একটু পরপরই দৃষ্টি চলে যাচ্ছে বাড়ির সামনের রাস্তায়।ঝিরেঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার পথঘাট।নদী জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আসাদের অপেক্ষায়।পাঁচটায় অফিস ছুটি হয়।আজকে একটা বিশেষ কাজ আছে।এত্তোক্ষণে তো ফিরে আসার কথা।এদিকে বৃষ্টি থামার নাম নেই।ভিজে না যায় বেচারা,ছাতাটাও ফেলে গেছে।নদী মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য ঘরের টুকটাক কাজে মন দেয়।পরিপাটী করে বিছানা
সূর্য
গুছায়,বিকেলের নাস্তার জন্য পাকোড়া ভেজে রাখে।আসাদ আর নদীর বিয়ের মাত্র তিন মাস পেরিয়েছে।খুব সাদামাটা ঘরোয়া আয়োজনে সম্পন্ন হয়েছে বিয়েটা।আসাদ অনুরোধ করেছিল বেশী কিছু না করার জন্য।তখনই বুঝতে পেরেছিল নদী আসাদ আর দশজনের চেয়ে আলাদা।অবশ্য প্রথম দেখাতে তাকে বেত হাতে নেয়া স্কুলের রাগী হেডমাস্টারই মনে হয়েছিল।খুব গম্ভীর হয়ে বসছিল আসাদ।তারপর কি মনে হঠাত্‍ তাকিয়েছিল নদীর দিকে।কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিল নদী।কী যে মায়াময় শান্ত একজোড়া চোখ,নদীকে সারা জীবন আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট।মনে পড়ে বাবার সেই আশ্বাসবাণী "তোর ছোট চাচার স্টুডেন্ট,বাবা মা কেউ বেচেঁ নেই রে।অনেক কষ্ট করে মানুষ হয়েছে। বড় ভালো ছেলে।মা তুই সুখেই থাকবি।"

এভাবেই তাদের সংসার জীবনের শুরুটা।এতোদিনে নদী একটু একটু বুঝতে শিখেছে আসাদকে।নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে আসাদ।

সেদিন কথায় কথায় নিজের সমুদ্র প্রীতির কথা আসাদকে বলেছিল নদী।সমুদ্রের বিশালতা ছোট থেকেই তাকে খুব আকর্ষণ করতো।নদী প্রত্যেক ছুটিতে বাবার কাছে সমুদ্র ভ্রমনের বায়না ধরত।পড়াশোনা পরীক্ষা আর সংসারিক ঝামেলায় কখনও যাওয়া হয়ে উঠেনি ।তখনই আসাদ ঠিক করে ফেলে তারা হানিমুনে কক্সবাজার যাবে।এবারের বোনাস আর সাথে কিছু জমানো টাকায় ব্যবস্থা হয়ে যাবে।আজকে বাসের টিকিট কেটে আনবে আসাদ।এই নিয়ে হাজার কল্পনার খেলা চলে নদীর মনে।ওপরে সুবিশাল আকাশ আর নীচে অবারিত জলরাশি।বালুকা বেলায় নদী খালি পায়ে আসাদের হাত ধরে হাটবে।সমুদ্রের ঢেউ আলতো করে পা ছুয়ে যাবে।ঢেউয়ের গর্জনের ফাঁকে তারা মিষ্টি প্রেমের গল্প করবে।আর আসাদের সাথে অনেক দুষ্টুমি করবে নদী।পানি ছোড়াছোড়ি করবে,ঢেউর সাথে লাফিয়ে পডবে,সাগর পাঁড়ের ঝিনুক কুড়োবে।হ্যাঁ এবার আসাদের বাইরে খোলস ভেঙে ভেতরের ছেলেমানুষীটা বের করে আনার চেষ্টা করবে নদী।অবশেষে দুজনে হাতে হাত রেখে সূর্যাস্ত দেখে তবেই বাড়ি ফিরবে।

"ঐই ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায়
আমার ইচ্ছে করে
আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায়
তোমার হাতটি ধরে..."

আনমনে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠে নদী।
টুং টাং করে কলিংবেলটা বেজে উঠে ।নদী একছুটে দরজা খুলে দেয়।বৃষ্টিতে ভিজে কপালে চুলগুলো লেপ্টে আছে,হাতে একরাশ বেলী ফুল।তবে আসাদের মুখটা কেমন যেন মলিন।ফুল দেখে খুশি হয় নদী।আসাদের মনেও তাহলে ভালোবাসার সাড়া পড়ে গিয়েছে।ব্যস্ত হাতে তোয়ালে দিয়ে মাথাটা ভালো করে মুছিয়ে দেয়।
--যাও কাপড় বদলে আসো।আমি চা করে আনছি।
--একটা কথা ছিল।(আমতা আমতা করে বলে আসাদ)
--ভালো কথা।কয়টার বাসে টিকিট কেটেছো?আমার গোছগাছ এখনও বেশ বাকী।
--নদী তোমার সাথে কথা বলা জরুরি।
আসাদ হাত ধরে টেনে এনে নদীকে পাশে বসায়।
--নদী সকালে ফেসবুকে দেখলাম আমার বন্ধুরা পোষ্ট করেছে।ঝড়ে আমাদের স্কুলের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।গাছ ভেঙে পড়েছে,স্কুল ঘর ধ্বসে গেছে,অনেক পুরোনো তো।গায়েঁর বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না।ওরা সবাই সাধ্যমত সাহায্য করছে।আমি বলি কি এবার আমরা নাই বা গেলাম।টাকাটা স্কুলের জন্য দিয়ে দেই।আব্বা সারা জীবন স্কুলটা নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন।আমার পড়াশোনা ওখান থেকেই শুরু।কত স্মৃতি আছে স্কুলটাকে ঘিরে ।কিন্তু তোমার এতদিনের স্বপ্নটা..

বলতে বলতে আসাদের গলাটা আবেগে বুজে এল ।
এক মুর্হূতের জন্য নদীর খুব খারাপ লাগলো ।কত স্বপ্ন সাজিয়েছিল সে আনমনে।একটু পরেই আবার পরিবর্তন
--আমার স্বপ্নতো পূরণ হবেই আসাদ!তবে স্বপ্নটা বদলে গেছে।
--মানে?
--আমার মনে হয় সূর্যাস্ত দেখার চেয়ে সূর্যোদয় দেখতে বেশী ভালো লাগবে।গাঁয়ের ছোট ছেলে মেয়েরা আবার স্কুলে যেতে পারবে।ওদের প্রত্যেকের জীবনে একটা করে নতুন সূর্যের উদয় হবে।ওরা জীবনের পথে এগিয়ে যাবে।সেই দৃশ্যটা নাহয় তোমার হাত ধরে দেখে নিবো।
--জানো নদী বাবা আমাকে বলতেন,ছোট ছোট ত্যাগ জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।আর

তোমাকে আমি সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দুটোই দেখাবো।প্রমিস।তুমি দেখে নিও।
আসাদ নদীর হাতটা মুঠোয় পুরে নেয়।তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক।
অদ্ভুদ এক অজানা অনূভুতিতে ভরে উঠে নদীর মন।নিজের ছোট স্বপ্নটা ভেঙে যদি অনেক গুলো জীবনে স্বপ্ন সাজানো যায়,মন্দ কি?সাথে গর্বে বুকটা ভরে উঠে।জীবনের চলার পথে নদী একজন খাঁটি মানুষকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে।দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখের কোণ বেয়ে।এই অশ্রুবিন্দু স্বপ্ন ভাঙার বেদনায় নয়।স্বপ্ন গড়ার আনন্দের।নদী আসাদের বুকে মাথা রেখে হার্টবিটের শব্দ শুনে।এইতো সে বেশ শুনতে পাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন।আর বৃষ্টি ভেজা আসাদ,নদীকেও ভিজিয়ে দেয় পরম মমতায়।
 
Top