পার্কের রাস্তা দিয়ে আনমনে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছিলাম। হটাৎই একটা নারী কণ্ঠে নিজের নাম শুনে সচকিত হলাম। আবার শুনলাম
valobasar park
- এই যে রাজা ভাইয়া...
আমি অবাক হয়ে পিছনে ফিরে তাকালাম আর একটা মায়াবী হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব দেখতে পেলাম। সাথে সাথে আমি কিছুটা চমকে গেলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে মুখটা আমার অতি চেনা। কিন্তু কিছুতেই মনে আনতে পারলাম না ঠিক কোথায় আমি এ মুখ দেখেছি। আমি আরও অবাক হলাম যে এই মেয়ে আমার ডাকনাম ধরে ডাকছে যেটা আমার ছোটবেলার বন্ধুরা আর পরিবারের সদস্যরা ব্যাবহার করে।
- কী চিনতে পারছো আমাকে ?
- না মানে চেনা চেনাই লাগছে। আসলে...
- জানতাম চিনতে পারবে না। আমাকে তো ভুলেই গেছ। আমি রিয়া।
রিয়া !!!! নামটা শোনামাত্রই চমকে উঠলাম আর বুকের ভেতরে কেমন জানি একটা অনুভূতি হল। পাশাপাশি হৃদয়ের গভীর থেকে একরাশ স্মৃতি এসে মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

রিয়া হচ্ছে সেই মেয়ে যে তার সুললিত কথাবার্তা, আয়ত চোখের উৎসুক চাহনি আর মুক্তাঝরা হাসি দিয়ে আমার ছোট্ট কিশোর হৃদয়ে বিশাল একটা জায়গা করে নিয়েছিল।.....
তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল জাতীয় স্কাউট জাম্বুরীতে। আমি ছিলাম আমাদের স্কুলের স্কাউট টিমের লিডার। আর ও ছিল ওদের টিমের লিডার। একদিন লিডারদের মিটিং-এ তাকে খেয়াল করি। তখনো তাকে নিয়ে কোন চিন্তা মাথাতেই আসে নি। তারপরদিন প্রাত্যহিক সমাবেশে আমি হটাৎই লক্ষ্য করলাম যে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু উৎসুক হলেও আচরনে তা প্রকাশ পেতে দিলাম না। তারপর থেকে কোন অজানা কারণেই আমার মন মেয়েটার দিকে ছুটে ছুটে যেতে লাগল। একদিন আমিও ওর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রাখলাম। সে বোধহয় লজ্জা পেয়েই চোখ নামিয়ে নিল। সে থেকেই শুরু। নিজেও বুঝতে পারি নি মেয়েটা কখন আমার মনে একটু একটু করে ঢুকতে শুরু করেছিল।
চতুর্থ দিনেই তার সাথে আমার প্রথম কথা হল। লিডারদের একটা কোর্সে আমার পাশের চেয়ারটাতেই বসেছিল। আমি বাস্তবে খুব সাহসী, হাসিখুশি আর বন্ধুবাৎসল হলেও মেয়েদের সামনে গেলে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম। তারপরও সেদিন কি জানি হয়ে গেল, আমি একটা ছুতায় কথা শুরু করে দিলাম
- তোমাদের সহকারী লিডার আসে নি ?
- নাহ। ওর নাকি এসব কোর্স-টোর্স বিরক্ত লাগে। তাছাড়া রান্নাটাও বাকি আছে। তাই থেকে গেল।
- ওহ। আমারও তো বাজে লাগে। জানা জিনিস নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর শুনতে।
- হি হি হি হি...আমার কী খুব ভাল লাগে নাকি !? তারপরও উপায় তো নেই।
- আচ্ছা তোমার নাম কী ?
- রিয়া । আপনার ?.............................

এভাবেই শুরু। তারপর আর থামি নি। পুরা নব্বই মিনিট ফিসফিস করলাম। অনেক পিছনে ছিলাম বলে ট্রেইনার স্যার আমাদের খেয়াল ই করেন নি।
এরপর থেকে কখনো কখনো খেয়াল করতাম প্রায় সময় সে আমার দিকে কিছুক্ষণ পর পর এক পলক তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আবার কখনো মাঠে গোল হয়ে বসে জানা অজানা কোর্সের সময় খেয়াল করতাম অনেক দূর থেকে অনেক স্কাউটের মাথা ও কাঁধের মধ্য দিয়েই সে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। আমার কী হত জানি না, আমার চোখজোড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেদিকে নিবদ্ধ হয়ে যেত। অনেক সময় আবার খুব ইচ্ছা হলেও তার চোখে চোখ রাখতাম না। পাছে আবার অন্যকিছু ভেবে বসে!
তারপর আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব টা খুব ভালই এগিয়েছে। বন্ধুত্ব বলছি একারণই যে আমি তাকে ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে দিই নি যে আমি তার প্রতি দুর্বল ছিলাম। বরং আমার আচরণ ছিল অনেকটা বড়ভাইসুলভ।
শেষ দিনের আগের দিনের একটা ঘটনায় সে আমার মনে আরও বেশী করে জায়গা নিয়ে নিল। লিডার হিসেবে দুইজনেরই ভাল পারফরমেন্স ছিল বলে দুজনেই ডাক পেলাম ক্যম্পফায়ারের আগুন জ্বালানোর জন্য কাণ্ডারীর বাছাই পর্বে। বাছাইয়ে আমি ভরাট গলার সুবাদে টিকে গেলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়টা ছিল সে ঝরে গেল। ট্রেইনার মুচকি হেসে তাকে বলেছিলেন

- মা, তোমার এই মিষ্টি কণ্ঠে এই সংলাপগুলো মানাবে না।
সত্যিই সংলাপগুলো ছিল রাক্ষুসেমার্কা অট্টহাসির সাথে ভয়ঙ্কর কণ্ঠের কিছু ডায়লগ যা তার কণ্ঠে কিছুতেই মানাচ্ছিল না। অগত্যা তাকে বাদই দিয়ে দেওয়া হল। বাদ হয়ে তার সেকি মন খারাপ! মুখ নিচু করে গুটিগুটি পায়ে নিজেদের তাবুর ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর এ ঘটনায় যে আমি নিজে কম দুঃখিত হয়েছি তা না। যাইহোক রিহার্সেল শেষে তাবুতে ফিরার পথে ওদের তাবুর সামনে দিয়ে ফেরার সময় হটাৎ ওদের টিচার আমাকে ডাকলেন
- বাবা রিয়ার কী হল বল তো ? ওখান থেকে আসার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলল।
আমি অতঃপর উনাকে সব বললাম। উনি বললেন
- যাও তো ও চুলার কাছে আছে। একটু বুঝিয়ে বল গিয়ে ওকে। আমার কথায় তো কোন কাজ হচ্ছে না।
.......এই বলে তিনি আবার কাজে(পেঁয়াজ কুচি) ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আমি তাবুর অন্যপাশে গিয়ে দেখতে পেলাম সে বিমর্ষমুখে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম
- কি ব্যপার আপু(আমি ওকে প্রায়ই আপু বা ছোটআপু বলে সম্বোধন করতাম), এই সামান্য ব্যপারে কাঁদতে হয় নাকি ?
আমি ওর পিঠ চাপড়ে দিলাম। সে আবার হু হু করে কেঁদে ফেলল।
- আমি সেজন্য কাঁদিনি রাজা ভাইয়া। সবার সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে তোমার কাছ থেকে চলে আসতে আমার খুব কষ্ট লেগেছে।
I was just speechless। কোনমতে বললাম
- থাক আর কেঁদে কী হবে। যাও মুখ ধুয়ে নাও। কী অবস্থাই না হয়েছে চেহারার।

পনেরটা দিন যে কীভাবে উড়ে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। তবে একদম শেষদিন বুঝতে পেরেছিলাম আসলে সে আমার কতটা আপন হয়ে উঠেছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। সকালে উঠে যখন জিনিসপত্র গুছানো শুরু করলাম আমার বুকটা হু হু করে ফেটে যেতে চাইছিল। আর শেষ বিদায়ের মুহুর্তে আমার কেমন লাগছিল বলে বুঝাতে পারব না। যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারাই কেবল অনুভব করতে পারবেন। মনে হচ্ছিল কউ পাম্প করে বুকের রক্ত-মাংস-বায়ূ সব বের করে দিয়ে বুকটাকে শূন্য করে দিয়েছে এবং শেষ দিকে কেঁদেই দিয়েছিলাম তাবুতে বসে।
অবশেষে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু আমি ফিরলে কী হবে। আমার মনটা সেই জাম্বুরী গ্রাউন্ডেই পড়ে রইল। তারপরও অনেক দিন পড়াশোনায় মনই বসে নি। পড়তে পড়তে কখন যে তার কথা ভাবা শুরু করতাম বুঝতে পারতাম না। আবার লিখার সময়ও কখন কলম আপনাআপনই থেমে যেত টেরই পেতাম না। .........................
- আমার দিকে এভাবে হাবার মত তাকিয়ে কী আছ কেন ??
আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। আসলে রিয়া নামটা শোনামাত্রই আমি আবার হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই পুরোনো দিনে।
- না আগের কথা মনে পড়ল। কিন্তু তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে ???
- হি হি হি....সত্যি বলতে কী তুমি একদমই পাল্টাও নি। সেই একই ফ্রেমের চশমা, একই রকম হাটা, প্যান্টের পা ভাজ করা এমনকি চুলের ভাঁজটাও একই রকমই রয়ে গেল ।
এবার ছিল আমার পুনরায় চমকানোর পালা। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পরও মেয়েটা আমার এতকিছু মনে রেখেছে!!!
- আর তোমার হাসিটা বাদে সবই বদলেছে। তাই তো প্রথমে চিনি নি ।
- হি হি হি। তা রাজা ভাইয়া এখন কোথায় আছ ?
- মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হয়েছি। তুমি এখানে কেন ?
- ও তোমার তো আবার নৌবাহিনীতে ঢোকার এইম তাই না ? আমার H.S.C শেষ। তাই চাকতাইয়ে আপুর বাসায় বেড়াতে আসলাম।
- আমার এইমটাও মনে রেখেছ ?
আমি আরও অবাক হলাম। এমন সময় দূর থেকে ওকে একজন মহিলা ডাক দিলেন।
-ওহ সরি ভাইয়া , আপু ডাকছে। আমাকে এখন যেতে হবে। পরে কথা হবে। বাই...........

এই বলেই সে দৌড়ে চলে গেল। আমি আমার জায়গাতেই স্থির হয়ে রইলাম। ফিরে তাকাতেও ভুলে গেলাম। পুরোটাই কেমন জানি স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।
ফুটপাত দিয়ে এলোমেলো পা ফেলে হোস্টেলে পৌঁছালাম। সাড়ে চার বছর আগের সেই অনভূতিটা আবার ফিরে এল। হটাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার মাথায়। শিট্!!! ওর মোবাইল নম্বরটাও তো নেওয়া হল না। আমি প্রবল হতাশার সাথে ফ্লোরেই বসে পড়লাম।
অনেক আগেই জীবনের নিষ্ঠুর যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে যে ভালবাসাকে নিজ হাতে ছাইচাপা দিয়েছিলাম সেটা আজ আমার সামনে আরও বিপুলতর শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আবার আমার মন ছন্নছাড়া হয়ে গেল। শুরু হল আগের সেই পড়া ছুটে যাওয়া আর কলম থেমে যাওয়া। কী করব কিছুই বুঝতে পারলাম না। সন্ধ্যায় টেবিলে বসেই সাড়ে চার বছর আগে লিখা একটা কবিতা মনে পড়ে গেল-

পাখিরা চায় আকাশের নীল
কবিতা চায় ছন্দের মিল
মৌমাছিরা চায় মৌ ভরা ফুল
নৌকা যে পেতেচায় নদীর সে কূল
রাত চায় জোছনা ঝরানো সে চাঁদ
মন চায় মুছে দিতে যতই অবসাদ
সরসীর ভালবাসা চায় রাজহাঁস
শিশিরকে পেতে চায় ভোরের সে ঘাস
আর, আমি শুধু চাই
তোমাকেই।

তখন আমি রিয়াকে দেবার জন্য এই কাব্যময় প্রেমপত্রটা রচনা করেছিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতের নানা দিক বিবেচনা করে ছিড়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এই ১৫ বছর বয়সে একটা মেয়ের কাছে এভাবে মন দিয়ে দিলে পড়ালেখায় আর মন দিতে পারব না। আমাকে তো আর শুধু আমার দিকে তাকালে হবে না। ভবিষ্যতে যোগ্যতা অর্জন করে ওর সামনে দাঁড়ালে ও কখনো আমাকে ফিরাতে পারবে না। এই ভেবেই অনেক কষ্ট সত্বেও আমার ভালবাসাটাকে মনের ভিতর কবর দিয়েছিলাম।
আজ এতবছর পর ওকে দেখে আবার খুব ইচ্ছে হল ওকে ভালবাসতে। কোমল হাতদুটো ধরে কিছুদূর হাঁটতে। তাই আবার কবিতাটা দিয়ে একটা প্রেমপত্র রচনা করে ফেললাম। ভাবলাম কাল নিশ্চই ও পার্কে আসবে। কিংবা আমিই চাকতাইয়ে গিয়ে তার বোনের বাসা খুঁজে বের করব.........
আমি ছাদে গেলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ভেজার। সিড়িঘরের চাতালের নিচে দাড়িয়ে আবার ভাবতে শুরু করলাম। এতটা বছর পরও রিয়া আমার এতকিছু মনে রেখেছে ? আমাকে দেখে তার হাস্যভরা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার মানে কী সেও আমাকে মনে মনই ভালবেসে গিয়েছে ?...... হটাৎই আবার আমার চোখের সামনে থেকে রঙিন চশমা সরে গেল। ভেসে উঠল আমার সাফল্য নিয়ে প্রবল আশাবাদী মা-বাবার মুখটা। কেন জানি আবার মনে হতে লাগল আমাকে ওদের জন্যও অনেক অনেক কিছু করতে হবে। মনটা আবার তেতো হয়ে গেল। আসলেই আমার জীবনটা উপভোগের জন্য নয়........

চিঠিটা হাতেই ছিল। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করলাম। শেষমেশ আবারও আমার কর্তব্যবোধের কাছে ভালবাসার পরাজয় হল। চোখ বন্ধ করে চিঠিটাকে দ্বিতীয়বারের মত দু টুকরো করে বৃষ্টির জলে ছুড়ে ফেললাম। আকাশ থেকে পড়া অসংখ্য পানির ফোটা সেটিকে ঝাঁঝরা করতে লাগল ঠিক যেমনটি হচ্ছিল আমার হৃদয়। একছুটে নিজেও খোলা জায়গায় চলে এলাম। বৃষ্টির প্রবল বর্ষণবেগে ধুয়ে ফেলতে চাইলাম যত দুঃখ। চিৎকার করে বলে উঠলাম, আমি¬¬ তোমায় ভালবাসি রিয়া....................

রিয়া,
আজও তোমায় আমি অনেক অনেক ভালবাসি ঠিক যেমনটি বাসতাম সাত বছর আগে। কিন্তু তোমার কাছে একথা প্রকাশ করিনি কেন জানো ? তোমার শুভাকাঙ্খী ছিলাম বলেই। আমি চাইনি তোমার কিশেরী মনটুকু দখল করে তোমার পড়াশোনা আর অন্যান্য কাজে ব্যঘাত ঘটাতে। তবে খুশির কথা কী জানো ? আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আর এর পেছনে সবচেয়ে বেশী কাজ করেছে তোমাকে পাবার ইচ্ছাটা। এখনো আমি তোমার তেমন কোন খবর জানি না। তোমার মোবাইল নং, ফেসবুক আইডি বা বর্তমান ঠিকানা কিছুই নেই। তবে আমি ঠিকই তোমাকে খুঁজে বের করে ফেলব। অপেক্ষা কর.........আমি আসছি। এবার আর কোন কিছুই আমাকে পিছু ফেরাতে পারবে না।
 
Top