শুরু করি একটা নাটকের কাহিনী দিয়ে। নাটকের নায়ক সজল, নায়িকা তিশা। এক বিশেষ রোমান্টিক দৃশ্যে নায়ক নায়িকাকে বলল, “আমি জীবনে অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। অনেকের সাথে প্রেমও করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, একমাত্র তোমাকে দেখেই আমার বিয়ে করতে ইচ্ছা হয়েছে! তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে??”
এই কথা শুনে নায়িকা আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ল! এক্সপ্রেশন দেখে মনে হলো, এমন চমৎকার কথা যেন সে জীবনেও শোনেনি! তার চোখ দিয়ে টপাটপ আনন্দ অশ্রু গড়াতে লাগল! আর মুখে হ্যা সূচক হাসি! তারপর আর কী… তাদের ভালোবাসা হয়ে গেল। কয়দিন পর বিয়েও হয়ে গেল।
আর আমি তো হতবাক! এইডা কি হইলো?? বিয়ে করার ইচ্ছা জাগলেই সাত খুন মাফ???
“আমি জীবনে অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। অনেকের সাথে প্রেমও করেছি।” এমন ‘মধুর’ বানী শুনেও নায়িকার চোখে আনন্দে জল আসে??
আজকাল বাস্তবেও এমনটা দেখা যায়। বিভিন্ন রঙের ঢঙের কথা বলে একটা ছেলে প্রোপোজ করে একটা মেয়েকে। আচ্ছা, প্রোপোজ করলে কী হয়?? ধরলাম, একটা ছেলে প্রথম দেখাতেই একটা মেয়েকে খুব “ভালোবেসে” ফেলল। তারপর ছেলেটা মেয়েটাকে প্রোপোজ করল। ছেলেটা অবশ্যই মেয়েটার কাছ থেকে “হ্যা” শুনতে চায়। তো এখন মেয়েটা যদি “হ্যা” বলে, তার মানে কি এই- যে মেয়েটাও ছেলেটাকে ভালোবাসে ফেলেছে?? কখনোই না। ভুলটা আসলে এখানেই হয়।
মেয়েটা হ্যা বললে ছেলেটা মনে করে, মেয়েটাও বুঝি তাকে ভালোবাসে। তখন শুরু হয়ে যায় প্রেম প্রেম খেলা। পার্কে যেয়ে বাদাম খাওয়া, ফেসবুকে ওয়াল-টু-ওয়াল প্রেমবার্তা আদানপ্রদান করা! কিন্তু দুইদিন পর দেখা যায় যে আসলে মেয়েটাও ভালোবাসে না, ছেলেটাও ভালোবাসে না। তখন ধুমধাম করে ব্রেক আপ! কান্নাকাটি… মেয়ে বলে ছেলেজাত খারাপ, ছেলে বলে সব মেয়ে রাক্ষসী!
কিন্তু এমন হয় কেন? একটা ছেলে যখন একটা মেয়েকে প্রোপোজ করে, এর আসল অর্থ কী? এর আসল অর্থ হওয়া উচিত- “আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই। আমরা কি কিছুটা ক্লোজ হতে পারি? বন্ধুত্ব করা যাক!”
আর যখন মেয়েটা হ্যা বলে, এর মানে হওয়া উচিত- “হ্যা, কাছে আসা যাক, বন্ধুত্ব করা যাক।”
তারপর আন্ডারস্ট্যান্ডিং, তারপর গভীরভাবে একে অপরকে জানা, তারপর যদি ভালোবাসা হয়, তো হবে, নাহলে নাও হতে পারে।
এই জন্য “প্রোপোজ” ব্যাপারটা আমার কাছে পছন্দ হয় না। ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়। এত আয়োজন করা লাগে না।
তাহলে ভালোবাসা কিভাবে হবে?? আমার মনে হয়, একটা সত্যিকারের ভালোবাসা শুরু হয় বন্ধুত্ব থেকে। হ্যা, বন্ধুত্বকে ভালোবাসার সিড়ি বলা যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, আমি এখানে একটা ছেলে ও একটা মেয়ের বন্ধুত্বের কথা বলছি!
কিছু কিছু মানুষকে খুব ভাবের সাথে বলতে দেখি- প্রেমের চেয়ে বন্ধুত্ব বড়! এগুলো দেখে আমার খুব হাসি পায়। আবার তাদের জন্য দুঃখও হয়। আফসোস, তারা নিজের প্রেমিকাকে নিজের বন্ধু ভাবতে পারে না। তাদের কাছে প্রেম আর বন্ধুত্ব দুটো আলাদা বিষয়। কিন্তু আগেই বলেছি, এ দুটোর শুরু একই জায়গা থেকে। শুধু বিস্তৃতিটা ভিন্ন।
একটা ছেলে ও মেয়ে যখন একে অপরের বন্ধু হবে, তখন তারা গল্প করবে, আড্ডা দেবে। এই গল্প আর আড্ডায় উঠে আসবে জীবনের চাওয়া পাওয়া, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির কথাগুলো। উঠে আসবে একান্ত কল্পনা আর লালিত স্বপ্নের কথাগুলো। এভাবেই দিনে দিনে সম্পর্কের ডালপালা গজাবে। দুজন একেঅপরের মাঝে মাঝে খুজে নিতে শুরু করবে সুখ আর হাসি। ভাগাভাগি করে নেবে কষ্টগুলো। তারপর উপলব্ধি করবে যে এই মানুষটাকেই সে এতদিন চেয়েছিল, এই মানুষটাকেই রূপকথার রাজ্যে দেখেছিল। আমার তো মনে হয় এটাই ভালোবাসা।
খেয়াল করুন, এই ভালবাসার মাঝে কিন্তু দৈহিক সৌন্দর্যের কোনো প্রভাব নেই। মেয়ে ফর্সা নাকি কালো, এটা গুরুত্বপূর্ণ না। পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে। চেহারার প্রসঙ্গ এখানে আসবেই না! আমার কী মনে হয় জানেন, মেয়েদের চেহারা আসলে দুই ধরনের। (১) মায়াময় (২) মায়াময় না।
যে আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করবে, তার চেহারায় আপনি অবশ্য একটা মায়া খুঁজে পাবেন। যে আপনার খুব ভালো বান্ধবী, তার চেহারা খুব মায়াময় মনে হবে। সে কালো কিংবা ফর্সা, এটা বিবেচ্য বিষয় না। কারন খুব ফর্সা একটা মেয়ে যদি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, তখন তার চেহারায় আপনি স্পষ্ট রুক্ষতার ছাপ খুঁজে পাবেন। তাকে আর ভালো লাগবে না।
সুন্দরী-অসুন্দরীর ধারনা বাদ দিয়ে যদি এই মায়বতী-অমায়াবতীর ধারনা প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে কালো ফর্সার ভেদাভেদ থাকবে না।
সব ছেলের মা বলবে, “একটা মায়াবতী মেয়ে পেলেই ছেলের বিয়ে দিয়ে দেবো।”
ছেলে তার বন্ধুদের বলবে, “দোস্ত, মেয়েটা অনেক মায়াবতী, তাই না?”
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসবে, “সুযোগ্য ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের জন্য মায়াবতী পাত্রী চাই।”
কোনো কালো মেয়েকে আর তখন বালিশে মুখ লুকিয়ে কিংবা ছাদের কোনায় দাড়িয়ে কাঁদতে হবে না। কালো ফর্সা নির্বিশেষে সবাই তখন রং ফর্সাকারী ক্রীম না মেখে নৈতিকতার শিক্ষা নেবে। বই পড়বে। আচার ব্যবহারে মিষ্টতা আনবে। মায়াবতী হতে হবে তো!
তাই না?? যাই হোক, যা বলছিলাম, সে বিষয়ে ফিরে আসি। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। কিন্তু কেউ যদি কারো সাথে বন্ধুত্ব করে শুধুমাত্র প্রেম করারই উদ্দেশে, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায়?? দাড়ান, বুঝিয়ে বলছি-
মনে করুন, একটা মেয়েকে খুব ভালো লেগে গেল একটা ছেলের। ছেলেটার ভাষ্য অনুযায়ী, সে নাকি মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন ভালোবাসার কথা তো বলতে হবে! কিন্তু এভাবে এত তাড়াতাড়ি বললে তো হবে না! অপরিচিত একটা ছেলেকে ঐ মেয়েটা পাত্তা দেবেই বা কেন! তাহলে কী করা যায়? ছেলেটা সিদ্ধান্ত নিল যে সে মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব করবে। আস্তে আস্তে ক্লোজ হবে। তারপর মনের কথা জানাবে।
আমার মনে হয়, এই ধরনের বন্ধুত্ব আসলে প্রতারণা। হ্যা, প্রতারণা। কারন মেয়েটা ছেলেটাকে বন্ধু ভেবে বন্ধুত্ব করল, সে কিছুই জানল না। অথচ ছেলেটার মনে একটা গোপন ইচ্ছা, বাসনা চুপি চুপি রয়ে গেল। বন্ধুত্বের আবরণে ছেলেটা আসলে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ করতে চায়। তাই এটা অবশ্যই প্রতারণা।
খুব পেচানো হয়ে যাচ্ছে, না?? এত নিয়ম মেনে কি ভালোবাসা হয়?? আসলেই হয় না। “প্রেম করব, প্রেম করব, প্রেম আমাকে করতেই হবে” এমন মনোভাব থাকলে প্রেম করা সম্ভব না। নিজের ক্যারিয়ারে মনোযোগী হোন। সেই সাথে নিজের মনকে খুলে রাখুন। সবার সাথে মিশুন। দিন কেটে যাবে। একদিন দেখবেন, আপনি হাবুডুবু খাচ্ছেন। কোথায় আবার! চেনাজানা কোনো বন্ধুরই প্রেমে! শুধু আপনি একাই না, সেই মানুষটাও হয়তো আপনার প্রেমেই হাবুডুবু খাচ্ছে!
চেহারা দেখে প্রেমে পড়া, Love at first sight এই ব্যাপারগুলো আসলে ভিত্তিহীন। ব্যাপারগুলো হয়তো জীবনকে সাময়িকভাবে মধুময় করে তোলে, কিন্তু সুদূরপ্রসারী ফলাফল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখকর হয় না। (ব্যতিক্রম থাকতে পারে)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন