চোখের

অন্ধকার ঘরটাতে কারো ছায়া পড়ে না।পর্দার দুরন্তপনায় চোখটা তেতিয়ে উঠে।যেনো হুতোম পেচার মতো কতদিন গর্ত থেকে বেরিয়েছে।আকাশটায় তারাদের শুন্যতা আর যান্ত্রিক ফ্যানের বিষিত বাতাস শরীরটাকে উঠতে দেয় না।পা টাকে যেনে পাথার দিয়ে চাপা রেখেছে বাতাসটা।বিষাক্ত বাতাসের গন্ধটা এখনো যায় নি ফরহাদের নাকের থেকে।সেটাকেই চরমভাবে উপভোগ করছে সে।
অনেক কষ্টের পর বাতাসের সেই পাথর থেকে নিজেকে মুক্ত করে বারান্দায় এসে দাড়ালো ফরহাদ।কালো আকাশে আবছা আবছা সাদা মেঘ আর মেঘের ফাকে চুপটি করে ঘাপটি মেরে আছে তারারা।দূরে মোবাইল টাওয়ারের ছোট্ট ছোট্ট লাল লাইট সংখ্যালঘু তারাদের সাথে সমানতালে লড়ছে।দূরে লাইটিং দেখা যাচ্ছে ।হয়তো কারো বিয়ে।দুজন মানুষের স্বপ্নের বাসরের উছিলায় কত মানুষের আনন্দ উপভোগ! সবার আনন্দের ধারাটাকে নিজেদের করে নেয়।কিন্তু কি অদ্ভূত যে কষ্টের সাগরগুলো থেকে কেউ এক আজলা জল ও নেয় না।বড়ই অদ্ভূত এ নিয়ম।ফ্যাসিবাদী সমাজের অদ্ভূত নিয়ম।কষ্টের নাবিকদের একাই পাড়ি দিতে বিপদশঙ্কুল পথ।কেউ তাদের পাশে এসে দাড়ায় না।দাড়াবেই বা কেনো? আকাশ থেকে যদি বৃষ্টি এসে শরীরে পড়ে তাহলে পথ ভেঙে ঝর্ণার জলে স্নান করার কি দরকার?

বড় স্বপ্ন ছিলো ফাহাদের।প্রিয়তীর সাথে একসাথে জোছনায় ভিজবে ,বাবা মার স্বপ্নের সেই এক চিলতে আর্থিক স্বাচ্ছলতা আর নিজের কল্পনাগুলোর জীবনের প্রেক্ষাপটে চিত্রায়ন।আর কিছুই না।
কিছুই হয় নি পূরণ।রুপালী চাঁদের কোলে কাউকে ভেবে কাদতে হয়।কল্পনাগুলো দূরে চলে গেছে আর স্বপ্নগুলো চুরি হয়ে গেছে।বরংচ জীবনের শেষ দিনগুলো গুণছে ফরহাদ।এতটুকুই ছিলো পাওয়ার।কষ্ট আর কষ্ট।
একটা সময় ছিলো তার প্রিয়তীর শরীর ছোয়া বাতাসের স্পর্শে শিহরিত হতে পাগলের মতো কতো রাত কাটিয়েছে রাস্তায় কিংবা কলেজের ঐ সরু পথটায়।একবারো ফিরে তাকাতো না সে।
নষ্ট হয়ে গেছে ফরহাদ।এখন পাগলের মতো সিগারেট টেনে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে থাকে।খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলো যেই সময়গুলো কেটেছে তার মুগ্ধতায়।রঙিন স্বপ্ন দেখতো তাকে নিয়ে।এখন স্বপ্নগুলো চুরি হয়ে গেছে।
ভেতরটা ভেঙে গেছে অনেক আগেই।ফুসফুসটা ক্ষতে ক্ষতে ভরে গেছে।বাচবে না বেশী দিন।সাথে আরো দুই জটিল রোগ লিভারে।এখন রক্তবমি করতে করতে তার গলাটাও বিরক্ত।এখন নিজের বমি করা রক্ত হাতে নিয়ে বোতলে জমা রেখেছে।প্রিয়তীর গায়ে হলুদে আলতা হিসেবে গিফট করবে।নিজের রক্তে রন্জিত হবে তার প্রিয় মানুষটার পা।এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি আছে?

বাসা থেকে বের হয়ে হাটতে গেলো ফরহাদ।রাস্তায় দুইটা কুকুরকে শুয়ে থাকতে দেখলো।ইচ্ছে ছিলো তাদের সাথে কথা বলার।কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব।হযরত সোলাইমান (রাঃ) নাকি পশুপাখিদের ভাষা বুজতে পারতেন।সেই ক্ষমতাটা যদি ফরহাদ পেতো তাহলে মন্দ হতো না।সমাজের মানুষগুলো তার কষ্ট বুঝে না।অন্তত পশুপাখি গুলো তার মনের অনুভূতিকে।
পকেটটা খালি।সিগারেট কেনার টাকাটা নেই ফরহাদের কাছে।নদীর পাড়ে বসে বসে চাঁদটাকে দেখছে।চিকন চাঁদটার কোলে ভিজতে ইচ্ছে করছে ফাহাদের।সামনে কচুরিপানার চর আর টলটল করার নদীর পানি।ওপাড়ের মসজিদের টিউব লাইটটার আলোতে জ্বলগুলো ভয়ংকর বিধ্বংসী লাগছে।হঠাত্‍ করে ফরহাদের চোখের জল টলটল করে তার চোখ থেকে তার হাতে পড়ছে।কতদিন পর সে কাদতে পেরেছে।নদীর তীরে প্রচুর বাতাসে তার চোখ ও মুখটা কাপছে।সাথে জলগুলো চোখ আকড়ে ধরে পড়ে আছে।মাথা ঘুরাচ্ছে ফাহাদের।দূরে লাইটার জাহাজের আলোটা নদীর জলে ঠিকরে পড়ছে।চোখটা ছল ছল করে জলগুলো গড়িয়ে পড়ছে।চাঁদটা ডুবে যাচ্ছে আধারে।হয়তো ফাহাদের কষ্টগুলো সহ্য করতে পারছেনা চাঁদটা নাকি এই সমাজের কীটটাকে পছন্দ হচ্ছে না চাঁদটার?

মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়।ফরহাদ ও তারা হয়ে যাবে।তাকে কেউ দেখিয়ে বলবে ঐ দেখো পচা তারাটা।হয়তো প্রিয়তীর শিরায় জন্ম নেওয়া পরীটাকে সে ফরহাদকে দেখিয়ে বলবে "Twinkle twinkle little star, how i wonder what you are." সেদিনের অপেক্ষায় আছে ফরহাদ যেদিন তার প্রিয়তী জোছনায় ভিজবে কাউকে সাথে নিয়ে আর দূর আকাশের তারা হয়ে তা দেখবে ফরহাদ।
কত শত ভাবনার ফাকে চাঁদটাই ডুবে গেলো চাঁদটা।নিঃসঙ্গ আকাশটা কেদে উঠলো।সাথে ফরহাদ।এক তরফা ভালোবাসাগুলো থাকে নিষ্পাপ এবং কলংকমুক্ত।হেডফোনো গান বাজছে --
"খোলা জানালা, দক্ষিণের বাতাসে ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে। তখন তুমি, এসে হেসে বলে দাও আছি তোমার পাশে।
বহুদূর পথ ভীষণ আকা বাকা, চলতে ভীষণ ভয়। তুমি এসে বলে দাও , আছি আমি পাশে, করোনা কিছুতেই ভয়।
কখনো বুঝিনি চলে যাবে তুমি, আমাকে এভাবে কাদিয়ে। কখনো বুঝিনি ফিরে আসবে না , আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।"

দীর্ঘশ্বাসগুলো বাড়তে থাকে আর ভারী হতে থাকে।ভারী হতে হতে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।চোখের বৃষ্টি নয়তো আকাশের বৃষ্টিতে।বেনামী পরিচয়হীন অনুভূতিগুলো বিশাল আকাশটায় হারিয়ে যায়।ভোরশেষে পাখির ডাকে তাদের মৃত্যু।অনুভূতিরা মরে না আর ভালোবাসারা পথ হারায় না।সময়ের কোলে তা একদিন পরিপূর্ণতা পায় ওপারের দুনিয়ায়।সেই অপেক্ষায় ফরহাদ....... সেই অপেক্ষায় আরো হাজারো ফরহাদ...
 
Top