জাহিদ কখনোই শব্দ না করে পানি খেতে পারেনা। এখনো সে নাস্তার টেবিলে বসে বিকট ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে পানি খাচ্ছে। শারমিন ওর দিকে কঠিন চোখ করে তাকিয়ে আছে। জাহিদ পানির গ্লাস হাতে নিলেই শারমিনের সেদিকে চোখ আটকে যায়। প্রথমে সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। এরপর প্রতিটি শব্দের তালে তালে তার চোখ একটু একটু করে কোঁচকাতে থাকে। মাঝেমাঝে শারমিনের ইচ্ছে হয় নিজের পানির গ্লাসটা ওর মুখে ছুঁড়ে মারতে। তার বদলে তাকে হেসে কথা বলতে হয়, প্লেটে নাস্তা তুলে দিতে হয়।
জাহিদকে কোনোকালেই পছন্দ ছিল না শারমিনের। তবু নিম্ন-মধ্যবিত্ত পিতার বোঝা কমাতে এই
valobasa, loveমাঝবয়েসী লোকটাকে বিয়ে না করে উপায় ছিল না ওর। তাও নিজের সাথে আপোস করে হলেও সে মোটামুটি সবটাই মানিয়ে নিয়েছে এই সংসারে, শুধু ওই আওয়াজটা ছাড়া। এটা তার কিছুতেই সহ্য হয় না। ওর মনে পড়ে নিজের বিয়ের জমকালো রিসেপশনের কথা। অনেক বড় পার্টি দিয়েছিল জাহিদ। শারমিনের মন খারাপ ছিল ঠিকই, তবু মৃদু সুরে বাজতে থাকা প্লেয়ারে ওর পছন্দের কয়েকটা গান শুনে অনেকটা ধাতস্হ হয়ে এসেছিল সে। কিন্তু, খাওয়া দাওয়ার পরে যখন জাহিদের ওই বিকট ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে পানি গেলা শুরু হল শারমিন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শুধু ওই বা কেন, পুরো অনুষ্ঠানের বেশির ভাগ লোকই তখন তাকিয়েছিলো জাহিদের দিকে। অবশ্য শারমিনের মত বিরক্তি নিয়ে নয়। বাচ্চারা সার্কাস বা চিড়িয়াখানা দেখে যেমন সকৌতুক জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়, ঠিক তেমন করে। শারমিনের সেদিন লজ্জায় ইচ্ছে হয়েছিল মাটিতে মিশে যেতে। শুধু এক জাহিদই ছিল নির্বিকার, সে যেন অনেক উপভোগ করে করে অনন্তকাল ধরে বিকট শব্দে পানিই গিলছিল শুধু। যেন এই পৃথিবীতে সে আর এই পানি ছাড়া আর কিছুরই কোন অস্তিত্ব নেই।
সম্বিত ফিরতেই শারমিন টের পেল এরইমধ্যে জাহিদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।

পাশের বাড়ির আন্টিটা দেখতে অনেক সুন্দর, শাহিন ভাবে। ওর আম্মুও দেখতে সুন্দর, তবে আন্টি আরও বেশি সুন্দর। প্রতিদিন আন্টি বারান্দায় এসে দাঁড়াবে সেজন্যে শাহিন অপেক্ষায় থাকে। আন্টিকে দেখতে ভাল লাগে তার। আন্টি ওর মা হলে ভালই হত। ফুলদানিটা শক্ত কিনা পরীক্ষা করার জন্য একটু আগে শাহিন সেটা টেবিলের ওপর থেকে ফেলেছে। তাতেই সেটা ভেঙ্গে চুরচুর। অমনি আম্মু দৌড়ে এসে কান টেনে দিয়েছে। গতকাল আব্বু আম্মুকে বলছিল নুতন প্যান্টটা বেশ অনেকটা বড় হয়েছে। টেইলারের কাছে নিতে হবে।তাই শাহিন নিজ দায়িত্বে মায়ের ড্রয়ার থেকে কাঁচি জোগাড় করে সেটা কেটে ছোট করে দিয়েছে। সে দেখে আম্মু কেনই বা রাগল আর কেনই বা এতগুলো বকা দিল কিছুতেই ঢোকে না শাহিনের মাথায়।
সে মাথা নেড়ে ভাবে আন্টিই আম্মু হলে বেশ হত। আন্টি নিশ্চয়ই আম্মুর মত সবকিছুতে বকাবকি করত না। বা বকা দিলেও সেগুলোও নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হত। সুন্দর মানুষের সবকিছুই সুন্দর হয়। আন্টির সুন্দর বকাতে শাহিনের একদমই মন খারাপ হতনা। ভাবতে ভাবতেই আন্টিকে দেখতে পেল শাহিন। একটা মগ হাতে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। ওর মন ভালো হয়ে গেল। সে হাসিহাসি মুখ করে আন্টির দিকে তাকিয়ে মাথা দুলাতে লাগল বাবার রকিং চেয়ারটাতে দুলে দুলে।

আন্টির বোধহয় আজ মন খারাপ। আজ একবারও শাহিনের দিকে তাকিয়ে হাসল না! প্রতিদিন আন্টি ওর দিকে তাকিয়ে হাসে, হাত নাড়ে। শাহিন তবু হাসিমুখে চেয়ে থাকে, যদি আন্টি তাকায়! হঠাৎ কি হল ও ঠিক বুঝল না, তবে দেখল আন্টি হাতের মগটা রাস্তায় ছুঁড়ে দিল। মগটা নিচে পড়ে ভেঙ্গে গেল ফুলদানিটার মতই। শাহিনের হাসি পেল। আম্মু এটা দেখলে আন্টিকেও কান টেনে দিত। আন্টি ওর আম্মু হলে অনেক ভাল হত। ওরা দুজনে মিলে সবকিছু বারান্দা থেকে ফেলে দিত। কেউ কিছু বলত না ওদের। শাহিনের খুব ইচ্ছে করে আন্টিকে একবার আম্মু ডাকতে। সে হাসিমুখে হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে- আমমমমু !!
জাহিদ চলে গেলে শারমিন প্রায়ই বারান্দায় গিয়ে বসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলনা। সে কফির মগ হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। জাহিদ যাওয়ার পর পুরো ঘরটাই শূন্য শূন্য হয়ে যায়। ওর একা একাই কাটাতে হয় পুরোটা দিন। জাহিদ বেশ একটু আনমনা খামখেয়ালী প্রকৃতির। এইসব একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা সে এসব কিছুই বোঝেনা। শারমিনও ওকে বোঝাতে যায়না। ধীরে ধীরে সম্পর্কটা যান্ত্রিক হচ্ছে ক্রমশঃ। আগে কান্না আসত শারমিনের। এখন অনেকদিন ধরে সেটাও কমে গেছে। শুধু মাঝেমধ্যে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে বুক থেকে।

ওদের ছয়তলার বারান্দা থেকে শহরটার অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। শারমিন আনমনে সেদিকে চেয়ে কফিতে চুমুক দেয়। কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা কফি খেতে ইচ্ছে হয়না ওর। মগটা কাত করে কফিটুকু বারান্দা দিয়ে ফেলে দেয় ও। সামনের ইলেকট্রিকের তারে একটা কাক বসে আছে। সেটা কা কা করে দুবার চেঁচিয়ে ওঠে। কিছু একটা করার জন্য হাতটা নিশপিশ করছে শারমিনের। ভেতরটা ক্রমেই অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা মগটা ফেলে দিলে কি হয়? ভাবতেই ও মগটা ছেড়ে দিল। ওটা ঘুরতে ঘুরতে নিচে নেমে গেল। নিচ থেকে আসা কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজটা ভালই লাগে শারমিনের। আচ্ছা ও নিজেও মগটার মত যদি নিচে পড়ে যায়? এভাবেই কি ভেঙ্গে যাবেও নিজেও? সব দুঃখ, অভিমান জমানো আবেগ সব গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে? ওর বেশ ইচ্ছে হয় লাফিয়ে পড়ার। শারমিন চোখ বন্ধ করে করে মনে মনে প্রস্তুত হয়। ঠিক তখনই ও শুনতে পায় কেউ চিৎকার করছে- আমমমমু !!
সম্বিত ফিরে পায় শারমিন।

এতদিনের অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে ও। বুঝে গেছে কার জন্য ওকে বাঁচতে হবে। জাহিদকে বলতে হবে কয়েকটা বাচ্চার ছবি আনার জন্য। দেয়ালে টাঙাতে হবে। পাশের বারান্দার পিচ্চি ছেলেটার আম্মু ওকে পানি এনে দিয়েছে। শারমিন অবাক হয়ে খেয়াল করল ছেলেটাও শব্দ করে পানি খাচ্ছে।
তবে সে এটা খেয়াল করল না যে, এতদিনের অসহনীয় ব্যাপারটা এবার তার খুব একটা খারাপও লাগল না।
 
Top