এইভাবে হ’লে বিনিময়- (শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী)- মিথ্যে না বললেই পারতে ফকির!
- মিথ্যে!
- মিথ্যেই তো! এরপর আর কখনও নীললোহিত টুকে বোলো না, এই ওষ্ঠ বলেছে রঞ্জাকে, ভালবাসি/ এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?
- কোথাও একটা ভুল হচ্ছে তোমার রঞ্জা। কখনও তো মিথ্যে বলিনি তোমায়।
- রঞ্জাবতীর ভুল হয় না ফকির। রঞ্জার নিজস্ব নিখিল যে ফকিরের দিল নগর- সে এই শহরও জানে। এই তিন বছরে রঞ্জার যা কিছু নির্মাণ, সেও ফকিরের নির্মাণ। ফকিরের দিল নগরে বসতি… হয়তো বিশ্বাস করে উষ্ণ, আঁধারে মুখ গুঁজে এই বসতি করাটাই তার ভুল!
- প্লিজ রঞ্জা! কে জানে কোন উড়ো হাওয়ার খপ্পরে পড়েছ তুমি ফের!
- না ফকির, হাওয়াতে ভাসলেও খবরটা দিব্য সত্যি! তবে তোমার ভয় নেই, রঞ্জা পালাবে না কোথাও। শোধও নেব না এর কোনওদিন। কেন না, চিরদিন রঞ্জার ‘শ্রাবণ চায় তোমার বাহুর মৃদু কোণ’। , সেই সুযোগে না হয় একটু বৃন্দার সঙ্গে উড়েছ!
- বৃন্দা! ইশ! মানে ওই বৃ…!! তুই ভুল বুঝলি ফের। হঠাৎ করেই, মানে ওর সঙ্গে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গিয়েছিল সেদিন পার্ক স্ট্রিটে, বিশ্বাস কর। আর সেটা তো তোকে সেদিন রাত্তিরেই স্কাইপে বলেও ছিলাম।
- হ্যাঁ বললি, বললি… কিন্তু অধুরা, সবটা নয়। এতে এত লুকানোর কী ছিল ফকির! বললেই পারতিস, দূরে ছিলাম তো। থেকে যেতাম!
- তুই চুপ করবি পাগলি। তুই কি জানিস রঞ্জু, তুই ছিলিস না শহরে; খুব মিস করেছি তোকে… একা লাগছিল। মানে নানা মুহূর্তে এই ক’দিন একা… একাই তো! নিয়ত বয়ে বেরিয়েছি তোর মৌ-মাখানো স্মৃতির গন্ধ।
- লুকালি কেন তবে ফকির, ওদের মুখ থেকে যে শুনতে হল!
- যেটা তুই একদিন জানবিই, সেটা গোপন করতে যাব কেন… দরকারই বা কোথায়? তেমন তো কিছু ঘটেনি সেদিন।
- মনে পড়লে এখনও কষ্ট হচ্ছে! সকালে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে শুভঙ্কর আর নন্দিনীর সঙ্গে দেখা। সেদিন রাত্তিরে ওই ঢলানি মেয়েটা মদ্যপ হয়ে তোমার সঙ্গে যা যা করেছে, শুনেছি সব। ওদের সামনে লজ্জায়…
- প্লিজ… ! এ ফোঁড়- ও ফোঁড় করে দেওয়ার মতো মিথ্যে রটনা! তুমি তো বিশ্বাস কর ফকিরকে। তোমার মনে হয়…
- মদ্যপ হয়ে তোমাদের বাওয়াল, ট্যাক্সিতে ওঠার সময় ওর … ! শুনেছি সব! নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে। ছাড়ো…!
- রঞ্জা, তুই কি পাগল হলি! এর চেয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে নখের আঁচড়ে ফালা ফালা করে দিতিস বুকের সাতমহলা সুখ। কোথায় একটা কলেজ কাটা ধিঙ্গি মেয়ের সঙ্গে গসিপ বানাবি ফকিরকে নিয়ে! সে নয়, শেষে ওই খিটখিটে বুড়ি বৃন্দার সঙ্গে জড়ালি? ধুর ধুর!
রঞ্জা হাসছে। শতজল ঝর্ণার মতো হাসিতে ভেঙে পড়ছে ও। এই এতক্ষণে মেয়ের মুখে হাসি ফুটল। মেয়েরা এমন পারে! কেবল মেয়েরাই পারে। দীর্ণ-দগ্ধ চৌচির পুরুষকে নিমেষে দিগবিজয়ী সম্রাট করে দিতে পারে মেয়েরাই। ইচ্ছে করছিল, ইচ্ছে করছিল ওকে…! বুঝতে পেরে বলল,
- হয়েছে। চাপ নিস না আর। মুখটা শুকিয়ে গেছে তোর! দুপুরে ঠিক করে খেয়েছিস? এই ক’দিন ফরিদা মাসি ঠিক এসেছিল? দেখি, দেখি সরে আয়… কদিন পরছিস পাঞ্জাবিটা? ধুলো-ঝড়ের মধ্যে ছিলিস বুঝি? কী রে বল…! একেবারে কাঙালের মতো তাকিয়ে আছিস কেন?
- রঞ্জা তুই হাসছিস? এমন সন্দেহবাতিক কী করে হলি তুই। বুকের মধ্যে কান পেতে দেখ- হাপরের শব্দ পাবি। কখনও ঝগড়া করিস না এমনকরে। জানিস তো, কষ্ট হয় খুব ফকিরের।
- তোর মুখ দেখে হাসি পাচ্ছে এখনও, কী করব বল? হিহি!
- হাসতে লজ্জা লাগছে না তোর। মিথ্যে ঝগড়া করে দুঃখ দিস। ঝগড়ুটি।
- কেন তোর সেই পেটেন্ট শুক্তি বললি না আজ!
- শুক্তি!
- ওই হল, শক্তির উক্তি। কি যেন… ওই যে রে… ‘যদি পারো দুঃখ দাও/ আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি/ দাও দুঃখ, দুঃখ দাও- আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি।/ তুমি সুখ নিয়ে থাকো, সুখে থাকো… কী যেন শেষটা…
- বলব না, যা! তুই একটা যাচ্ছেতাই রকমের দস্যি মেয়ে।
- বল না! কী যেন… সুখ নিয়ে থাকো, সুখে থাকো…
- দরজা হাট-খোলা! কিন্তু …
- কোনও কিন্তু না আর। মেঘ করেছে, চল ওঠ! এতদিন পর শহরে মেঘ মাথায় ফিরলাম, কোথায় নিয়ে যাবি কোথাও! বৃন্দা বুড়ির কেস তো, বেশি না। স্রেফ দুটো বিয়ার খাব। বৃষ্টি আসছে, কী রে যাবি তো, চল…!
- কী মুশকিল, ছুটছিস কেন, থাম। পড়ে যাবি। কোথায় যাবি?
- ফেয়ারলন!
- ভিজতে হবে কিন্তু, দাঁড়িয়ে যা একটু। মেঘ-মেদুর কলকাতা ভাসাবে আজ, দেখিস ঠিক ভিজব দু’জন।
কিছু বলার সুযোগ দিল না উড়ুক! নন্দন চত্বর থেকে হাতটান দিয়ে, প্রায় দৌড়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল সটান রাজপথে। দীর্ঘ দুপুর পাখির পিছনে দৌড়ানো যার মজ্জায়, সে কি থামতে পারে!
মোহরকুঞ্জ থেকে রবিঠাকুর ভেসে আসছে, বর্ষার গান। কালাংড়া-ভৈরবীর মিলমিশায় সজল সুর ভাসান, ‘যে রাগিণী গেছে থেমে,/ অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে,/ আজি পূবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে/ কাঁপন ভেসে চলে’। , ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণগগণতলে’।
শহরের বাতাসে বৃষ্টি আসার গন্ধ। সিগন্যালে থমকে চোখে পড়ল কয়েকটা গঙ্গা ফড়িং পার্কের গাছে ওড়া-উড়ি করছে বৃষ্টির সন্ধান নিয়ে। সদর স্ট্রিটের দিকে যেতে যেতে ‘নিবিড় সুখে’ ও বুকের গহনে এল। কতদিন পর গভীরে এল ও, কতদিন! উষ্ণ দিল কবুতর বুকের ছোঁওয়াচে যেন একযুগের উপঢৌকন ওর জন্য। একটু একটু করে বুক থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছে ও সেই সব উজাড় করা উপহার। হঠাৎ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম ওকে,
- তুমি কী করে জানলে ফেয়ারলনের কথা?
- লুসি বলেছে। ওর কাছেই শুনছিলাম ফেয়ারলনের সাবেকদিনের কথা। একসময় বাংলা, বার্মা, বাংলাদেশ, বিহার, ওড়িশা, মেঘালয়ে বাণিজ্যের জন্যই সাগরপারের সওদাগররা এ শহরে তো ভিড় জমাত। ফেয়ারলনের মতো শহরের কিড স্ট্রিট এবং সদর স্ট্রিটের বেশিরভাগ বাড়ির নির্মাণ মূলত সেই সময় আমেরিকান ও ইহুদিদের। সেটা সেই আঠারোশো শতক। ব্যবসা ছিল মূলত বাংলা, হংকং এবং চিনে। এরপর বহু হাতবদলের পর এখন যিনি মালকিন, সেই ভি স্মিথের বিয়েও খাস এই শহরেই, ৪৪-এ। ওঁর মেয়ে জেনির সঙ্গে লুসির নাকি খুব দহরম মহরম।
- লুসি?
- ওর কথা তোমাকে বলা হয়নি। প্লেনে পরিচয়। লুসি ক্লার্ক। ট্রিনিটি কলেজে ইনস্ক্রিপশন নিয়ে কাজ করছে। তোমার দেশ যাবে। শান্তিনিকেতন। ওখানে ক’দিন থেকে ফিরতি পথে এখানে এসে উঠবে। কলাভবনে ওর বোন নোরা পেন্টিং নিয়ে পড়ছে জানো। ও কিন্তু খুব মিশুকে, সুন্দরী আর রসিকা।
- সে আর বলতে, ফকিরে রঞ্জবতীর মতো সু-রসিকা যার সখি!
কথা ফুরোতে ফুরোতে সদর স্ট্রিট। ইলশেগুড়ি বৃষ্টি বাতাসে। তারমধ্য ফেয়ারলনের সদরের ঠিক সামনে থামল ট্যাক্সি। একটু আগে ফেলে এসেছি চার্চ। উলটো ফুটে জাদুঘর। রাস্তার দু’ ধারে গাছ-গাছালির মাথায় শেষ বিকেলের মায়া রঙ আলো এসে পড়েছে। নিভন্ত রোদরঙে মোহময় লাগছে বাইরে থেকে ফেয়ারলনকেও।
খাস পার্ক স্ট্রিট চত্বরের কাছেই এমন সবুজ বনানি, ভাবিনি! সদরস্ট্রিটে এমন আরণ্যক পরিবেশে বিয়ার খাব ভরা শ্রাবণে, সেও ভাবিনি। মূল ফটক থেকেই শুরু হয়েছে পথের দু’ পাশে হাত ধরা ধরি গাছেদের গ্রন্থনা। একটু এগিয়ে বাঁদিকে খানিকটা পঞ্জাবি ধাবা স্টাইলে ছড়িয়ে চমৎকার বসার ব্যবস্থা। ওপাশে মূল হোটেল। রাজকীয় ডাইনিং হল। বিলাস বৈভব।
উঠোনের চাতালে সবুজ ঘেরা বিয়ারখানায় সাহেব-মেম ইতি-উতি বসে। ভিড় এড়িয়ে, টই-টম্বুর অপ্সরীকে নিয়ে বসে পড়া গেল নিরিবিলি টেবিলে। এখানে শুধুই বিয়ার পাওয়া যায়, সুভদ্র টেন্ডার অর্ডার নিয়ে গেল।
মনে হল শহরে এই একটিমাত্র জায়গা, যেখানে ঔপনিবেশিক সৌন্দর্যের সন্ধান মেলে। টেরেসের বাগিচায়, বেডরুম বিলাসে, চানঘরের চন্দন-চর্চায়, সিঁড়ির শৌখিন দেখনদারিতে কিংবা বাগানঘেরা বিয়ারখানায়- সর্বত্র স্মৃতিচারি হওয়া যায়। সেলফোনটা মিউট করে উরু সংলিপ্ত জিন্সের গোপন গহ্বরে চালান করতে করতে রঞ্জা বলল,
- ঠিক পানশালার পরিবেশ নয়, কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট ঠেক জপানো যায় বিয়ারে।
- নিসর্গ শিল্পী জুলিয়ন ব্যারোর নাম শুনেছ? টম স্টপার্ড? অথবা, গুন্টার গ্রাসের নাম তো নিশ্চয় শুনেছ! কে পা রাখেন নি এই বাগানভিলায়? বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত ভ্রমণ লেখক এরিকও এসেছিলেন এখানে।
চোখের হরিণের অন্যমনস্কতা সরিয়ে রঞ্জা চোখ বড় বড় করে বলল,
- তুমি জানতে ফেয়ারলনের কথা! এতদিন জেনেও নিয়ে এলে না! কেন, বাজে একটা লোক! যত সব ফালতু জায়গায় নিয়ে যায়!
হাসতে হাসতে রঞ্জার হাতে হাত রেখে ওর সুগন্ধী শরীরে দীর্ঘ শ্বাস নিলাম। জিন্সের ওপর ফ্যাবের ফিচেল কুর্তি পড়েছে। চোখের কাজলে গহন খাদের ডাক। ঠোঁটে চিরদিনের রিমঝিম নেশা রঙ!
মেঘ ছিল, বৃষ্টিও ছিল ইলশেগুঁড়ি। এখন এল রিমঝিমিয়ে। কখনও ঝমঝম! বিয়ারখানার বাইরে আকাশ কালো করা অন্ধকার। সন্ধে রাতেই যেন তুমুল শ্রাবণের রাত্তির। বিয়ার মগে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে ওকে বললাম,
- সতেরশো একাশি-বিরাশি হবে, না একাশি। শেখ রমজান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ইউরোপিয়ান সাহেব, উইলিয়ম ফোর্ড কিনে নেন এই জায়গা। দু’ বিঘে, তেরো কাঠা, সাত ছটাক। বাড়ি নির্মাণ হয় তিরাশিতে। ১৮০১-তে জর্জ চিজহোম-এর হাতে আসে। বারোতে তিনি স্বর্গত হলে ক্যাপ্টেন স্যার জেমস মাউন্ট কিনে নেন। হাত ঘুরতে ঘুরতে এভাবে একসময়, খুব সম্ভত ১৮৭৩-এ এই অভিজাত বাগান বাড়ির মালিক হলেন স্যর ডেভিড এজরা। এরপর স্মিথ!
ইতিহাস ছুঁয়ে এখনও তাঁর-ই পারিবারিক মালিকানায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এই ফেয়ারলন। … দেখো বৃষ্টি এল তুমুল। তুমি কি একটু সরে বসবে এদিকে? বৃষ্টির ছাট ভিজিয়ে দেবে নইলে!
- না, ফকির। শহরে বহুদিন ভিজিনি। বাতাস তাড়িত হয়ে বৃষ্টির ছাট ভেজালে মন ভাল হয়ে যায়। ভিজি। ফেয়ারলনের কথা কিছুটা আমিও জানি।
- শুনি…
- দীর্ঘদিন এখানে অতিথি ছিলেন, প্রায় ত্রিশ বছর কেন্ডালদের পরিবার। বিখ্যাত সেই ব্রিটিশ দম্পতির একটা ঐতিহ্যগত থিয়েটারের দলও ছিল নাকি। এদেশে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শেক্সপিয়ার অভিনয় করে এরা জীবিকা অর্জন করত। আর কখনও কখনও এই ফেয়ারলনের লাউঞ্জে নাটক করত। এদের মেয়ে জেনিফার। শশী কপূরকে বিয়ে করে যে। সে সময় নব দম্পতির মধু-মিলন হয়েছিল এখানেই! এই ফেয়ারলনে।
- এমন মেঘমন্দ্রিত শ্রাবণ রাত্তিরে মধু-মিলন! ভেবে দেখো, ফকিরের সঙ্গে সেটা এইবেলা সেরে ফেলবি নাকি!
- শ্রাবণের মেঘ কি মন্থর!/ তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে জ্বর/ ছলোছলো/ যে-কথা বলোনি আগে, এ-বছর সেই কথা বলো…!
দিব্য আঁচ পাচ্ছি সদ্য সদ্য সাগরপার থেকে ফেরা ওর শরীরের ঈপ্সিত উত্তাপ! চোখের তারার রতি-রাগ উৎসবের দীপন। ঠোঁটের সন্দীপন। হটাৎ আকাশ পালা ফালা করে বিদ্যুৎলতা! কাছে পিঠে কোথাও কি বাজ পড়ল। ওর তো খুব বাজ পড়লে ভয় করে! বুকের ভিতর আশ্রয় নিল উড়ুক!
নিবিড় করে, বুকের নিভৃতে জড়িয়ে ফকির বলল,
- জানিস রঞ্জা, তুই এই ফকিরকে মারবি কোনদিন। কেন বলিস এই সব লোকজনের কবিতা! কখনও মিথ্যে শয়তানি করিস না, ছোটলোক! ঝগড়া করে খুব ভয় পাইয়ে দিয়ে ছিলিস। লোলো একটা!
ক্রমশ…
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন