ভালোবাসা ছেলেটার ক্যান্সার সে কথা খুব ভালো করেই জানে নিশি তবুও কেন যেন ছেলেটার প্রতি কোথায় যেন খুব একটা টান অনুভব করে সে, ছেলেটা তার বান্ধবী নাইমার ছোট বেলার বন্ধু। নাইমার জন্মদিনের দিন পরিচয় হয়েছিল ছেলেটির সাথে। একাই মাতিয়ে রেখেছিল পুরো ঘর, কখনো গানের সুরে, কখনো হাসি ঠাট্টায়। ছেলেটি কেন যেন সবাইকে একটু এড়িয়ে চলতে চাইতো সারাটি সময় নিজেকেই নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। নিশি কেন সবার ই মনে হত ছেলেটার অনেক বেশী অহংকার, ছেলেটার থেকে ফোন নাম্বার চেয়ে না পেয়ে খুব রাগ হচ্ছিল নিশির, প্রচন্ড অপমান বোধ করছিল।

প্রতি সপ্তাহে নাইমার বাসায় গিয়ে একদিন গিয়ে পুরো বিকেল ছাদে কাটানো নিশির রুটিনে পরিণত হয়েছিল, কোন ভাবেই ছেলেটাকে আকর্ষণ করতে পারলো না। একদিন রাগে নাইমাকে বলেই বসে তোর দোস্তের এত অহংকার কিসের? তার জন্যে কি চাঁদ থেকে রাজকুমারী আসবে নাকি? নাইমা কিছু একটা বুঝে যায়,

- নিশি তুই কি ওকে পছন্দ করিস?
-হুম, তোর দোস্তকে ভালোবেসে ফেলছি।
-নিশি !

ঝাকি দিয়ে নাইমা নিশি কে বলে তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? তোর দোস্তের প্রেমে পাগল হয়ে গেছি বলেই হাসতে শুরু করে। স্রস্টা হয়তো চায়নি তার মুখে হাসিটা স্থায়ী করতে।

যখন সবটা নাইমার থেকে শুনে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যেতে থাকে, কত গালমন্দ করেছে ছেলেটাকে, কত কি উল্টা পালটা ভেবেছে !

কথাটা জানার পর আজ তিন দিন পার হয়ে গেছে তবু মনের ভেতর একটা ঝড় বয়েই চলেছে, ছেলেটার প্রতি দুর্বলতা ক্রমেই যেন বেড়ে চলেছে। নাইমার বাসায় আসে নিশি উদ্দেশ্য একটাই রেজার সাথে দেখা করা। নাইমাকে রাজি করিয়ে রেজার বাসায় গিয়ে জানতে পারে, রেজা মাঠে গেছে। দেরী না করে চলে গেল মাঠে। কলোনির মাঠ বাসার সামনেই বলা চলে, বেশ বড়। মাঠের এক পাশ বেশ বড় একটা পুকুর আছে। পুকুরের কাছাকাছি বসে আছে রেজা। ঘাসের ডগা ছিঁড়ছে আর ক্রিকেট খেলা দেখছে, একসময় সেও খেলত। ফাস্ট বোলিং করত, কতজনের স্ট্যাম্প উড়িয়েছে হিসেব নেই। সেবারের নাজমুল ভাইদের সাথে সেমিফাইনালের ম্যাচ টাই শেষ ম্যাচ, আর কখনো দৌড়ান হয়নি এই মাঠে। আরও কত কি ভেবে চলেছে রেজা, ভাবনায় ছেদ পড়ে পিঠের উপর নাইমার দেয়া চাপড়ে... ঘাড় ঘুরিয়েই “কিরে তোরা?”

নিশি চুপচাপ মুখোমুখি বসে পড়ে, পাশ দিয়ে নাইমা। “কিরে কথা বলছিস না কেন? তোরা এখানে কেন?” “তোর সাথে আড্ডা দিতে আসছি, সমস্যা?” বেশ ঝাঁঝালো উত্তরে কিছুটা চুপসে যায় রেজা, সামলে নিয়ে বলে “কি বলবি বল” এবার মুখ খোলে নিশি...

- আপনাকে দেখতে এলাম
- আমি কি বাঘ না ভালুক যে দেখতে এলেন?
- আপনাকে দেখলে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার দরকার পড়ে না, টাকা বেচে যায়
- কি বলতে চান?
- হিব্রু ভাষায় তো কিছু বলি নাই
- আপনার সমস্যা টা কি? সেই শুরু থেকেই দেখছি আপনি আমার পিছে লেগে থাকেন, এমন করেন কেন?
- আপনাকে ভালো লাগে তাই

নিশির নির্লিপ্ত উত্তরে হতবাক রেজ। এমন সময় বল এসে পড়ে তাদের মাঝখানে, বল নিতে আসা ছেলেকে সে কি ঝাড়ি নিশির !

- এতো সাক্ষাৎ ডাইনি (বিড়বিড় করে)
- কিছু বললেন?
- নাহ আপনাকে কিছু বলার ঠ্যাকা পড়ে নাই আমার
- আমার ঠ্যাকা পড়ছে
- আপনার ফোন নাম্বার দেন
- আমার কোন ফোন নাই, ফোন ব্যবহার করি না
- তাইলে যোগাযোগ করবো কিভাবে?
- আমার সাথে যোগাযোগ করার কি দরকার?
- সেটা যোগাযোগ করার পর জানবেন, এইটা আমার নাম্বার, ফোন দিয়েন কথা আছে...

নাম্বার লেখা কাগজ পুকুর পাড়ে ফেলে আসে রেজা, ৭দিনের মত চলে যায়, নিশি কোন ফোন পায় না। বিদ্যুৎ চলে গেলে রেজা পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসে, পা ডুবিয়ে রাখে পুকুরের পানিতে। সেদিন রাতে নিশি থেকে যায় নাইমাদের বাসায়। বাসা থেকেই পুকুর কিছুটা দেখা যায়। সন্ধ্যা হতেই নিশি দোয়া শুরু করে যেন তারতারি বিদ্যুৎ যায়, আর মনে মনে হাজারটা গালি দিতে থাকে কেন এখনো বিদ্যুৎ যায় না অথচ বিদ্যুৎ গেলে আগে গালি দিত ! রেজাকে পুকুর পাড়ে বসতে দেখেই চুপে চুপে হাজির হয়ে যায় নিশি, সাথে বরাবরের মত নাইমা। রেজার পাশে সেও পানিতে পা ডুবিয়ে দেয়, রেজাকে অনুকরন করতে থাকে, রেজা যা করে সেও তাই করে। বিরক্ত হয়ে রেজা উঠে গিয়ে কিছুটা দূরে বসে, নিশিও উঠে গিয়ে পাশে বসে। আর ধৈর্য রাখতে পারলো না রেজ-

- আপনার কোন বাড়া ভাতে আমি ছাই দিছি, এমন করেন কেন আমার সাথে?
- ছাই দিছেন মানে ! কিছু বাকি রাখছেন নাকি !
- কি করলাম আমি ! বিস্ময়ে গলার সুর পালটে গেছে রেজার।
- ফোন দিতে বললাম দিলেন না যে?
- আমার ফোন নাই
- আপনার রুমেই তো একটা টি এন্ড টির কানেকশন আছে
- ওইটা বাসার
- কল দিলেন না কেন?
- নাম্বার ছিল না
- দিয়ে গেলাম যে?
- হারিয়ে গেছে
- তাহলে টি এন্ড টির নাম্বার দেন
- ওটার নাম্বার দেয়া যাবে না
- আমার নাম্বার এখানে, আজ রাতে যেন কল পাই !

আর কথা বলার সুযোগ হল না, বিদ্যুৎ চলে আসছে, শালার কারেন্ট গেলে আসার নাম থাকে না, আজ শ্বশুর বাড়ি গিয়েই দৌড় ! রাগে কটমট করতে করতে উঠে চলে যায় নিশি ! যাওয়ার সময় হাত নেড়ে যায় রেজার দিকে ।

রাতে ফোন করে রেজা, কাঁপা কাঁপা গলায় হ্যালো বলতেই ঝাড়ি !!

- ভাত খান নাই নাকি? এত দেরী কেন? আরেকটু হলেই ঘুমিয়ে পড়তাম
- কার্টুন দেখছিলাম, রুমে এসে ফোন নাম্বারের কাগজ দেখে মনে পড়লো
- আপনার মন থাকে কই?
- জানি না
- জানেন না কেন?

গল্প এগিয়ে চলে... নিশি বন্ধুত্ব করতে চায় কিন্তু তার দুর্বলতা রেজার কাছে গোপন থাকে না, রেজা বুঝতে পেরে যায় মেয়েটা থাকে পছন্দ করে, জীবনের শেষ বেলায় এসে কাউকে নিয়ে নতুন ভাবনা চিন্তা করার অবকাশ নেই, অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে আসছে, ডাক আসবে বলে, ডাক্তারদের মতে আর বড়জোর মাস খানেক। নিশির দুর্বলতাকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয় না রেজা। নিশিও বলতে পারে না, বললে যদি ভাবে সে রেজার প্রতি অনুগ্রহ কিংবা সিমপ্যাথি দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে নিশির ইচ্ছে করে রেজাকে নিয়ে দূরে পালিয়ে যেতে যেখানে যমদূত আসতে পারবে না।

সমুদ্র রেজার খুব পছন্দ, সমুদ্রের পাড় ধরে রাতের বেলায় খালি পায়ে ভেজা বালিতে হাটতে খুব ভালো লাগে তার, ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ভেজা বালিতেই হাটুর উপর মুখ রেখে বসে দূরের সমুদ্র দেখে, দূরের জলযান গুলোর মিটি মিটি আলো তার ভালো লাগে। রেজার খুব ইচ্ছে করে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরে বেড়াতে। একটা মাত্র ছেলে তার, সমস্ত টাকা পয়সা দিয়েও ছেলের বাচার সময় দুটো দিন ও যদি বাড়াতে পারতেন। তা হবার নয়। ছেলের ইচ্ছে পূরণ করতে নিয়ে যাবেন ছেলেকে।

রেজা নিশিকে ফোন করে, বলে আজ দেখা করবে বলে। কিছু ফুল আর আর একটা কিট-ক্যাট নিয়ে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে। নিশি চুপ করে এসে পাশে বসে। বাতাসে উড়ছে নিশির চুল গুলো। মাঝে মাঝে চুল গুলো উড়ে এসে পড়ছে মুখে। বাতাসে পুকুর পানি দোল খাচ্ছে যেন, সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে রেজা। নিশির দিকে না তাকিয়ে ফুল আর চকলেট দিল রেজা, পানির নড়াচড়া দেখে চলেছে।

- পানিতে কি দেখেন এত? কোন বিশ্ব সুন্দরীকে দেখছেন বুঝি??
- না, আপনাকেই দেখছিলাম
- তা পাশে বসে আছি, ঘাড় ঘুরিয়ে না দেখে, পানিতে দেখছেন ! আলসেমি না লজ্জা !
- কোনটাই না, আমার কাছে সময় খুব কম
- আপনি আমাকে ভালবাসেন তাই না?
- জানেন যখন, জিজ্ঞেস করেন কেন?
- কেন ভালবাসলেন?
- জানি না যে
- যাই হোক, আমার সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জানেন না, জানলে এমন হত না
- জানি, সবটা জানি।
- তাহলে?
- নিজেকে মানাতে পারি নি
- গত পরশু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, আর বড়জোর মাস খানেক। আমি আজ রাতে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।
- কোথায় যাবেন?
- সমুদ্রের পাড় আমার খুব ভালো লাগে, কক্সবাজারের ওদিকে চলে যাব।
- কবে ফিরবেন?
- আর ফিরবো না, বাসার সবাই যাচ্ছি, বাকি দিন গুলো ওখানেই কাটাবো

জলে চোখ টল টল করছে নিশির, দু এক ফোটা চোখের কোনা বেয়ে নেমে আসছে। টুপ টুপ করে করে জল পানিতে পানিতে মিলিয়ে যেতে থাকে।

- আমাকে সাথে নেবেন?
- হাতে সময় নেই, সময় থাকলে পুরো জীবনের জন্যেই সাথে রেখে দিতাম
- আমাদের আর দেখা হবে না?
- না, এটাই শেষ দেখা।

চলি, ভালো থাকবেন... বলে হাটতে শুরু করে রেজা। নিশির মনে হচ্ছিল একবার হলেও পেছন ফিরে তাকাবে কিন্তু তাকালো না রেজা। অহেতুক মায়া বাড়িয়ে লাভ কি। পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখে রেজার চলে যাওয়া, নিশির অশ্রুধারা জলে মিলিয়ে যেতে থাকে, বাতাসে শুকিয়ে যেতে গাল বেয়ে নামা অশ্রু ধারা। যে প্রেম শুরু না হতেই শেষ তার ক্ষত না কাদিয়ে কি পারে !! সে রাতেই রেজারা চলে যায়।

সমুদ্রের পাড়ে হাটুর উপর মুখ রেখে ভেজা বালিতে বসা রেজা, ঢেউ এসে অনেকটা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সূর্য অস্ত নামছে, খানিকটা ডুবতে বাকি। লাল আলোয় অন্য রকম সব। ঠিক যেন রেজার জীবনের মত খানিকটা আছে শেষ হবার অপেক্ষায়। জিহ্বায় নোনা স্বাদ পাচ্ছে রেজা, চোখের জল না সমুদ্রের পানি বোঝা গেল না। হয়তো জীবনের অপূর্ণ ইচ্ছা, রয়ে যাওয়া আক্ষেপ কিংবা প্রিয় মুখ গুলো কিংবা নিশি কিংবা বাবা-মা কিংবা সবার কথাই মনে পড়ছে রেজার... অল্পকিছু সময় বাকি আঁধার নামতে, প্রকৃতির আঁধার আর জীবনের আঁধার যেন এক সুত্রেই গাঁথা। ঢেউয়ের পর ঢেউ পা ভিজিয়ে চলেছে রেজার। একসময় অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে আসে সব দৃশ্যপট।

[[ সাধ আর সাধ্যের তফাৎ থেকেই যায় তবুও জীবন এগিয়ে চলে নিজ গতিতে। আজ যাকে ছাড়া জীবন অচল কাল হয়তোবা তাকে মনেও পড়ে না। সেই লাইন টাই বলা যায় আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। সবার স্বপ্ন পুর্নতা পাক।
 
Top