একদিন ফিরে আসবে

-আর হচ্ছে না সায়ন্তী।তোমার স্বপ্ন আমার স্বপ্নের সাথে আর মিলছে না।আমি কেন যেন আর তোমার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না।
-ও,আচ্ছা!তো,কি করতে চাও?
-তুমি অনেক ম্যাচিউরড মেয়ে,তোমাকে কি আমার বুঝিয়ে দিতে হবে?
-না,আমি বুঝেছি রাশেদ।আমি গত তিন বছর ধরেই আসলে বুঝে বুঝে চলছি।ঠিকাছে,আমি আর তোমার ব্যাপারে ইণ্টারফেয়ার করব না,তুমি তোমার মত থাকবে।আমি আসি তাহলে।
আমি উঠে চলে আসলাম।রাশেদ ডাকছিল,আমি গাড়িতে বসলাম। ওর ডাক শুনে পিছনে তাকানোর দিন আমার আজ থেকে ফুরিয়ে গেল।ওর স্বপ্নের সাথে আমার স্বপ্ন আর মেলে না।আমার ঠোঁটের কোনায় একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল।কি সহজ কথা! ছয় বছর থেকে চেনা একটা মানুষ এত সহজে সব মুছে দিতে পারে?পারে,রাশেদ পারে।আজকে যেমন পারল।ঠিক তিন বছর আগে যেভাবে পেরেছিল।
রাশেদ আমার এক বছরের সিনিয়র।আমাদের একই স্কুল-কলেজ। ক্লাস টেনে থাকতে হঠাত করে প্রিয়ন্তি একদিন বলল, "তোকে রাশেদ ভাইয়া অনেক পছন্দ করে" আমি অবাক।আমার তখন এসব ব্যাপার মাথায় ঢোকে না।আমি খুব সিরিয়াস টাইপ ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া অন্য কিছু আমার মাথায় থাকে না।প্রিয়ন্তির কথা মাথাতেই নিলাম না।কিন্তু খেয়াল করলাম কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের রাশেদ ভাইয়া ইদানিং আমাকে খুব ফলো করে। প্রাইভেট থেকে শুরু করে ক্লাসের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকে।কিন্তু রাশেদ খুব প্র্যাক্টিকাল ছেলে।আমাকে কিছু বলে নি কখনো,শুধু ওই দেখা পর্যন্তই। যেদিন এস. এস. সি রেজাল্ট দিল ওইদিন রাশেদ আমাকে বলল ও আমাকে পছন্দ করে। আমি খুব তাল-মাতাল ছিলাম তখন,কি করব না করব বুঝতে পারছিলাম না।কিন্তু ওকে খুব কড়া ভাষায় কিছু কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।এসব প্রেম-ভালবাসার মত ব্যাপারে সময় নষ্ট করার সময় তখন আমার হাতে নেই।কলেজে অনেক পড়া,সময় খুব কম।ক্যারিয়ার গড়ার ভিত্তি হল ইণ্টার লেভেল।কিন্তু সেকেন্ড ইয়ার পড়া রাশেদ খুব মরিয়া হয়ে বারবার আমাকে তার ভাল লাগার কথা বলত। একদিন আমাকে ফোন করে একটা কবিতা শোনাল-

"এই মেয়ে নৌকা হবি?
নদী দেব তোকে
এপার দেব,
ওপার দেব,
সাঁতার দেব,
ডুববিনা তুই ডুববিনা"

না,ওর মুখে এসব শুনে আমার ন্যাকামি মনে হত,খুব বিরক্ত লাগত।ফোন কেটে দিতাম।কখনো বা গান শোনাত।আমার কিছু ভাল লাগত না।ওকে দেখলেই রাগ লাগত।এক বছর পর যেদিন ওদের এইচ. এস. সি রেজাল্ট দিল সেদিন আমাকে বলেছিল, "তোমাকে আর রাগাব না,বিরক্ত ও করব না,এই শেষ দেখা তোমার সাথে আমার,ভাল থেকো অনেক অনেক।"
এই কথা গুলো বলে রাশেদ চলে গেল।আমিও ভাবলাম "যাক,বাবা!বাঁচা গেল!" কিন্তু,আমি কি বোকা !বাঁচলাম না মরে গেলাম বুঝতে পারলাম কিছুদিন পরই।আমি রাশেদকে মিস করতাম।ওর না থাকা আমাকে কষ্ট দিত।ভুলতে পারতাম না ওকে।নিজেকে জঘন্য লাগত।ভালবাসা পায়ে ঠেলার মত পাপ করেছিলাম তাই কষ্ট পেতাম।প্রতি মুহূর্তে রাশেদকে মিস করতাম কিন্তু ওকে মুখ ফুটে বলতে লজ্জা পেতাম।আমার পড়ালেখা সব শিকেয় উঠেছিল। রাশেদের কোন খবরই কেউ জানত না।আমি পাগলীর মত ছিলাম।কোচিং শুরু করার পর উদ্ভাসে ম্যাথ পড়াতে আসল যে ভাইয়া তাকে দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম আনন্দে।রাশেদ।বুয়েটে সিভিলে পড়ে।ও আমাকে চিনতে পারার কোন লক্ষণই দেখায় নি।আমি আর পারি নি।একটা বছর যে কষ্ট পেয়েছি সারা জীবন আমি সে কষ্ট পেতে চাই নি।রাশেদকে আমি পেয়েছিলাম।যে আমি পড়ালেখা ছাড়া কিছু বুঝতাম না তাকে রাশেদ বৃষ্টিতে রিক্সার হুড খুলে ভেজার আনন্দ শিখিয়েছে,পহেলা বৈশাখে রেশমি চুড়ি কেনার জন্য বায়না করতে শিখিয়েছে,রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ,মহাদেব সাহা,শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে শিখিয়েছে,ভালবাসার মত পবিত্র অনুভুতি অনুভব করতে রাশেদ ই আমাকে শিখিয়েছে।
কিন্তু সেই রাশেদ আজ বড় বেশি যান্ত্রিক।সব কিছুই এখন তার মাপা-মাপা।আমাকে পাল্টিয়ে দিয়ে ও নিজে এখন পাল্টে গেছে।আমার সব কিছু ওর এখন ন্যাকামি লাগে।শুধু বলে ,"গ্রো আপ সায়ন্তী।আহ্লাদ করোনা।" আমার কোন চাওয়াই ওর কাছে এখন আহ্লাদ।তাই আমার স্বপ্ন আর ওর স্বপ্ন এখন মেলে না ।ও এখন বিরক্ত আমার উপর,খুব বিরক্ত।তাই আজ সব চুকিয়ে দিল।বৃষ্টি পড়ছে মুষুলধারে।ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে গাড়ি থেকে নামলাম।বৃষ্টির পানি আমার চোখের পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।আমি কল্পনা করছি রাশেদ আমার হাত ধরে আমার সাথে ভিজছে।কোন একদিন হয়তো রাশেদ এসে আমাকে বলবে," সায়ন্তী,আমার স্বপ্ন তোমার স্বপ্ন আবার এক হয়ে গেছে,আমি ক্লান্ত এখন,আমার হাত ধর। " ও ফিরবে।আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকব তখন আমি ওকে শোনাব

" মনে আছে একবার বৃষ্টি নেমেছিল?
সেদিন বৃষ্টিতে কিছু আসে যায়নি আমাদের
কেননা সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়েছিল
সারাদিন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে
আমাদের পাশাপাশি শুয়ে থাকতে হয়েছিল সারাদিন।
আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়তে হয়েছিল !" "
 
Top