ভালোবাসা ভালোবাসা
লিখেছেন- নিঃসঙ্গ সারথি
তারিখ-৩০/০৬/২০০৮ হঠাত ই আমার গলা জড়িয়ে ধরল অঙ্কিতা। বাইরে যে খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এতক্ষণ খেয়াল ই করিনি। বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে ভয় পেয়েছে, ওর মায়ের মত। বিদ্যুৎ চমকালে লাবণ্য আমার বুকের মধ্যে মাথা লুকাতো, অঙ্কিতাও লুকায়। আমি আগলে রাখি, যেভাবে ওর মা রাখত। ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝতেই পারিনি। কিন্তু এমন তো কখনও হয় না, ওকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর আমি ঘুমায় ঠিক ওর মা যেমন করত। লাবণ্য ওকে ঘুম পাড়াতো, আর আমি দরজায় হেলান দিয়ে দেখতাম মা মেয়ের এই মুহূর্ত গুলো। মাঝে ক্যামেরাটা দিয়ে ফ্রেমে বন্দী করে রাখতাম। মেয়ে যখন বড় হবে মা মেয়ে আমি একসাথে বসে সেগুলো নিয়ে মজা করব, আনন্দ করব। কিন্তু ঘুমানোর ব্যাপারটা আজ যেন একটু উল্টো হয়ে গেলো, অঙ্কিতাই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে আজ। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, একটুও ঘুমায় নি ও। জিজ্ঞাসা করলাম “আম্মু এখনও ঘুমাওনি কেন? ঘুম আসছে না?” আমাকে অবাক করে দিয়ে লাবণ্যর উত্তরটাই ও দিল, “তোমার ঘুমানো দেখছিলাম।” আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম ওকে...ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো, আমার অঙ্কিতা।

......................................................................তারিখ-১০/০৭/১৯৯৯ বৌকে ভালবাসবো বলে সত্যিকারের প্রেম এখন পর্যন্ত কখনও করিনি। সত্যিকার প্রেম এই জন্য বললাম যে, ভার্সিটিতে তো কত মেয়েকেই ভাল লাগে হয় তারা ব্যাচ-মেট অথবা জুনিয়র,তবে বাদ পড়েন না সিনিয়ররাও। আর বন্ধুরা সাথে থাকলে তো মেয়ের আপাদমস্তক বিচার হয়ে যায়, যেন আমরা ওখানে সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে গেছি। ভালো তো লাগতেই পারে, তাই না? বয়স তো আর কম হল না।

....................................................................তারিখ-১৪/০৯/২০০১ মাস্টার্স শেষ করে বের হতে হতে চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছি। পরিবারে আমার দাদা, পর-দাদা, আব্বু, চাচ্চু, কাকু সবাই উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও কেউ চাকরির ধার ধারেননি, সবাই ব্যবসায়ী। মাত্র ৯ টা দরখাস্ত ড্রপ করেই এতো সহজে চাকরি একটা পেয়ে যাবো, ভাবিনি কখনও। সোনালী ব্যাংকে। সিনিয়র অফিসার। APPOINTMENT LETTER পেয়ে সবাইকে মিষ্টিমুখ করার পর বিকেলে যখন নিজের রুমে শুয়ে নিশ্চিন্ত-মনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছি, আম্মু আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আব্বু আর কাকুকে বলছে, “আমি আর একা একা সবার জন্য খাটতে পারব না।” আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি, দেখি কাকু জোরে জোরে হাসতে শুরু করেছে। তখন বুঝলাম “বাড়িটা আসলেই কেমন যেন ফাকা ফাঁকা লাগছে, নতুন একটা মানুষ দরকার।” অনেক বড় হয়ে গেছি দেখছি।

....................................................................তারিখ-২৭/০৩/২০০২ পাত্রী দেখতে গেছিলাম আজ। যখন সামনে এসে বসলো, আমি এক পলক তাকিয়ে আর তাকাতে পারিনি। হয়ত সে ধবধবে ফর্সা নয়, কিন্তু চোখদুটো এতটাই মায়াবী যে, আমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে নিমিষে পড়ে ফেলতে পারবে। বাসায় ফেরার পর কাউকে কিছু বলতে হয়নি, যে যার মত বুঝে নিয়েছে, এক ফাকে আমার ফিচকে কাকাতো বোন এসে মেয়েটার মোবাইল নম্বরটাও দিয়ে গেলো, আর নাম বলে গেলো লাবণ্য। দিব না দিব না করেও শেষ পর্যন্ত ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে হ্যালো বলার পর মনে হল, THROAT BLOCK হয়ে গেলো আমার। ভাল মন্দ জিজ্ঞাসা করেই রেখে দিলাম ফোনটা। কণ্ঠটাও এতো সুন্দর কেন ওর? লাবণ্য নাম টা যেন একেবারে ওর জন্য সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ দেয়া ছাড়া আমার আর কিছুই বলার নেই।

..................................................................তারিখ-১৭/০৪/২০০২ গতকাল লাবণ্যর সাথে বিয়ে হল। মহা-ধুমধামে কিনা জানি না, বিয়ের আসরে সারাক্ষণ আমি ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। বিয়ের পর যখন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য গাড়িতে ওঠানো হচ্ছিল, ও এত বেশি কান্না করছিলো যে আমারই মায়া লাগছিল। তখন ই PROMISE করেছিলাম, এরপরে আর কখনও ওর চোখে পানি আসতে দিব না। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন বাসর ঘরে ঢুকলাম, লাবণ্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ওর সামনে বসে ঘোমটা টা টেনে নামিয়ে দিলাম, অপরূপা লাগছে। হাত টা ধরে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বললাম, “পাশে থাকবে তো সবসময়?? আমার এক পলক তাকিয়ে উপর নিচে মাথা নাড়ল ও।”

...................................................................তারিখ-০৮/০৮/২০০৬ গতকাল অঙ্কিতার ৩য় জন্মদিন ছিল। আশেপাশের প্রতিবেশী থেকে শুরু করে কে ছিলনা সেখানে সেটাই বোঝা মুশকিল। রাত্রে অঙ্কিতাকে ঘুম পাড়ানোর পর লাবণ্যকে কেমন যেন একটু বিষণ্ণ মনে হল, পরক্ষনেই তা আবার লুকিয়ে ফেললেও আমার চোখ এড়াইনি। আমি জিজ্ঞাসা করলেও বলল কিছু না, একটু মাথাটা ঘুরে উঠেছে। আজ অফিসে হঠাত মায়ের ফোন। “বাবা, একটু বাসায় আয় তো, বৌমার শরীরটা ভালো না। মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।” আমি বসকে জানিয়ে চলে এলাম সোজা বাসায়, দেখি আমার লাবণ্য মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আমি তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিছু টেস্ট দিল ডাক্তার, আর বলল ভেঙে না পড়তে। REPORT পাবার পর, ডাক্তারেরও যেন চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললেন “লিউকেমিয়া”, ব্লাড ক্যান্সার। হাতে সময় খুব কম, বেশি হলেও ৭ থেকে ১০ দিন। প্রথম দিনের দেয়া PROMISE রক্ষা না করে চলে যাবে লাবণ্য...আমার লাবণ্য। .......................................... নিজের পুরানো ডায়েরি টা বন্ধ করে চোখটাও একটু বুজলেন জাভেদ সাহেব, হেলান দিয়ে দেহটাকে এলিয়ে দিলেন আরামদায়ক চেয়ারে। ২৩ বছর আগে লেখা ছেড়ে দেয়া ডায়েরীতে আজ শেষ কথাটা লিখবেন। লিখলেন-

........................................................................তারিখ-১৬/০৪/২০২৯ “আমার অঙ্কিতাকে আমি আজ সম্প্রদান করলাম, ওরা যেন চিরসুখী হয়।”
 
Top