশ্রয়
ভবিষ্যতের খাবারের তালিকায় শৈবাল ও সামুদ্রিক লতাগুল্ম মোটামুটি নিচের দিকেই আছে। ভয়াবহ খাদ্য দুর্যোগ না হলে কেউ এটা খাওয়ার কথা হয়ত মাথাতেই আনবে না। অথচ এগুলোই পারবে ভবিষ্যতের যন্ত্র ও মানুষ দুটোকেই খাওয়াতে। সামুদ্রিক শৈবাল ও প্লাংকটনের মতো ক্ষুদ্র সবুজ প্রাণী থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। আবার সামুদ্রিক লতাগুল্ম প্রোটিনেরও বেশ ভালো উত্স। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এগুলোর বেড়ে উঠতে মিঠা পানির দরকার নেই। যুক্তরাজ্যে এখন থেকেই খাবারযোগ্য শৈবাল চাষে মনোযোগী হয়েছে গবেষকরা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সি-উইড তথা সামুদ্রিক লতাগুল্ম ফাউন্ডেশন। সমুদ্রে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির গুল্ম পাওয়া যায়। এরই মধ্যে ১৪৫টি প্রজাতি উঠে এসেছে খাবার টেবিলে। শেফিল্ডের হাললাম ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এরই মধ্যে এক প্রজাতির গুল্মকে লবণের বিকল্প হিসেবে রুটিতে ব্যবহার করার পন্থা আবিষ্কার করেছেন। লবণের মতো উচ্চ-রক্তচাপ বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াবে না এটা। এছাড়া খাবারযোগ্য আরও যে লতাগুল্ম আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে, সেগুলোতে মিলতে পারে আনকোরা কোনো স্বাদ। তাই বলা যায়, ভবিষ্যতের খাবারের তালিকা নিয়ে চিন্তার খুব একটা কারণ নেই। উল্টো একগাদা নতুন রসনার আস্বাদ পেতে অপেক্ষা করা যেতে পারে।
একনজরে
# বিশ্বে এখন ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৯২ কোটি ৫০ লাখ।
# ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে খাদ্যের চাহিদা বাড়বে ৩০ শতাংশ। বছরে চাহিদা বাড়ছে গড়ে ১.১ শতাংশ হারে।
# ২০৫০ সালের মধ্যে খাদ্যের উত্পাদন দ্বিগুণ বাড়াতে হবে। এ সময় শস্যের উত্পাদন ৯৪ কোটি টন বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টনে উন্নীত করতে হবে। মাংসের উত্পাদন ১৯ কোটি ৬০ লাখ টন থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৪৫ কোটি টন করতে হবে।

1 comments:

... বলেছেন... ২৪ জুলাই, ২০১৩ এ ১২:২৪ PM

daily Bartoman theke without permission e lekhata copy paste korlen keno? eta to thik na .. at least amar credit ta dite parten..
Faisal
dhrubonil@yahoo.com

 
Top