তোমার জ্বরের হাতে হাত ছুঁয়ে দিলে মনে হয়
কলেজ গার্ল ফটো

দুজনের একসঙ্গে জ্বর আসত সন্ধেবেলা,/ মোম নিভে গেলে

আবছা সিঁড়ির নীচে এ ওকে জড়িয়ে কাঁপতাম         (পিনাকী ঠাকুর)

কলকাতার যেন জ্বর হয়েছে। ‘যেন’ নয়, সত্যি সত্যি-ই জ্বর! কখনও একাকী তাকে, মানে কলকাতাকে দেখার বাহানায় দেখেছেন? কখনও ইচ্ছে করেনি, নিভৃতে কলকাতাকে দেখতে? যদি উত্তরটা ‘না’ হয়, দোহাই! রৌদ্রদহনে তপ্ত ওর লালি মুখের আলস্যে ভর করে, ওর দিকে একটিবার ভাল করে তাকান। প্লিজ! প্রিয় কলকাতার উড়ো চুল সরিয়ে কপালে, সরগরম আদুল বুকে হাত দিয়ে দেখুন!

দেখবেন, অদৃশ্য থার্মোমিটারে পারা ওঠা-নামা করবে আপনার মনের মন্দরে। ইচ্ছে হলে, রুদ্রতপের সিদ্ধিতে পুড়তে পুড়তে তিলোত্তমার কানে কানে বিষ্ণু দে বলতে পারেন। ‘আমি তো তোমায় বহুদিন চিনি/ তুমি জানোনাকো আছি/ তোমার হাওয়ায় শ্বাস টেনে কাছাকাছি’।

কেন জানি মনে হয়, তিলোত্তমার মতোই ধরন রঞ্জাবতীর। দহনকালে যত দিন যায়, দুঃসহ তাপ ও তপের নিদাঘে যেন ছারখার হয় বালা। এখন যেমন, জ্বরে পুড়ছে ওর অলি-অন্দর। যদি বা কখনও মন্থর মেঘ এসে দাঁড়ায় শহরের আকাশে, তখন কেবল ওর হিয়া উতলা হয়।

এমন দিনে কোথায় যাই রঞ্জাকে নিয়ে নিশিঠেকে? কেবল ঘোর বর্ষা কেন, যেখানে বসে এমন দারুণ দহন দিনেও ‘বলা যায়’! সম্প্রতি বন্ধুনি সুচেতার হদিশ দেওয়া তেমন এক মিউজিক ক্যাফের কথা মাথায় ঘুরছিল। ক্যাফেলা! যতীন দাস রোডের এই কফিখানার কথা লিখতে লিখতে হঠাৎ রঞ্জাকে দেখে শকুন্তলার কথা মনে পড়ল। একইসঙ্গে মনে পড়ল, জ্বরতপ্ত বেহায়া বালিকা শকুন্তলার উদোম শরীরে দিকে তাকিয়ে রাজা দুষ্মন্তর মনে হয়েছিল, এ কী খর দিনের জ্বর, নাকি অন্যকিছু? সাহিত্যের নিবিড় পাঠ বলে, কালিদাসের নায়িকার এই জ্বর, বঙ্কিমের ব্যাখ্যায় চপলা বালিকার ‘বাহানা’!

সুচেতা যেতে বলেছিল, যাওয়া হয়নি ক্যাফেলা। দিন কয়েক আগে নাকি সেখানে গান শুনিয়ে গেলেন লোকশিল্পী দীপান্বিতা আচার্য। গল্প বলেছিল ওখানে বসে বসেই কবিতা থেকে গান হয়ে ওঠার। ওদের সঙ্গে ছিল স্যান্ডউইচ আর কফির কোলাজ! কিন্তু এই গরমে রঞ্জার কি মন উঠবে শ্রবণ-সুখ-শালা ক্যাফেলার কফিতে?

কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’-এর কালে নগরবালিকারা নাকি গরমের দহন জ্বালা সহ্য করতে না পেরে নাগরদের সামনেই স্তনমণ্ডলে চন্দনের প্রলেপ দিতেন। বিলাসিনীরা কেউ কেউ স্তন বৃন্তে দিতেন বেনার মূল বাটা। আর চন্দন রসে চর্চিত স্তনে উশীরের প্রলেপ নিয়েছিলেন সংস্কৃত সাহিত্যের সরলমতি ‘বালিকা’ শকুন্তলা! এখন ভাবি, সে প্রলেপ কি নিছক জ্বর তপ্ত গরম শরীরকে ঠান্ডা করতে, নাকি রাজনকে কাম-বি-বশ করবার ছুতো! থাক সে কথা!

- সকাল সকাল শকুন্তলাকে নিয়ে পড়েছ ফকির?

- তোমার জ্বরের সঙ্গে মেলাতে চাইছিলাম সরলমতি বালিকার বাহানা।

- মিলল!

রঞ্জাবতী যে কখন লেখার টেবিলে ঝুঁকে, পড়ে ফেলেছে শকুন্তলার কথা… ভাগ্যিস মর্যাদার প্রশ্ন তোলেনি মেয়ে। এক্ষুণি বিপর্যস্ত হত নিশি-কথা! লেখা ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ। কেন যে নতুন করে দেখতে ইচ্ছে করে ওকে! হররোজ করে!

রোজ মানে প্রতিদিন। ওর চিবুকের চির-চেনা তিল, চন্দন বনের ডাক পাঠানিয়া ভ্রু-পল্লব, নিবেদন প্রাণ ঠোঁটের সারল্য, চকিত চোখের চিত্রলেখা, আঘাতে-আশ্লেষে অস্ফুটে ব্যথার কানে কানে বলা, ‘ভালোবাসি, শুধু তোকেই ভালোবাসি’- সব তো জানা হয়ে গেছে এই ফকিরের। যা দেখে-জেনে উদাস হয় একটি সম্পর্ক! তবু?

তবু! কেউ কেউ অভিযোগ করে বলে, রঞ্জাকে নিয়ে চাট্টিখানি কাব্যি করলেই নিশিঠেক? না। যদি বলি, পৃথিবীর প্রাচীন নেশার নাম ভালবাসা! সেই নেশার নানা পরত চিনতে চিনতে, কলকাতার এক ঠেক থেকে অন্য ঠেকে যেতে যেতে তাই রঞ্জাবতীকে শুনি। শোনাই চির পিপাসিত এক ইচ্ছের কবিতা। শক্তির ‘ইচ্ছে হতো’ সেই মেয়েটির মনের গহনে নামার। ও শোনে, নেশায় চুরমার করতে করতে শোনে। ‘মেঘের মতো এলিয়ে আছে চুল/ অমন একটি মেয়ের মনে আমার/ ইচ্ছে হতো দুয়ার খুলে নামার’।

রঞ্জার কপালে হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ গরম। হাত পুড়ল যেন! দেখলাম, ফেসবুকে কার সঙ্গে চ্যাটে উপুড় হয়ে রয়েছে মেয়ে। পাশে রাখা নেলপলিশ! ফকিরের লেখা-পড়ার ঘরে এই ডিভানটা ওর খুব প্রিয়। উড়ুক মেয়ের বসত-বাটি, খেলা-ধুলো সব ওখানেই।

- খানিকটা। হয়তো মেলাবেন তিনি মেলাবেন! জানো রঞ্জা, এই শহরের বার-রেস্তোরাঁ, কফিশপের কনসেপ্ট ক্রমশই যেন বদলে যাচ্ছে।

- সেটা কী রকম?

- কফি হাউজের মতো শহরের গুটিকয় তুলকালাম আড্ডাজোনের কথা বাদ দাও। চা-পান সহযোগে বাঙালির চিরচেনা চণ্ডীমন্ডপ বা মোড়ের চায়ের দোকানের নির্মল আড্ডা বা রকের গুলতানি যেন ফিরছে মিউজিক ক্যাফের হাত ধরে।

- মিউজিক ক্যাফে কিন্তু শহরে প্রথম নয় ফকির!

- তা নয়, কিন্তু দল বেঁধে ঠেক মারতে মারতে ইচ্ছে মতো গান-বাজনা করা, কবিতায় কবিতায় মাতিয়ে তোলা, সেটা বেশ ঝিঙ্কু ব্যাপার। এবং অভিনব।

বহুদিন পর, একটা কটকি পড়েছে আজ ও। ছাই রঙের কটকি। শাড়ির জমি জিরেত জুড়ে রুপোর জলকাঠি। আর পাড়ের আকাশ নীল সীমান্ত পেরোলেই লাল-কালোর কটকিয়ানা। শাড়ির ছিপছিপে আঁচলে নিহিত, সান্নিধ্যের একান্ত সুধা-লিপি! স্লিভলেস কটকি ব্লাউজটার লাল-কালো সুতোর চুড়োতেও সেই তৃষ্ণাতুর সঙ্গ-সুধার লিপি। শীলিত আরামে সে লিপিতে মেয়ে যেন সুর-শিথিল স্বরলিপি চাইছে কেবল!

নেলপলিশ পরতে পরতে এফবি-তে টেক্সট করা থামিয়ে রঞ্জা বলল,

- কোথায় বসছে, তোমার এবারের নিশিঠেক?

ফিরে তাকাতেই, চোখ গেল ওর গহন কাজল-কালো চোখে। তাকিয়ে আছে আমার-ই দিকে। মানে, ঘাড় ঘুরিয়ে ওর তাকিয়ে থাকার সেই ঘাই হরিণীর চির-চেনা ভঙ্গি! চোখের ওপরের পাতায় কালচে শ্যাডো। রুপোলি ফিতের নদীরেখা কি সেখানে? হঠাৎ মনে হল, ল্যাপটপের স্ক্রিনের আলোয়-চিক চিক করছে সে রুপোলি রেখা। আজ ফের কপালে লাল টিপ! পিঠে… সারা পিঠে খোলা চুল, ছড়ানো-ভিজে… আধভেজা!

জ্বর নিয়েই একটু আগেই স্নান করেছে ও। সেই ছোট থেকেই জানি, মেয়েদের ভিজে চুলের ভিতর একটা অন্যরকম সুবাস থাকে। হয়তো জীবনের সুবাস! লেখা ছেড়ে ওর চুলে সেই অন্যরকম গন্ধটা, মুষলধারে ভেঙে পড়ে, মাখতে মাখতে বললাম,

- ৫৬, যতীন দাস রোড। ক্যাফেলিয়া!

- প্রিয়ার কাছে? এ মা! এ তো নিজের পাড়া। জায়গাটা ঠিক কোথায় বলো তো?

- একদম। প্রিয়ার সামনে। যুগলসের মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, ওটায় ঢুকে প্রথম বাঁদিকের রাস্তার ঠিক ওপরে।

- হঠাৎ পানশালা ছেড়া কফিখানায় নিশিঠেক?

- নিশিঠেক মানে নলবন যেমন, তেমন তো নিশিঠেক গঙ্গাকিনার-ও! বা বলতে পারো, বারিস্তা যেমন, বার-বি-কিউব-ও নিশিঠেক! যেখানে এই শহরের জনতা ঠেক জপায়, সবখানে চলতে পারে ঠেক! ঠেক জপানোর কি কোনও স্থান-কাল-পাত্র হয়!

- বুঝি বুঝি, সব বুঝি! ক্যাফেলায় বিয়ার বাটার ফিশ ফ্রাই-এর লোভে ওখানে বসছে তোমার নিশিঠেক! তোমার বন্ধুনি কিন্তু এফবি-তে রঞ্জাবতীর মিউচুয়াল ফ্রেন্ড!

দুপুর ফুরিয়ে আসছে। একটু পরেই বিকেল। একসময় মনে হল, রঞ্জার জ্বর বাড়ল! বাড়ল কি? ওর আধভেজা চুলের গহনে হারাতে হারাতে মনে পড়ল পিনাকী ঠাকুরের ‘জ্বর’! তুমুল বৃষ্টির রাতে বাতাসতাড়িতের মতো বললাম,

- তোমার জ্বরের হাতে হাত ছুঁতে গিয়ে মনে হল/ অগম্যাগমন পাপে আমারও কি জ্বর আসবে,/ বেলফুল ছুড়ে ফেলে আজ..

ঠোঁটে আঙুল রেখে থামিয়ে দিল রঞ্জা। বলল ঠিক পরের লাইন,

-দুজনে একবার কাঁদবো সারারাত দুজনকে জড়িয়ে?
 
Top