আজ একটা বিশেষ দিন। বিশেষ দিনটা হল আজ আসিফের বিয়ে। কিন্তু আসিফের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে শেষ মুহুর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে।

- বাবা একটু শুনবে?
-- কি বলবি তাড়াতাড়ি বল। আমি খুব ব্যস্ত।
- বাবা তুমি ওদের সমস্যার কথা খুলে বলেছো তো?
- বলেছি। এক কথা কতবার বলব?
- মেয়েটা কি সবকিছু জেনেশুনে রাজি হয়েছে?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ সব জেনেই রাজি হয়েছে।
- বাবা তুমি মিথ্যে বলছো নাতো?
-- কি এক মুসিবতে পড়লাম। আমার অনেক কাজ আছে আমি উঠি। বিয়ের আসরে বরের বেশি কথা বলতে হয়না জানিস না?
- আমি আগে কখনো বিয়ে করিনি। তাই এটা আমার জানার কথা না।

বাবার কথায় এমন কিছু একটা ছিল যা আসিফের অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আসিফ চিন্তিতমুখে ভাবছে অস্থিরতা কি করে কমানো যায়। যতই ভাবছে অস্থিরতা পাল্লা দিয়ে ততই বাড়ছে।

দেখতে দেখতে কোন রকম সমস্যা ছাড়াই বিয়েটা হয়ে গেল। রুমে ঢুকে আসিফ বিছানায় বসতেই লাবনী বলল, পানি খাব। আসিফ লাবনীর দিকে পানি বাড়িয়ে দিতেই লাবনী এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাস শেষ করে ফেলল। আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, আপনার পায়ে কি হয়েছে? লাবনীর প্রশ্ন শুনে আসিফ বিস্মিত হয়ে গেলো।

- আপনি জানেন না আমার একটা পা খোঁড়া?
-- কি বলছেন এসব?
- ও মাই গড। বিয়ের আগে আপনাকে বলা হয়নি আমার পা খোঁড়া?
-- আপনি খোঁড়া জানলে আমি মরে গেলেও আপনাকে বিয়ে করতাম না।
- সত্যি বলছি আমার কোন দোষ নেই। আমি বাবাকে বার বার বলেছি বিয়ের আগে আপনাকে যেন বিষয়টা জানানো হয়।
-- আপনি আমার সাথে কোন কথা বলবেন না। আপনি একজন মিথ্যুক, প্রতারক। একজন প্রতারকের সাথে কথা বলতে আমার ঘেন্না হয়।
- বিশ্বাস করুন আমার কোন দোষ নেই।
-- আপনার বিশ্বাস আমার জানা হয়ে গেছে। আর শুনুন ভুল করেও আপনি স্বামীর অধিকার ফলানোর চেষ্টা করবেন না। আমি কিন্তু তাহলে চিৎকার দিব। আর আমি আপনাকে ডিভোর্স দিব। একজন প্রতারকের সাথে আমি কিছুতেই সংসার করতে পারবনা। দরকার হলে মরে যাব তারপরও আপনার সাথে আমি থাকব না।
- আচ্ছা আপনি যা চান তাই হবে। তবে প্লিজ ডিভোর্সের বিষয়ে এখনই কাউকে জানাবেন না। তাহলে আরেক হাঙ্গামা শুরু হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে আপনাকে জানাবো।

লাবনী আসিফের কথার জবাব না দিয়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়েছে।


কয়েকদিন পরের ঘটনাঃ

লাবনী রুমে একা। সময় কাটছে না। টেবিলে বই টই কিছু আছে কিনা দেখার জন্য গেলো। খুঁজতে খুঁজতে হাতের কাছে একটা ডায়েরী পেল। ডায়েরী টা মনে হচ্ছে আসিফের। কারো পার্সোনাল ডায়েরী পড়া উচিত না। কিন্তু লাবনী তো চলেই যাবে তাই বিষয়টাকে পাত্তা দিল না। লাবনী ডায়েরীটা পড়তে শুরু করল। এক জায়গায় এসে লাবনীর চোখ আটকে গেল। আসিফ লিখেছে,

বিয়ে হল ছেলে মেয়ে উভয়ের জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন। সে হিসেবে আমার জন্যেও খুশির দিন হবার কথা ছিল। কিন্তু আমি তো সবার মধ্যে পড়িনা। জন্মের পর থেকে আমি সবসময় মানুষের চোখের কাঁটা হয়ে বড় হয়েছি। খোঁড়া বলে সবাই আমার দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। আমার পঙ্গুত্ব নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছে। রাস্তায় হেঁটে যাবার সময় পেছন থেকে ল্যাঙ্গড়া কথাটা কত শত কোটি বার শুনেছি গুনে শেষ করা যাবেনা। খোঁড়া বলে আমার কোন খেলার সঙ্গী ছিলনা। পড়াশুনা জীবনে খুব একটা কেউ মিশতে চাইতো না। সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারিনি বলে জীবনের রেসে সবসময় পিছিয়ে পড়েছি। তারজন্য আমার কোন আফসোস হয়না। যার জন্মই হয়েছে আস্তাকুড়ে পড়ে থাকার জন্য তার মুখে আফসোস কথাটি মানায় না।

রুমে ঢুকে লাবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল আমার জীবনের সব অপূর্নতা এক নিমেষে পূরন হয়ে গেছে। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার পিছু ছাড়ল না। লাবনী সাফ জানিয়ে দিল সে আমার সাথে থাকতে চায়না। আমি একজন মিথ্যুক, প্রতারক। ওকে আমি কি করে বোঝাই আমি সত্যিই ওর সাথে কোন প্রতারনা করিনি। বিয়ের আগে বার বার বাবাকে বলেছি পাত্রীকে যেন আগে থেকেই সবকিছু জানানো হয়। লাবনীর পরিবার সবকিছু জানলেও শুধুমাত্র লাবনীর কাছে পুরো বিষয়টা গোপন রেখেছে। সবাই ভেবেছিল বিয়ে হয়ে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

লাবনী চলে গেলে খুব কষ্ট হবে। রাতে এক রুমে ঘুমাই কিন্তু দুজনের মধ্যে কোন কথাই হয়না। ঘুমের মধ্যে ওর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ভোর হয়ে যায় টের পাইনা। ওর সাথে কথা বলতে হবেনা শুধুমাত্র ওর মুখ চেয়ে যদি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম তবে আমার চেয়ে সৌভাগ্যবান বোধহয় পৃথিবীতে আর কেউ হত না। ও চলে গেলে খুব কষ্ট হবে। হোক কষ্ট। একজন প্রতিবন্ধীর সাথে থেকে ওর জীবনটা নষ্ট করার কোন মানে হয়না।

এতটুকু পড়ার পর লাবনী ডায়েরীটা করে দিয়েছে। ঠিক এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। আসিফ রুমে ঢুকতেই বলল, ডিভোর্সের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক। আমি আপনাকে উকিলের কাছে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসুন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

আসিফ এবং লাবনী উকিলের সামনে বসে আছে। আসিফ কাগজপত্র সবগুলোতে সাইন করে লাবনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। লাবনী সাইন করতে গিয়ে টের পেল ওর হাত একটু যেন কাঁপছে। একটুক্ষন থেমে লাবনী নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত সাইন করে কাগজপত্র উকিলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

রাস্তায় নামতেই আসিফ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি নিজেই বাসায় যেতে পারবেন নাকি আমি নামিয়ে দিয়ে আসব? এই কথা শুনতেই লাবনীর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলেটা এত ভালো কেন? এই ছেলেটা এত ভালো বলেই চুপচাপ সবকিছু মেনে নিচ্ছে। মানুষকে এত ভালো হতে হয়না। মানুষকে অনেক স্বার্থপর হতে হয়। যা চায় তা না পেলে আদায় করে নিতে হয়। আসিফ যদি ওকে একবার শুধু বলত, প্লিজ লাবনী যেওনা। আমি খুব একা হয়ে যাব। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে। তাহলে লাবনী কখনো ওকে ছেড়ে যেতে পারত না।

আসিফ আবার বলল, কথা বলছেন না কেন? লাবনীর এখন আসিফের উপর প্রচন্ড রাগ লাগছে। সে ডিভোর্স পেপার একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে।

- আহ করছেন কি? ছিঁড়ছেন কেন?
-- তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? আমার যা মন চায় তাই করব। সারাক্ষন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? রিক্সা ডাকো। বিয়ের পর আমরা কোথাও বের হইনি। আজ দুজনে মিলে কিছুক্ষন রিক্সায় ঘুরব। তারপর একসাথে লাঞ্চ করে বাসায় যাব।

আসিফ গভীর বিস্ময়ে লাবনীর দিকে তাকিয়ে আছে। এত খুশি মনে হয় সে জীবনে হয়নি। তপ্ত দুপুরে হুড ফেলে দুজনে রিক্সায় ঘুরছে। লাবনী আবোল তাবোল বকবক করে যাচ্ছে। আসিফ চোখ বড় করে করে লাবনীর কথা শুনছে। কেউ জানেনা আসিফ নামক পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যমান মানুষটা এই মুহূর্তে তাদের পাশ কাটিয়ে রিক্সায় করে চলে যাচ্ছে।
 
Top