স্মৃতিগুলো এতটাই মধুর যে, তার হৃদয়কুটিরে মুহূর্তের মধ্যে চরম বাস্তবতার ন্যয় উকি দিল। সে যে শহরে অবস্থানরত, তাও যেন তার মনের ধারে নেই। তাই ভাবনার অন্তরালে তার গ্রামের স্মৃতিবিজড়িত সেই পুকুর পাড়ের স্বচ্ছ ঘাসের ওপর বসার জন্যে জায়গা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। যে পুকুর পাড়ে বসে থেকেই একদিন সে লিখা শুরু করেছিল ছড়া-কবিতা। কিন্তু ভাবনাভরা চোখের সামনে শহুরে দালান-কোঠা আর কর্ণকুহরে হরেক রকম যানবাহনের শব্দের উপস্থিতি টের পেয়ে আচমকা বোধ ফিরে পেল সে। একি! কোথা হতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম? মনের অজান্তে তার ঠোঁট থেকে এমন কথা বেরিয়ে এল। এবার দু’চোখের দৃষ্টি আকাশপানে ছড়িয়ে দিল। হাজার তারার মাঝে মায়াবিনীর মতো উকি মেরে থাকা চাঁদকে দেখে সে ভুলই করে বসল। ভাবল, এ চাঁদ বুঝি এতদিন কোথাও লুকায়িত ছিল।
আসলে এমনটি ভাবলে কী হবে? বাস্তব যে তা নয়। চাঁদ মায়াবীরূপে মর্তবুকে যতই অপলক দৃষ্টিসঞ্চালন করুক, শহরবাসীরা তা প্রতিনিয়তই উপেক্ষা করে। কারণ; সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর তারা যখন ঘরে ফিরে, তখন শারীরিক-মানসিক ক্লান্তি দুর করার লক্ষে তাদের বিছানায় যাওয়া ছাড়া যে কোনো উপায় থাকে না। আর দিপুওতো কিছুকাল পূর্বে শহুরে জনতার তালিকায় নিজের নামখানি লিখিয়ে নিয়েছে। হয়তো তাই মনের অজান্তে এতদিন সেও চাঁদের রূপকে উপেক্ষা করেছে।
অবশ্য দিপু চাঁদের রূপকে উপেক্ষা করেছে- এ কথা কতটুকু সত্য তা নির্ণয় করাও কঠিন ব্যাপার। কারণ; তার বেলায় মায়াবী চাঁদের রূপকে উপেক্ষা করার বিষয়টা স্বীকার করা হলে, তা হবে মস্তবড় ভুল। অস্বীকার করাটাও হবে বোকামি। তবে স্বীকার বা অস্বীকার যেটাই হোক, বিধাতার সৃষ্টিশীল ডাইরী ঘাটাঘাটি করেন এমন প্রত্নতাত্ত্বিকের সাহায্য নিলেই এ কথার সত্যতা পাওয়া সম্ভব। কারণ; পৃথিবী সৃষ্টির পূর্ব থেকে এ পর্যন্ত কোনো ঘটনা সে ডাইরীতে লিপিবদ্ধ না হয়ে পারেনি। তাই সে ডাইরীই পারবে দিপু সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে।
তাছাড়া এখন আচমকা ঐ চাঁদের দেখা পাবার পর দিপুর মানসিক অবস্থার যে রূপ উপলব্ধি করা গেল, তা থেকেই প্রতিয়মান হয়- সে প্রকৃতপে চাঁদের রূপকে উপেক্ষা করার মতো নয়। এমনই অবাক ভঙ্গিতে চন্দ্রপানে দৃষ্টিসঞ্চালন করতে লাগল, মনে হলো যেন বহুকাল পর হারিয়ে যাওয়া কোনো আপনজনেরই সন্ধান পেল।
আপনজন নয় তো কী? গ্রামে থাকাকালে চাঁদের জোছনা ঝরে পড়া এমন কোনো রাত কাটেনি, যে রাতে দিপু জোছনায় না গিয়ে ঘরে চুপটি মেরে ঘুমিয়ে থেকেছিল। অথচ ভাগ্যের চাকা ঘুরে জীবন এমন এক প্রান্তে এসে আজ নোঙর ফেলেছে, যে প্রান্তে হারানো দিনগুলো হৃদয়কুটিরে উকি দিলে নীরবে অশ্রুবিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কিছুই তার করার থাকে না। তবু তার মনে হয় এখানেই যেন সব সুখ।
আসলে দিপুর হৃদয়পটে কষ্টের প্রহরগুলো যখন ভিড় জমায়, তখন তার দু’চোখের জলে ভেসে ভেসে কোথা হতে যেন সুখের আগমন ঘটে। সেই সুখের মাঝে তার মনে পড়ে যায়- শৈশবের কথা, ছাত্রজীবনের কথা, জীবনের খন্ড খন্ড স্মৃতি আর হাজারো স্বপ্নের কথা। একে একে সব কথা যখন আবার মন থেকে দুরে সরে যায়, তখন বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেই সব সুখ দুর হয়ে যায়। মনে আবার সেই ব্যস্ততা চলে আসে। শহুরে ব্যস্ততা, কর্মের ব্যস্ততা, জীবন বাঁচানোর তাগিদে কিছু একটা করার ব্যস্ততা।
চাঁদপুর জেলা শহরের মাইল কয়েক দুরে সবুজছায়ায় ঘেরা রালদিয়া গ্রামে দিপুর বাড়ি। শহরে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে সে। ছুটি দু’একদিন পেলেও বাড়ি যাবার ইচ্ছেটা তার মধ্যে দেখা যায় না। আজকাল কেউ তাকে বাড়ি যাবার কথা বললেও সে বিরক্ত বোধ করে। আর দু’এক ফোটা অশ্রু ছেড়ে দিয়ে মাঝে মাঝে নীরবতার সাগরে ঝাপ দেয়। সফি নামে তার এক শহুরে বন্ধু আছে, যে প্রায়ই তার নীরবতার মাঝে ফাটল ধরায়।
আজও এর ব্যতিক্রম ঘটল না। সন্ধ্যার পর কিছুটা সময় পার হয়ে গেলেই মাঠে সফির আগমন লক্ষ করা গেল। দুর থেকে দেখে সে নিঃশব্দে দিপুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু দিপু সফিকে দেখতে পেল না। তার চোখ দু'টো বন্ধ। বসে বসে ঘুমিয়ে আছে কিনা, তা নিয়ে সফি ভাবনায় পড়ল। পরক্ষণে ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে সে খোঁচা দিলেই দিপু চোখ খুলল। অবাক হয়ে বলল, ‘একি, তুমি কখন এলে?’
‘এই মাত্র। তা একা একা কী করছ?’
‘কই, কিছুই করছি না।’
‘তা না হলে কি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলে?’
‘স্বপ্ন দেখলেতো সময়টা ভালোই কাটত। মনে সুখপাখি আসার চাঞ্চ পেত না।’
কথাটা বোধগম্য হলো না সফির। বলল, ‘সুখপাখি মানে?’
‘তা তুমি বুঝবে না। যেদিন সুখপাখি তোমার মনে বাসা বাঁধবে, সেদিন বুঝবে।’
সফি আর কিছু বলল না। কষ্ট কীভাবে কারো মনের সুখপাখি হতে পারে? তা নিয়ে সে ভাবনায় পড়ল। দিপুও কিছু না বলে দুর গগনের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। তারপর চোখের জল ছেড়ে দিয়ে তার জয় করা সুখপাখিকে ভাবতে ভাবতে নীরবতার গভীরে লুকিয়ে গেল।
কেন এত নীরবতা? কেন এত বিষণ্নতা? না বললে তা চিরকালই গোপন থেকে যাবে। তাই বলে দিতে হলো।
বছর চারেক আগের কথা। দিপু শিক্ষাজীবনের দ্বিতীয় ধাপ পাড়ি দিয়ে তৃতীয় ধাপের প্রথম সিঁড়িতে পা দিয়েছিল মাত্র। তার কিছুদিন পরই বন্ধুদের সাথে একদিন মেঘনাপাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল সে। পথে দেখা হয়েছিল অচিনপুরের এক অবুঝপাখির সাথে। দুষ্টুমির ছলে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা পর্যন্তই সেদিনের ঘটনা ইতি।
মজার ঘটনা ঘটল তার মাসখানেক পর। কলেজে যাবার সময় একদিন যখন দিপুর নজরে পড়ল সেই অবুঝপাখিটা একদল পাখির সাথে স্কুলের দিকে যাচ্ছে, তখন পূর্বের দুষ্টুমির কথাটা তার মনে পড়ে গেল। তাই সে তার পিছু পিছু হাটতে লাগল। অবুঝপাখিটাও দিপুর মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করে মুচকি হাসি দিয়ে দলের ভেতরে ঢুকে গেল। এ হাসিতে দিপুর হৃদয় উতলা হয়ে উঠল। জোর চেষ্টা চালাতে লাগল তার সাথে একটু কথা বলার জন্যে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও ব্যর্থ হলো সে।
এ ব্যর্থতার জ্বালা বুকে নিয়ে দিপুর আরো কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিতে হলো। এর মধ্যে গ্রীষ্মকালিন ছুটির ঘণ্টা বাজলে তার চলার গতিও কমে গেল। কারণ; প্রায় এক মাস স্কুল-কলেজ বন্ধ। বন্ধের মাঝে অবুঝপাখির দেখা না পেলে যে দিবস-রজনী সব এক হয়ে যাবে।
অবশ্য হয়েছেও তাই। অবুঝপাখির দেখা না পেয়ে দিপুর মনের দুয়ারে সারাক্ষণ শুধু ভাবনা ঘুরপাক খায়। আহারে রুচি থাকে না, পড়ালেখায় মন বসে না, নিঝুঁম রাতেও চোখে ঘুম আসে না। তার সমস্ত শিরা-উপশিরায় যেন অবুঝপাখিটা বিচরণ করতে লাগল। অবশেষে দিনকয়েক সে ছটফট করে কাটিয়ে দেয়ার পর ধৈর্যহারা হয়ে একদিন অবুঝপাখির দেখা পেতে ছুটে গেল সেই মেঘনার পাড়ে। তাতেও কাজ হলো না। দিনের পর দিন গেলেও সন্ধান পেল না অবুঝপাখির। একি হলো খোদা? আমার শান্ত ধারার জীবন কোথায় হারিয়ে গেল? মনে মনে একথা বলে দিপু একদিন নীরব হয়ে গেল।
দিপুর এ নীরবতা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ছুটির প্রহর শেষ হলে একদিন পথের প্রান্তরে পুনরায় মায়াবী চাঁদের মতো তার দৃষ্টিসীমায় উকি দিল ঐ অবুঝপাখি। সেদিন অবশ্য সাথে কেউ ছিল না। তাই তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারা দিপুর ভাগ্যে জুটল। কিন্তু নামটি আর জানা হলো না তার। শতবার চানতে চাইলেও সে বলতে রাজি হয়নি। তবু একটুখানি কথা বলতে পারায় অবুঝপাখিকে নিয়ে দিপুর মনবাগিচায় সুখের একটি কলি ধরল। সেই কলিতে ফুল ফুটাবার যুদ্ধেও লিপ্ত হলো সে। কারণ; প্রতিদিন কলেজে আসা-যাওয়ার সময় অন্তত একবার দেখা না হলে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
দিন যায় দিন আসে। কিন্তু দিপুর মনবাগিচায় ধরা কলিটাতে ফুটাবার সুযোগ আসে না। তবে প্রতি দিন একটি গাঁয়ের একটি বাঁকাপথের ধারে অবুঝপাখিকে দেখার সুযোগ প্রতিদিনই আসে। এতেই কিছুটা খুশিখুশি ভাবে তার দিন কাটতে থাকে। ঐদিকে তার পড়ালেখা যে দিন দিন গোল্লায় যাচ্ছে, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। খেয়াল শুধু অবুঝপাখি। কারণ; পথে-প্রান্তরে দেখা হলে অবুঝপাখি তার দিকে দৃষ্টি ফেলে মিষ্টি হাসির যে সুভাস ছড়ায়, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত ভালোবাসার ছন্দ বাজতে থাকে তার ভাবনার অন্তরালে। তাই একদিন বিকেলে কলেজ থেকে এসে ডায়রী আর কলম হাতে নিয়ে সে চলে গেল পুকুর পাড়ে। স্বচ্ছ ঘাসের পরে বসে অবুঝপাখির জন্যে কবিতার ছন্দে লিখতে লাগল-
তুমি অবুঝপাখি আসবে কী হায়
আমার শূণ্য নীড়ে?
দু’চোখ ভরে দেখতে তোমায়
চাই যে ফিরে ফিরে।
তোমার মিষ্টি ঠোঁটের হাসি দেখে
মনটা উদাস হয়,
হৃদয়ে তোমায় নিলাম এঁকে
করব এবার জয়।
হায়! অবুঝ তুমি তাই জানো না
ভালোবাসার মানে,
বলব তোমায় শুনবে কিনা
একটু কানে কানে।
ওগো অবুঝপাখি তুমি ছাড়া
বুকটা বড় শূণ্য,
খাঁচায় আমার আসতে যদি
জীবন হতো ধন্য।
কবিতাটা লিখা হলে দিপু বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। অবুঝপাখিকে নিয়ে কবিতা বানাতে পেরে সে মনের আনন্দ ধরে রাখতে পারল না। ডায়রী-কলম পড়ার টেবিলে রেখে বৈশাখী মেলা থেকে কেনা বাঁশের বাঁশিটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ভাবল, কোনো বন্ধুর সাথে বিকালের সময়টা অবুঝপাখির গল্প বলে পার করবে। কিন্তু কয়েক কদম হাটার পর তার ভাবনা পাল্টে গেল। অবুঝপাখির ঘটনা কেউ জানলে হয়তো তার কলিটা ফোটার পূর্বেই ঝরে যাবে। এমনটি ভেবে অবশেষে বিলের দিকে হাটা শুরু করল। হাটতে হাটতে সিদ্ধান্ত নিল যেভাবে হোক কাল একবার অবুঝপাখির সাথে কথা বলার সুযোগ নিবে। পারলে কবিতাটাও হাতে তুলে দিবে।
কিন্তু ভাগ্য দিপুকে সেই সুযোগ দিল না। সারা বিকেল একটানা বাঁশি বাজিয়ে সন্ধ্যার পরপর যখন ঘরে ফিরল, তখন খবর পেল নানুর ভীষণ অসুখ। এখনই মাকে নিয়ে নানার বাড়ি রওয়ানা দিতে হবে। কী আর করার? নিয়তিকে মেনে নিয়ে সে মাকে নিয়ে ত্বরিত নানার বাড়ি ছুটে গেল। পরের দিনটি খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করে কাটিয়ে দিল। একদিকে অবুঝপাখির সাথে দেখা না হবার যন্ত্রণা, অন্যদিকে নানুকে হারানোর বিষণ্নতা তার মনটাকে কুটিকুটি করে কেটে দিল। দিনশেষে যখন বাড়ি ফিরে এল, তখন মনের সকল কান্তি দুরে ঠেলে দিয়ে অবুঝপাখিকে নিয়ে ভাবনায় পড়ল। ভাবতে ভাবতে এক সময় অনাহারে ঘুমের গভীরে লুকিয়ে গেল।
পরের দিনের কথা। সারা রাত প্রচুর ঘুম হলো দিপুর। তবু সকালে সুর্য ওঠার কয়েক ঘণ্টা পরও তার ঘুমের ঘোর কাটল না। পাশের বাড়ির ফাহাদ কলেজে যাবার উদ্দেশ্যে যখন ডাক দিল, তখন সে লাফিয়ে ওঠল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল সব শেষ। অবুঝপাখির দেখা পাওয়া বুঝি আজও মিছ। মনে মনে এমনটি বলে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে সামান্য নাস্তা সেরেই বইপত্র গুছিয়ে সাইকেলটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ফাহাদ পেছন থেকে তাকে টেনে ধরল। বলল, ‘আরে আমাকে নিবি না।’
দিপু চিন্তায় পড়ল। ফাহাদ সাথে থাকলে যে অবুঝপাখির সাথে কথা বলতে সমস্যা হবে। তাছাড়া সে যদি বাড়ি এসে পরিবারের উচ্চ আদালতে মামলা করে, তবেতো ভালোবাসার গলায় রশি লাগবে। তাই ফাহাদকে বলল, ‘সাইকেলে হাওয়া কম। তাছাড়া সময়ও আমাকে ধোকা দিয়েছে। তুই তাড়াতাড়ি হেটে আয়।’
দিপু আর থেমে থাকল না। ফাহাদও বোকা বনে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল দিপুর চলে যাওয়া পথের দিকে। আর দিপু সাইকেলের হ্যান্ডেলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দ্রুত চলতে লাগল। চলতে চলতে নিজ গ্রামের সীমানা পেরিয়ে খানিকটা দুরে চলার গতি রোধ করল। তারপর চলে গেল অবুঝপাখির স্কুলের রাস্তায়। সাইকেল থামিয়ে সামনে ও পিছনে ভালোভাবে দেখে নিল। কিন্তু অবুঝপাখি তার নজরে পড়ল না। তাই ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে স্লথ গতিতে সামনের দিকে চলতে লাগল। কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলের খুব নিকটে পৌঁছতেই সে থমকে গেল। দেখতে পেল অবুঝপাখি ধীরে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে স্কুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখেও কাছে যেতে দ্বিধা বোধ করল সে। আশপাশের মানুষগুলি দেখলে যদি বাজে মন্তব্য করে, সেই ভয়ে সে অবুঝপাখিকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে কলেজের দিকে যেতে চাইল। অমনি পেছন থেকে অবুঝপাখির আওয়াজ এল, ‘এই যে, শুনেন।’
দিপু গতি রোধ করে পিছনে ফিরে তাকালে অবুঝপাখিটা একগাল হেসে নিল। তারপর কাছে এসে বলল, ‘কাল যে রাস্তায় আইলেন না।’
দিপু কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। স্বপ্নের অবুঝপাখির মুখে এমন কথা শুনে অতি আনন্দে তার চোখে জল টলমল করতে লাগল। একি সত্যি অবুঝপাখির মুখের কথা, না অন্য কারো? তা সে সহজে বুঝে উঠতে পারল না। তার কথা না পেয়ে অবুঝপাখি পুনরায় বলল, ‘কী অইল, কথা কইবেন না। আমি কিন্তু যামুগা।’
দিপুর মুখ খুলল না। এতদিন কথা বলার সুযোগ পায়নি সে। অথচ আজ সুযোগ পেয়েও বোবা হয়ে গেল। তাই অবুঝপাখিও কিছু না বলে সামনের দিকে পা ফেলতে লাগল। দিপু সামনে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াল। ডানে-বায়ে একবার তাকিয়ে কাধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে ডায়রী বের করে কবিতার পৃষ্ঠাটা ছিড়ে অবুঝপাখির হাতে তুলে দিল। তারপর আনমনা হয়ে চলতে লাগল কলেজের দিকে। অবুঝপাখিও স্কুলের দিকে চলল। স্কুলের গেটের ভেতরে প্রবেশের পূর্বে পিছনে ফিরে দিপুকে একবার দেখে নিল সে। তারপর ভেতরে চলে গেল। দিপু খানিকটা দুরে সরে অবুঝপাখিকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে অবুঝপাখি তার দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে গেছে। তাই সে আর সময় অপচয় না করে দ্রুত চলল কলেজের দিকে।
এখানেই দিপুর হৃদয়ের আঙ্গিনায় অন্যরকম এক অনুভূতি জাগ্রত হলো। যে অনুভূতির নাম প্রেম। জীবনের গতিও তার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার মাঝে ফাটল ধরেছে মাসখানেক পূর্বেই। আজ নতুন করে বইয়ের সাথেও তার সম্পর্কচ্ছেদ শুরু হলো। কলেজ থেকে বাড়ি পৌঁছেই খাওয়া-দাওয়া সেরে ডায়রী-কলম নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়ল। নতুন ছন্দ লিখতে লাগল অবুঝপাখিকে নিয়ে। লিখা শেষ হলেও বাইরে যেতে ইচ্ছে হলো না তার। কারণ; বুকের ভেতরটা ধুক্ধুক্ করে কাঁপছে। অবুঝপাখির হাতে তুলে দেয়া কবিতার ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে মনে ভয় উকি দিল।
অবুঝপাখি যদি কবিতার রহস্য না বুঝে অন্য কাউকে দেখায়, তবেতো জান খারাপ। গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। সাথে সাথে শুরুতেই সবকিছুর ইতি ঘটবে। এমনটি ভেবে দিপু উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনার হাত বাড়াল। মনে মনে বলল, তুমি সব ঠিক করে দিও খোদা।
দিপুর আবেদনে উপরওয়ালা বুঝি সত্যিই সাড়া দিলেন। অবুঝপাখির মনে দিপুর জন্যে তিনি মায়া-ভালোবাসার উদগিরণ ঘটাতে লাগলেন। যার প্রমাণ পরের দিনই পাওয়া গেল। পূর্বে কলেজে যাবার সময় দিপুই অবুঝপাখির অপেক্ষায় থাকত। অথচ আজ অবুঝপাখিই দিপুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পড়ার মতো অবস্থা। দিপুও নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। অবুঝপাখির দাঁড়িয়ে থাকা দেখে সে কাছে চলে গেল। সাহস করে বলল, ‘একটা প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর দিবে?’
অবুঝপাখি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, ‘প্রশ্ন করন লাগব না। আমার নাম শানু। এইটে পড়ি। বাড়ি এখান থেকে দুই গ্রাম পরে, এই রাস্তার শেষ মাথায়। আর কিছু কইবেন?’
দিপু বোবা হয়ে গেল। ওমা এ দেখি আজব পাগলী, মনের কথাও বলে দিতে পারে! তবে কি অবুঝপাখি নামে কবিতা বানিয়ে ধোকা খেলাম? মনে মনে কথাগুলো বলতে লাগল সে। শানু দিপুর কথা না পেয়ে বলল, ‘আপনে এমন ক্যান? হেই দিন যে দেখলাম একটু কথা কইলেন, তারপর আর দেখলাম না। আপনে কী ডরান?’
‘নাহ্ ভয় পাই না। কথা বললে গলা শুকিয়ে যায়।’
অবুঝপাখি হা...হা... করে হেসে উঠল। এ হাসিতে দিপু লজ্জিত না হয়ে বলল, ‘আজ বিকালে তোমার বাড়ির সামনে যাব। পারলে রাস্তায় নামবে?’
‘আপনে কইলে নাম্মুনা.........।’
‘আচ্ছা, কথা যেন ঠিক থাকে।’
‘ঠিক না থাকলে মাপ কইরা দিয়েন। আমি চেষ্টা চালামু।’
কথাটা বলে শানু আর দাঁড়িয়ে থাকল না। এক এক করে পা ফেলতে ফেলতে চলে গেল স্কুলের দিকে। দিপু অপলক তাকিয়ে রইল শানুর চলে যাওয়া পথের দিকে। এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল, যেন নজর স্বর্গপানে। অথচ পেছন থেকে ফাহাদ এসে তার সামনে দাঁড়ালেও সে দেখতে পেল না। ব্যাপারটা ফাহাদও বুঝে উঠতে পারল না। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সে বলল, ‘কিরে তোর তেল নাই, সময় নাই জানতাম। এখন দেখি চোখের জুতিও হারিয়ে গেছে। ’
দিপু মাথা নাড়া দিল। ভাবনার ঘোর না কাটতেই বলে উঠল, ‘কিরে কই গেল?’
‘কে?’
‘আমার অবুঝপাখি।’
ফাহাদ অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘অবুঝপাখি মানে?’
দিপুর ভাবনায় ফাটল ধরল। মনে মনে জিহ্বা কাটতে লাগল সে। সর্বনাশ অবুঝপাখি শব্দটা ফাহাদ শুনল কীভাবে? বুঝে উঠতে না পেরে বলল, ‘তুই কী বললি ফাহাদ।’
ব্যাপারটা ফাহাদের কাছে বোধগম্য হলো না। দিপু কি সুস্থ আছে, না অসুস্থ? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। ভাবল, দ্রুত সাইকেল চালাতে গিয়ে কোনো যানবাহনের সাথে ধাক্কা খেল নাকি? নাহ্ চেক করে দেখি। মনে মনে এ কথা বলে সে দিপুর আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নিল। তারপর বলল, ‘কিরে এখন ঠিক আছস।’
দিপু বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে বলল, ‘হ্যা ঠিক আছি।’
‘হয়েছিলো কী?’
‘আমি নিজেও জানি না। কয়েক দিন ধরে শুধু স্বপ্ন দেখতেছি- আমার কাছে পাখি এসে ঘুরঘুর করছে। রাতে ঘুমের ঘরে তো আসার শেষ নাই, বাস্তবের মধ্যেও একই অবস্থা।’
‘তাইলে কি তুই পাখির সাথেই ধাক্কা খেলি?’
‘হহ্.... আরে না, না। পাখির সাথে মানুষ ধাক্কা খায় কিভাবে?’
ফাহাদ বিরক্ত বোধ করে বলল, ‘ধুর বেটা। তোর কথার আগা-হোগা কিছুই বুঝলাম না।’
‘তোর বুঝে কাজ নেই। শুধু বল আমার সাথে কাউকে দেখছস কিনা।’
‘কই না। আমিতো রাস্তার ঐ মোড় থেকেই তোক একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।’
‘তাইলে ভালো করছস। আল্লার কাম আল্লায় সামাল দিছে। সাতখুন মাপ হইছে।’
‘তুই খালি পেচায়া কথা কস। সহজ কইলে পারস না।’
‘সহজ কামে হাত দিলে তো সহজ কমু, নাকি?’
‘হ...।’
‘তাইলে আয় আমার সাথে। না আসলে যাইতে দে।’
এ কথা বলে দিপু হ্যান্ডেলে দ্রুত চাপ দিতে লাগল। ফাহাদ দৌড়ে গিয়ে দিপুর সাইকেলের পেছনে চড়ে বসল। তারপর বলল, ‘কোথায় যাবি?’
‘কলেজে।’
ফাহাদ আর কিছু বলল না। দিপুর বিষয়টি তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হল। ভাবল, যেভাবেই হোক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করবে। দিপুকে পাহাড়ায় রাখবে।
সফির এ ভাবনা শেষ হলে দিপু বলে উঠল, ‘ফাহাদ, যা দেখছস আর না দেখছস, এটা নিয়ে গবেষণা করিস না। তাহলে আমার বিপদ হবে।’
ফাহাদ কিছু বলল না। দিপুর ঘটনার রহস্য কিছুটা হলেও আন্দাজ করে নিল সে। তাই নীরব হয়ে গেল। আর দিপুও নীরব থেকে সাইকেল চালাতে চালাতে কলেজের দিকে ছুটল।
দুপুর পার হয়ে গেল। সময় হলো ছুটির ঘণ্টা বাজার। দিপু বাড়ি যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল। অবশ্য পূর্বে ছুটির ঘণ্টা বাজলে সবার আগেই সে কাশ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু আজ আর তা দেখা গেল না। বিকেলে অবুঝপাখির সাথে তার দেখা হবার কথা। সেই আশায় দুপুরে অবুঝপাখিকে দেখার আগ্রহটা নেই। তাছাড়া ফাহাদ যদি সাথে না থাকত, একবার দেখে নিতে পারত।
যা হোক। এক এক করে সবাই কাশ থেকে বের হবার পর দিপু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর বাইরে এসে সাইকেল ফাহাদের হাতে তুলে দিয়ে সে পিছনে চড়ে বসল। ফাহাদও দিপুকে নিয়ে চলতে লাগল বাড়ির দিকে। চলতে চলতে খানিকটা পথ পেছনে ফেলে দিলে দিপুর নজর পড়ল সামনের রিক্সায়। দেখতে পেল অবুঝপাখিকে। তাই সে চমকে উঠল। ফাহাদকে বলল, ‘ধীরে চল ফাহাদ। আরো ধীরে।’
ফাহাদ দুষ্টুমির ছলে সাইকেলের গতি আরো বাড়িয়ে দিল। এ অবস্থায় দিপু নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তারপর রিক্সাটা অতিক্রম করে যখন সামনের দিকে এগিয়ে গেল, তখন অবুঝপাখির নজরে পড়ে গেল দিপু। অবুঝপাখি বলল, ‘এই যে, আমি কিন্তু বিকালে অপেক্ষায় থাকুম।’
অবুঝপাখির কথাটা কানে এলে দিপু মাথায় ইশারা দিল। ফাহাদ এ আওয়াজ শুনে পিছনে তাকিয়ে বলল, ‘কাকে বলল, তোকে?’
‘আমাকে বলবে কেন? আমি কি তাকে চিনি?’
‘রাখ, তোকে যে হেয় চিনে এটা এখনই বের করছি।’
এ কথা বলে ফাহাদ সাইকেলের গতি কমিয়ে নিল। ততক্ষণে দিপু অবুঝপাখিকে চুপ থাকার ইশারা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর অবুঝপাখির রিক্সাটা সাইকেল অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেল। ফাহাদ বোকার মতো তাকিয়ে রইল অবুঝপাখির দিকে। ব্যাপারটা বুঝেও তার কাছে আবার ঘোলাটে হয়ে গেল। তাই চিন্তিত মনে চলতে লাগল সে। চলতে চলতে বাড়ির খুব নিকটে পৌঁছলে দিপু মুখ খুলল। বলল, ‘ফাহাদ কাউকে না বললে বিকালে তোকে নিয়ে যাব। আমার সাথে যাবি?’
‘কোথায় যেতে হবে?’
‘ওদের বাড়ির সামনে।’
‘যদি কোনো সমস্যা হয়।’
‘সমস্যা হবে না। ও অনেক চালাক আছে।’
‘ঠিক আছে। তুই যখন বললি, যাব।’
‘বিকালে চারটার পরপরই রওয়ানা দিব।’
ফাহাদ মাথায় ইশারা দিয়ে সম্মতি প্রকাশ করল। তারপর যে যার ঘরে চলে গেল। বিকেল হলে নির্ধারিত সময়ে ফাহাদ দিপুর সাথে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলো। অপেক্ষা করতে লাগল দিপুর বাড়ির সামনের রাস্তায়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও দিপুকে সে দেখতে পেল না। অবশেষে ধৈর্যহারা হয়ে দিপুর বাড়িতে চলে গেল। দিপুর ছোট ভাই নিপুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল সে ঘুমিয়ে আছে। তাই অবাক হয়ে গেল ফাহাদ। মনে মনে বলল, ইশ্ যার বিয়া তার খবর নাই, পাড়াপরশির ঘুম নাই। তারপর খানিকটা রাগ রাগ চেহারায় সে চলে গেল দিপুর বাড়ির আঙ্গিনা ছেড়ে।
ঐদিকে দুপুরে ঘুমিয়ে থাকাবস্থায় অবুঝপাখির সাথে স্বপ্নের রাজ্যেই দেখা হয়ে গেল দিপুর। স্বপ্নের দেশে অবুঝপাখির সাথে দেখা করতে গিয়ে সে পড়ল মহাবিপদে। সে যখন অবুঝপাখির বাড়ি বরাবর পৌঁছল, তখন অবুঝপাখি দৌড়ে এসে হাত ধরে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। অবুঝপাখির বাবা-মা তা দেখে দিপুর উপর মৌখিক নির্যাতন শুরু করলেন। বাড়ি কোথায়? কী করে? এখানে কেন এসেছে? এমন সব প্রশ্নের আঘাতে তাকে দিশাহারা করে ফেলল। সর্বশেষ তারা দিপুকে বলে দিলেন, ভবিষ্যতে যেন শানুর সাথে আর না দেখি। এমন পরিস্থিতিতে শানুও হতবাক হয়ে গেল। মা-বাবার কাছে আকুতি-মিনতি করে বলল, ‘হের কোনো দোষ নাই মা। সব দোষ আমার। আমিই হেরে আইতে কইছিলাম।’
এ কথার পর শানুর বাবা তাকে কষে একটা চর মারল। চর খেয়ে সে হুহু করে কাঁদতে লাগল। দিপুও শানুর জন্যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
ঘুমের ঘরে দিপুর এ কান্নায় বালিশ ভিজে যেতে লাগল। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গল না। তার মা যখন বিকেলে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে এলেন, তখন তিনি অবাক হলেন। চেচিয়ে উঠে বললেন, ‘দিপু, বাবা তোর কি অইছে? কাদিস কেন?’
দিপুর কোনো আওয়াজ এল না। মা তার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন শরীরে জ্বর আছে কিনা? কারণ; জ্বর হলে ঘুমের মধ্যে প্রায়ই দিপুর অশ্রু ঝরে। কিন্তু শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখে তিনি চিন্তায় পড়লেন। এর মধ্যে আচমকা দিপু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘না, ওরে আর মারবেন না। আমি ওর সাথে আর কথা বলব না। ওরে মাপ কইরা দেন।’
মা বুঝে নিলেন দিপু যে স্বপ্নের দেশে থেকে কারো মুক্তি প্রার্থনা করছে। তাই তিনি রেগে উঠলেন। কষে একটা চর বসিয়ে দিলেন ছেলের গালে। চর খেয়ে দিপু লাফিয়ে উঠল। কিন্তু ঘুমের ঘোর কাটল না তার। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, কারে বিপদ থেইকা বাচাইতে চাইলি?’
দিপু চোখের জল মুছে হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘শানু মা। শানু।’
মায়ের চোখ কপালে উঠল, ‘শানু। সে আবার কে?’
দিপুর ঘুমের ঘোর কেটে গেল। মনে মনে বলল সর্বনাশ, কী থেকে কী বলে ফেললাম। তারপর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল, ‘না মা, ভুল বলেছি। শানু না, শাজু। আরে আমাদের সাথে যে ছেলেটা পড়ে।’
‘তয় কি অইছে কবিতো।’
দিপু নীরব হয়ে গেল। সে মিথ্যা বললেও মার বুঝতে বাকী রইল না। কারণ; দিনকয়েক ধরে তার চলাফেরায় যে আকষ্মিক পরিবর্তন এসেছে, মা গোপনে তা লক্ষ করছেন। তাছাড়া দিপুর সকালের খাবার দুপুরে, দুপুরের খাবার রাতে হয়। রাতেরতো খাবার ইদানিং হয়ই না। তাই সবদিক ভেবে মা বললেন, ‘পোলা আজেবাজে চিন্তা বাদ দে কইলাম, নাইলে তোর বাপের তন কইয়া দিমু।’
দিপু আর কিছু বলল না। দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর পড়তে সে চমকে উঠল। ত্বরিত ঘর থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে সাইকেলটা নিয়ে চলে গেল রাস্তার দিকে। তারপর ফাহাদকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজির পরও ফাহাদের সন্ধান পেল না। অবশেষে একাকী চলতে লাগল অবুঝপাখির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে তার বুক ধুক্ধুক্ কাঁপতে লাগল। না জানি আজ কোন বিপদ এসে ধরা দেয়- মনে মনে এ কথা বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল। পরণে স্বপ্নের কথাটা মনে পড়লে তার সমস্ত দেহ শিউরে উঠল। স্বপ্নটা যদি বাস্তব হয়, তাহলেতো সব শেষ। এখানেই শানুর সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটবে। এগুলো ভাবতে ভাবতে সে একসময় অবুঝপাখিদের বাড়ির রাস্তায় পৌঁছে গেল। সাইকেলের গতি রোধ করে দুর থেকে অবুঝপাখিকে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে না পেয়ে ধীরে ধীরে আবার এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে।
এদিকে বিকেলের প্রথম প্রহর থেকেই অবুঝপাখি ঘরের জানালার পাশে বসে আছে দিপুর অপেক্ষায়। দিপু যখন তার ঘর বরাবর পৌঁছল, তখন সে চমকে উঠল। ত্বরিত ঘরের দরজাটা খুঁলে রাস্তায় চলে গেল। তারপর দিপুর হাত ধরে টেনে চলল ঘরের দিকে। চলতে চলতে বলল, ‘ও আম্মু, দেইখা যাও কে আইছে।’
ভয়ে দিপুর গলা শুকিয়ে গেল। কিছুই বুঝে উঠতে পারল না সে। বলল, ‘সমস্যা হবে নাতো?’
‘নাহ্। তবে আপনে না ডরায়া সাফ সাফ উত্তর দিবেন। আমি আম্মুরে কইছি একজন আইব আমারে প্রাইভেট পড়াইতে। বুঝলেন?’
দিপুর ভেতরটা অস্বাভাবিক হেসে উঠল। অবুঝপাখি যে এতটা বুদ্ধিমান, তা সে পূর্বে উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই দিপুর আকর্ষণ আরো কয়েকশ গুন বেড়ে গেল। তারপর ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে নির্ভয়ে বলল, ‘তোমার আব্বু বাড়িতে নেই।’
‘নাহ্। আব্বু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইবও না। তাই ডরানের কাম নাই। আম্মু অহন ইন্টারভিউ নিবো আপনের। আমি লইয়া আইতাছি।’
অবুঝপাখি চলে গেলে দিপু চুপটি মেরে বসে রইল। ইন্টারভিউর কথা শুনে তার চোখ কপালে উঠল। জীবনে এ পর্যন্ত কাউকে প্রাইভেট পড়ায়নি সে। ভয় জাগল, কোন প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে আবার মাথা পাগল করে ফেলে কে জানে? একদিকে ভয়, অপরদিকে ভরপুর সাহসও। ভাবল, অবুঝপাখি শানু যদি এতকিছু বানিয়ে বলতে পারে, তবে সে কেন পারবে না? তাছাড়া বিপদে পড়লে অবুঝপাখিও ইশারায় উদ্ধার করে দিবে।
দিপুর এ ভাবনা শেষ হবার কিছুক্ষণ পর মধ্য বয়সী এক মহিলা তার সামনে এলেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষে সে দাঁড়িয়ে মহিলাকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে মহিলা বললেন, ‘আমি শানুর মা। তুমি নিশ্চয়ই দিপু?’
‘জি।’
‘তোমার লাইগা মাইয়াডা আমারে কয়দিন ধইরা মেলা জ্বালাইতাছে। কত্ত পোলাপান যে হেরে পড়ানের লাইগা চেষ্টা তদবির করল, তার বিবরণ দেওয়াডাও কষ্টকর। টিচার হের মনমতো না অওয়ায় মিছা মিছা সময় নষ্ট কইরা পোলাপানগুলা শুধু কাইন্দা মরল। আইজ তুমি আমারে বাচায়া দিলা বাবা।’
কথার রহস্য খুঁজে পেয়ে দিপু বোবা হয়ে বসে রইল। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না সে। তার কথা না পেয়ে শানুর মা পুনরায় বললেন, ‘কোন কেলাশে পড় তুমি?’
‘একাদশ শ্রেণীতে।’
‘আমার মাইয়ারে পড়াইতে সময় পাইবাতো?’
‘পাব না কেন? তাছাড়া ওর যে মেধা, পড়াতে এলে আমারও উঠে যেতে মন চাইবে না।’
‘যাক বাবা, হুইনা খুশি অইলাম। তাইলে কাল থেইকা পড়া শুরু কর।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’ বলে দিপু উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘তাহলে এখন আসি আন্টি।’
‘একি, নাস্তা না কইরা? এগুলো খায়া লও, তারপর যাইবা।’
দিপু বসে একটি পিঠা হাতে নিয়ে খাওয়া শুরু করল। শানুর মা চলে গেলেন নিজের কাজে। মা চলে গেলে শানু এসে দিপুর পাশে দাঁড়াল। শানুকে দেখে দিপু হাসি ধরে রাখতে পারল না। শানুও নিজের মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ হেসে নিল। তারপর বলল, ‘কপালটা ভালা দেইখা বাইচ্চা গেলেন। বেশি কিছু জিগায় নাই।’
দিপু কিছু না বলে একটি পিঠা হাতে নিয়ে তা থেকে অর্ধেক শানুর মুখে পুরে দিল। শানুও একটি পিঠা হাতে নিয়ে তা থেকে অর্ধেক দিপুর মুখে পুরে দিল। তারপর বলল, ‘স্যার, তাইলে কাইল কয়টায় আইবেন?’
দিপু হাসতে হাসতে বলল, ‘আজ যে সময়, ঠিক এই সময়ই।’
‘আরেকটু আগে আইলে অয় না?’
‘নাহ্।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে। আপনের ইচ্ছা মতোই আইসেন।’
এ কথার পর দিপু উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘তোমার আম্মুকে ডাক, আমি চলে যাব।’
‘ইহ্, এত তাহুত কেন? নিজেই আওনের লেইগা পাগল অইছিলেন না।’
দিপু নীরব হয়ে গেল। পরক্ষণে তার মধ্যে একটা দায়িত্ববোধ জাগ্রত হলো। ভাবল, কাল থেকে একজন শিক্ষক হিসেবে এ বাড়িতে আসতে হবে। সুতরাং শানুর সাথে আর হাসি-ঠাট্টা করা যাবে না। এমনকি রাস্তা-ঘাটেও পিছু নেয়া যাবে না। মনে মনে বলল, এ কী হয়ে গেল। শানু যে আমাকে আটকে দিল। আর শানু দিপুর নীরবতা দেখে বলল, ‘কী স্যার, কিছু ভাবতাছেন?’
‘হ্যা, ভাবছি কী থেকে যে কী হয়ে গেল?’
‘কিছুই অয় নাই। আমি চালাকি কইরা আপনের পথ পরিস্কার কইরা দিছি।’
‘পথ পরিস্কার করেছ, নাকি আমাকে দুরে ঠেলে দিয়েছ?’
কথাটা বলা শেষ হলে দিপুর চোখে জল টলমল করতে লাগল। এ জল দেখে তার প্রতি শানুর মায়া আরো বেড়ে গেলে। আবেগজড়িত কণ্ঠে শানু বলল, ‘না স্যার। তুমি চোখের সামনে একদিন না আইলে আমার সব কিছু আন্ধার অইয়া যায়। তাই এমনটা করছি। আমারে মাপ কইরা দাও।’
এ কথা বলে শানু দিপুর সামনে হাত জোড় করে ধরল। দিপু শানুর হাত দু’টো বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমিও যে তোমাকে না দেখলে রাতে ঘুমাতে পারি না শানু। তোমাকে না দেখলে আমার গতি চলে না। কিন্তু.....’
‘কিন্তু কী স্যার.... কও।’
কিছু না বলে দিপু আবার নীরব হয়ে গেল। ভাবল, প্রাইভেট পড়ানোর নামে এসে ভালোবাসার কথা বলা একটা তুচ্ছ ঘটনার মতো। যদিও ভালোবাসার সুত্র ধরেই প্রাইভেট পড়ানো, তবু এটা সে মেনে নিতে পারল না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টাই বাদ দিয়ে দিবে। তবে শানুর মাকে কথা দিয়েছে বলে কিছুদিন পড়াবে। তাই শানুকে বলল, ‘তোমাকে মনে হয় বেশিদিন পড়ানো সম্ভব হবে না।’
‘কেন, অসুবিধা কী?’
‘অসুবিধা একটাই, ছদ্মবেশ আমি পছন্দ করি না। তাছাড়া যদি শিক্ষা দিতেই আসতে হয়, তাহলে ভালোবাসাকে মনের ঘরে বন্দী করে আসতে হবে।’
দিপুর উন্নত চিন্তাধারা উপলব্ধি করতে পারল শানু। দিপুর প্রতি ভালোবাসার মাত্রা আরো বেড়ে গেল তার। তাই অভয় দিয়ে বলল, ‘তাইলে যতদিন পড়াইবা, আমি পড়া নিয়াই ব্যস্ত থাকুম। শুধু আমারে পাঁচটা মিনিট সময় দিবা, তোমার দিকে প্রতিদিন একটু হা কইরা চায়া থাকুম।’
কথাটা শুনে দিপু নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। অল্প বয়সের অবুঝপাখি শানুর কথায় সে পাগল হয়ে গেল। আচমকা জড়িয়ে ধরে তার গালে ও কপালে কয়েকটি চুমু খেল। তারপর চেয়ারে বসে বলল, ‘তোমার আম্মুকে ডাক। আমি চলে যাব।’
শানু আম্মুকে ডেকে আনল। দিপু চেয়ার থেকে উঠে বলল, ‘আসি আন্টি, আস্সালামু আলাইকুম।’
‘আইচ্ছা আসো।’
দিপু ঘর থেকে নেমে গেল। সাইকেলে উঠে পিছনের দিকে একবার তাকিয়ে চলতে লাগল সামনের দিকে। শানু তাকিয়ে রইল দিপুর চলে যাওয়া পথের দিকে। চলতে চলতে দিপু চোখের আড়াল হলে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। তারপর মনে মনে বলল, এমন আজব লোক দুনিয়াতে মনে হয় আর নাই।
শানুর মনের এ কথাটা আসলে সত্যই। দিপুর মতো এমন অসাধারণ মনমানসিকতা আজকাল খুব কম লোকেরই আছে। কারণ; শানুকে প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে সে একজন সত্যিকারের শিকের মতোই পাঠ দান করতে লাগল। ভালোবাসা তো দুরের কথা, দুষ্টুমির কোনো সুযোগই সে দিল না শানুকে। শানুও পড়ালেখার প্রতি ঘোর মনোযোগ দিল। ফলে প্রতিটি পরীক্ষায় সে ভালো ফল লাভ করতে সম হলো।
এভাবে একটি বছর কেটে গেল। শানুকে পড়াতে গিয়ে দিপুর উঠতি বয়সের ভালোবাসায় অনেকটা ভাটাও পড়ে গেল। তারপর দিন যেতে যেতে এক সময় দিপুর ফাইনাল পরীক্ষা নিকটবর্তী হলো। তাই কয়েক মাসের জন্যে শানুকে পড়ানো বাদ দিয়ে সে নিজের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ততায় পড়ল। একদিন শেষও হলো ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে সকল অস্থিরতা দুর করে সে আবার ছুটে গেল শানুর বাড়িতে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন