চেম্বারে ঢুকেই টেবিলের উপর সাদা খামটা দেখে মনটা অদ্ভুত খারাপ লাগায় ভরে গেলো।আজ দিনটাই
হয়তো খারাপ যাবে।ভাবছি সকালে যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম।অবশ্য অন্যের মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠার সুযোগটা আমার এখনো হয়নি।নিপাট ব্যাচেলর মানুষ হিসেবে প্রতিটাদিন ঘুম থেকে উঠে ওয়াশিং বেসিনের আয়নায় নিজের মুখটাই সবার আগে দেখতে হয়।তাই আপাতত নিজেকেই অপয়া ভাবতে হচ্ছে।যাইহোক খামের কথা বলতে গিয়ে কতো কি বলে ফেললাম।শহরতলীর একমাত্র প্যাথলজিকাল টেস্টের সুবিধাসম্পন্ন চেম্বারে এইরকম অনেক খামেই আমাকে সাইন করতে হয়।কিন্তু এই খামটা আর দশটা খামের মতো নয়।এই খামটা প্রতিটাবার আমার মন খারাপ করিয়ে দেয়।খামটার গায়ে লেখা ‘মিসেস রনিবাবু,বয়স ২৫...নিচে লেখা pregnancy test report...
রনিবাবুর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আমি যখন মেডিক্যাল কলেজের ২য় বর্ষে পড়ি।ডিসেম্বরের কোন এক বিকেলে কলেজের কাছেই কলোনির রাস্তার ধারে হাঁটছিলাম।হঠাৎ দেখি ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের জটলা আর শোরগোল।আমাদের বয়সী একটা ছেলে সেখানে বাচ্চাদের চকলেট বিলাচ্ছে।বাচ্চাদের কেউ তার ঘাড়ে,কেউ তার কোলে চেপে বসে হাত তালি দিয়েই যাচ্ছে।অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে গেলো।একটা মানুষ যে কতো মায়া নিয়ে বাচ্চাদের আদর করতে পারে ছেলেটাকে না দেখলে বোঝা যাবে না।পরে এই ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল কলেজ মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে।ডাক নাম রনি।বাচ্চাদের অসম্ভব ভালবাসে বলে এলাকার মানুষ আদর করে ওকে বাবুরনি ডাকে।মায়াকাড়া সহজ সরল চেহারা।মসজিদে প্রায়ই দেখা হতো বলে ছেলেটা অল্প সময়েই আমার ঘনিষ্ঠ একজন হয়ে উঠল।অদ্ভুত একটা ছেলে,বাচ্চা দেখলেই মাথা ঠিক থাকতো না।রাস্তায় হাঁটতে গেলে কারো কোলে বাচ্চা দেখলে রনি যে করেই হোক কোলে নিবেই।রনি আমাকে মাঝে হেসে বলতো,তাকে যদি কিছু খাবার আর একটা ছোট্ট বাচ্চা দিয়ে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়,তাহলে সে দিনের পর দিন কোন চাহিদা ছাড়াই পার করে দিতে পারবে।
রনি তার জীবনের কোনকিছুই আমার কাছে লুকোতো না।প্রেমটা রনির জীবনে বড্ড অদ্ভুত ভাবেই এসেছিল।মৌয়ের মুখেই কাহিনীটা শুনেছিলাম।রনি প্রায় বিকেলেই মৌয়ের বাসার সামনে কাছাকাছি দাড়িয়ে থাকতো।আর ওদিকে চাচাতোবোন বৃষ্টিকে প্রতিদিন বাসার বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া মৌয়ের নিত্যদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছিল।রনিকে এইভাবে প্রতিনিয়ত দাড়িয়ে থাকতে দেখে মৌয়ের আর দশটা বখাটে ছেলের মতই মনে হয়েছিলো।কিন্তু রনির সাথে চোখাচোখি হলে সেটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হতো মৌর।কিন্তু যেদিন রনি আড়াল ভেঙ্গে তার সামনে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো সেদিন তার বুকের মাঝে ভয়ের শীতলস্পর্শ বয়ে গেলো।ছেলেটা এরকম আচমকা তার সাথে কথা বলতে আসবে সে ভাবতেও পারেনি।কিন্তু এইরকম মুহূর্তে ছেলেটা তাকে যে কথা বলল,তা বোধহয় পৃথিবীর কোন নারীই শুনেনি।রনি অতি আগ্রহের সাথে দেড় বছর বয়সী বৃষ্টিকে কোলে নিতে চাইলো।মূর্তির মত স্তব্দ হয়ে মৌ বৃষ্টিকে ছেলেটির কোলে দিল।ছেলেটির আদর করার ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেল বাচ্চাদের প্রতি তার গভীর মায়া।মৌয়ের মাঝে তখন একি সাথে দুটি অনুভুতি কাজ করছে।একটা অবাক করা অনুভুতি আরেকটা অনুশোচনা বোধ।এই দেবতাতুল্য মানুষটাকে কি ভুলটাই না সে এতদিন বুঝেছিল।সেদিনই মৌ বুঝেছিল বিধাতা নিজ হাতে এই ছেলেটিকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।এখন শুধু ছেলেটিকে তার জীবনে বুঝে নেবার পালা।নিজের সবচেয়ে ভাললাগার মানুষের আসনে রনিবাবুকে বসাতে মৌয়ের একটুও ভুল হল না।
এরপর শুরু হল মৌ-রনির একসাথে পথচলা।দুজনের মাঝেই অদ্ভুত কি একটা মিল। দেখে মনে হবে যেন এই দুজনেরইতো একসাথে থাকার কথা ছিল।দুজনেই খুব হাসিখুশি,যেন দুনিয়ার কোন দুঃখ তাদের স্পর্শ করেনি।দুজনেই বাচ্চাদের অসম্ভব ভালবাসে।রনির সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য মৌও আমার কাছের কেউ হয়ে গেল।কোথায় যেন পরেছিলাম প্রেমের গল্প কখনো মসৃণ হয়না।মৌ-রনির ক্ষেত্রেও সেটা হল না।রনির জোরাজুরিতে ওর পরিবার রাজি হলেও মৌয়ের পরিবার কিছুতেই রাজি হল না।বরং মৌকে দ্রুত বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলো।শান্তশিষ্ট ছেলে রনিবাবু মৌকে ছেড়ে দেবার কথা কল্পনাতেও ভাবতো না।তখন আমি ইন্টার্নী করি।মৌকে হারাতে হবে জেনে আমাকে জড়িয়ে ধরে রনিবাবুর সেই কান্নার কথা আজও আমি ভুলতে পারি নি।সেদিনই মনে হয়েছিল আর যাই হোক এই জুটিকে কখনই বিচ্ছিন্ন হতে দেয়া যাবে না।এপ্রিলের কোন এক বৃষ্টিস্নাত বুধবারে আমি আর আমার দুজন বন্ধুকে সাক্ষী রেখে উত্তরা কাজী অফিসে মৌ আর রনির বিয়ে হয়ে গেল।এরপরের কাহিনী আমার তেমন জানা নেই।মেডিক্যাল পাশ করে চাকরীতে ঢুকে যাওয়ায় জানার তেমন সুযোগও ছিল না।শুধু শুনেছিলাম মৌয়ের বাসায় বিয়েটা মেনে নিলেও তার বাবা মা কখনো সেটা সহজ ভাবে নেয় নি।আর রনির বাসায় বিয়ে মেনে নিলেও রনির সংসার চালানোর খরচ দিতে তারা নারাজ।পরে বাধ্য হয়ে রনি কোন একটা ছোটখাট চাকরী জুটিয়ে নেয়।
এরপর প্রায় ৫ বছর পার হয়ে গেছে।আমি মফস্বলের এক পাড়াগাঁয়ে পোস্টিং নিয়ে এলাম।কোন এক শীতের রাতে বাজারে একটু ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম।হঠাৎ কালো চাদর পরা কেউ একজন আমাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল।এই এলাকায় এমনিতেই চরমপন্থীদের উৎপাত একটু বেশী।তাই খুব বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।রনিবাবুকে ৫ বছর পর আবার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা পেয়ে যাবো আশা করিনি।এমনিতে এই অজপাড়াগায়ে কিছুটা নিঃসঙ্গতায় ভুগি।রনিকে পেয়ে ভালই হল।তাছাড়া ছেলেটাকে আমি খুব পছন্দ করি।রনি মৌকে নিয়ে ছোট্ট একটা বাসা নিয়েছে।রনির পাশাপাশি মৌও বাচ্চাদের স্কুলে চাকরী নিয়েছে।দুজন একসাথে বেরুলে আমার চেম্বারে একবার ঢুঁ মেরে এককাপ কফি চাইই চাই।আগেই বলেছি দুজনেই খুব হাসিখুশি স্বভাবের।আগের সেই হাসিমুখের সাথে এখনকারটায় কোথায় যেন সুক্ষ অমিল।মৌয়ের মায়াময়ী চোখগুলোর মাঝে কেমন যেন গভীর কষ্ট লুকিয়ে আছে।একদিন মৌ একা চেম্বারে এসে সেই কষ্টগুলোর কথা আমাকে বলল।গত ৫ টা বছর ওরা সন্তান নেবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।দেশের এমন কোন infertility বিষয়ক ডাক্তার নেই যাদের কাছে ওরা যায়নি।অনেক ডাক্তার বলেছেন সমস্যাটা মৌয়েরই,কিন্তু কি সমস্যা সেটা তারা ধরতে পারছেন না।যে রনিবাবু পাগলের মত বাচ্চাদের পছন্দ করে সেই রনিবাবুকে সন্তান না দিতে পেরে মৌ প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছিল।তাছাড়া মৌয়ের শ্বশুরবাড়ির ওরাও খোটা মারতে ছাড়ত না।বাচ্চাপাগল রনি বাবা হতে পারবে না এটা মৌ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।তবে রনি কখনই কোন আচরনে মৌকে সেটা বুঝতে দেয়নি।মৌয়ের সমস্যা আমি জেনে যাই সেটাও সে চায়নি।সেজন্যই আমার কাছে কখনোই খুলে বলেনি।সেদিন চেম্বারে মৌয়ের কান্না আমি কখনোই ভুলতে পারব না।সবচেয়ে খারাপ লাগলো যেদিন ওদের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম।পুরোটা ঘর কিউট কিউট বাচ্চাদের ছবি দিয়ে সাঁটানো।ওদের বেডরুমটা সুন্দর সুন্দর পুতুল দিয়ে সাজানো।সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।বিধাতার বিবেচনাকে বড্ড এলোমেলো মনে হচ্ছিল।নাহলে যে ছেলেটা সারাটাজীবন বাচ্চাদের জন্য উৎসর্গ করলো,সে কেন বাবা হতে পারবেনা।
কোনভাবেই এটা মেনে নিতে পারছিলাম না।রনিকে অনেকটা জোর করেই ইন্ডিয়ায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি করালাম।৩ মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে রনি কোন সুসংবাদ দিতে পারল না।ওখানেও কোন সমস্যা খুজে পেল না।শুধু বলল চেষ্টা চালিয়ে যেতে।আমারও হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছিল না।আমার কলেজের এক বড়ভাই ইংল্যান্ড থেকে infertility এঁর উপর ডিগ্রি নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন,তার কাছে পাঠালাম।তিনি কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন।কেন জানিনা উনার চিকিৎসা রনি আর মৌকে খুব আশাবাদী করে তুলল।কিন্তু ৬ মাসেও কিছু না হওয়ায় ওরা খুব বেশি হতাশ হয়ে পরল।তখন মনে হচ্ছিল এতো কিছু না করানোই বরং ভাল ছিল।নিরাশ মানুষকে আশা দেখিয়ে আবার নিরাশ করলে সে নিরাশার অতল গহবরে হারিয়ে যায়।
আজকে সকালে আমার ল্যাবে মৌয়ের ৭ম pregnancy test হয়েছে।গত ৬টা রিপোর্ট নেগেটিভ লিখে সাইন করতে হয়েছে।খামটা যখন সাইনের দেবার জন্য খুলছি,তখনি রনি মৌ এসে হাজির।সেই চিরাচরিত হাসি হেসে বলল,দাদা তোমার বানানো ম্যাক-কফি খেতে হাজির হয়ে গেলাম।কে বলবে এই হাসি মুখদুটোর মাঝে একটা গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে।এই হাসিমাখা মুখ দুটোকে ৭ম বারের মত নেগেটিভ শব্দটা শুনাতে মনটা চাইছিল না।কিন্তু সাইন করতে গিয়ে আমি মনে হয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেললাম।pregnancy Test POSITIVE লেখাটা কেমন যেন স্বপ্নময় মনে হল।আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে রনি-মৌ খুব অবাক হয়ে গেল।ওদের কিছু না বলে ল্যাবে গিয়ে নিজ হাতে মৌয়ের প্রেগনেন্সির কনফার্মেটরী টেস্ট আবার করালাম এবং পজিটিভ পেলাম।দৌড়ে গিয়ে শুধু রনিকে জড়িয়ে ধরলাম,মুখে কিছু বলার ভাষা ছিল না।পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবা তখন আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল।আর পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মাটা তখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি।আমার কেন জানি খুব কাদতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু পুরুষ মানুষেরতো কাঁদতে হয় না।আমিও কাঁদছি না।শুধু চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পরেই যাচ্ছে,এই যা আর কি?
রনিবাবুর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আমি যখন মেডিক্যাল কলেজের ২য় বর্ষে পড়ি।ডিসেম্বরের কোন এক বিকেলে কলেজের কাছেই কলোনির রাস্তার ধারে হাঁটছিলাম।হঠাৎ দেখি ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের জটলা আর শোরগোল।আমাদের বয়সী একটা ছেলে সেখানে বাচ্চাদের চকলেট বিলাচ্ছে।বাচ্চাদের কেউ তার ঘাড়ে,কেউ তার কোলে চেপে বসে হাত তালি দিয়েই যাচ্ছে।অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে গেলো।একটা মানুষ যে কতো মায়া নিয়ে বাচ্চাদের আদর করতে পারে ছেলেটাকে না দেখলে বোঝা যাবে না।পরে এই ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল কলেজ মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে।ডাক নাম রনি।বাচ্চাদের অসম্ভব ভালবাসে বলে এলাকার মানুষ আদর করে ওকে বাবুরনি ডাকে।মায়াকাড়া সহজ সরল চেহারা।মসজিদে প্রায়ই দেখা হতো বলে ছেলেটা অল্প সময়েই আমার ঘনিষ্ঠ একজন হয়ে উঠল।অদ্ভুত একটা ছেলে,বাচ্চা দেখলেই মাথা ঠিক থাকতো না।রাস্তায় হাঁটতে গেলে কারো কোলে বাচ্চা দেখলে রনি যে করেই হোক কোলে নিবেই।রনি আমাকে মাঝে হেসে বলতো,তাকে যদি কিছু খাবার আর একটা ছোট্ট বাচ্চা দিয়ে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়,তাহলে সে দিনের পর দিন কোন চাহিদা ছাড়াই পার করে দিতে পারবে।
রনি তার জীবনের কোনকিছুই আমার কাছে লুকোতো না।প্রেমটা রনির জীবনে বড্ড অদ্ভুত ভাবেই এসেছিল।মৌয়ের মুখেই কাহিনীটা শুনেছিলাম।রনি প্রায় বিকেলেই মৌয়ের বাসার সামনে কাছাকাছি দাড়িয়ে থাকতো।আর ওদিকে চাচাতোবোন বৃষ্টিকে প্রতিদিন বাসার বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া মৌয়ের নিত্যদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছিল।রনিকে এইভাবে প্রতিনিয়ত দাড়িয়ে থাকতে দেখে মৌয়ের আর দশটা বখাটে ছেলের মতই মনে হয়েছিলো।কিন্তু রনির সাথে চোখাচোখি হলে সেটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হতো মৌর।কিন্তু যেদিন রনি আড়াল ভেঙ্গে তার সামনে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো সেদিন তার বুকের মাঝে ভয়ের শীতলস্পর্শ বয়ে গেলো।ছেলেটা এরকম আচমকা তার সাথে কথা বলতে আসবে সে ভাবতেও পারেনি।কিন্তু এইরকম মুহূর্তে ছেলেটা তাকে যে কথা বলল,তা বোধহয় পৃথিবীর কোন নারীই শুনেনি।রনি অতি আগ্রহের সাথে দেড় বছর বয়সী বৃষ্টিকে কোলে নিতে চাইলো।মূর্তির মত স্তব্দ হয়ে মৌ বৃষ্টিকে ছেলেটির কোলে দিল।ছেলেটির আদর করার ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেল বাচ্চাদের প্রতি তার গভীর মায়া।মৌয়ের মাঝে তখন একি সাথে দুটি অনুভুতি কাজ করছে।একটা অবাক করা অনুভুতি আরেকটা অনুশোচনা বোধ।এই দেবতাতুল্য মানুষটাকে কি ভুলটাই না সে এতদিন বুঝেছিল।সেদিনই মৌ বুঝেছিল বিধাতা নিজ হাতে এই ছেলেটিকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।এখন শুধু ছেলেটিকে তার জীবনে বুঝে নেবার পালা।নিজের সবচেয়ে ভাললাগার মানুষের আসনে রনিবাবুকে বসাতে মৌয়ের একটুও ভুল হল না।
এরপর শুরু হল মৌ-রনির একসাথে পথচলা।দুজনের মাঝেই অদ্ভুত কি একটা মিল। দেখে মনে হবে যেন এই দুজনেরইতো একসাথে থাকার কথা ছিল।দুজনেই খুব হাসিখুশি,যেন দুনিয়ার কোন দুঃখ তাদের স্পর্শ করেনি।দুজনেই বাচ্চাদের অসম্ভব ভালবাসে।রনির সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য মৌও আমার কাছের কেউ হয়ে গেল।কোথায় যেন পরেছিলাম প্রেমের গল্প কখনো মসৃণ হয়না।মৌ-রনির ক্ষেত্রেও সেটা হল না।রনির জোরাজুরিতে ওর পরিবার রাজি হলেও মৌয়ের পরিবার কিছুতেই রাজি হল না।বরং মৌকে দ্রুত বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলো।শান্তশিষ্ট ছেলে রনিবাবু মৌকে ছেড়ে দেবার কথা কল্পনাতেও ভাবতো না।তখন আমি ইন্টার্নী করি।মৌকে হারাতে হবে জেনে আমাকে জড়িয়ে ধরে রনিবাবুর সেই কান্নার কথা আজও আমি ভুলতে পারি নি।সেদিনই মনে হয়েছিল আর যাই হোক এই জুটিকে কখনই বিচ্ছিন্ন হতে দেয়া যাবে না।এপ্রিলের কোন এক বৃষ্টিস্নাত বুধবারে আমি আর আমার দুজন বন্ধুকে সাক্ষী রেখে উত্তরা কাজী অফিসে মৌ আর রনির বিয়ে হয়ে গেল।এরপরের কাহিনী আমার তেমন জানা নেই।মেডিক্যাল পাশ করে চাকরীতে ঢুকে যাওয়ায় জানার তেমন সুযোগও ছিল না।শুধু শুনেছিলাম মৌয়ের বাসায় বিয়েটা মেনে নিলেও তার বাবা মা কখনো সেটা সহজ ভাবে নেয় নি।আর রনির বাসায় বিয়ে মেনে নিলেও রনির সংসার চালানোর খরচ দিতে তারা নারাজ।পরে বাধ্য হয়ে রনি কোন একটা ছোটখাট চাকরী জুটিয়ে নেয়।
এরপর প্রায় ৫ বছর পার হয়ে গেছে।আমি মফস্বলের এক পাড়াগাঁয়ে পোস্টিং নিয়ে এলাম।কোন এক শীতের রাতে বাজারে একটু ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম।হঠাৎ কালো চাদর পরা কেউ একজন আমাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরল।এই এলাকায় এমনিতেই চরমপন্থীদের উৎপাত একটু বেশী।তাই খুব বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।রনিবাবুকে ৫ বছর পর আবার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখা পেয়ে যাবো আশা করিনি।এমনিতে এই অজপাড়াগায়ে কিছুটা নিঃসঙ্গতায় ভুগি।রনিকে পেয়ে ভালই হল।তাছাড়া ছেলেটাকে আমি খুব পছন্দ করি।রনি মৌকে নিয়ে ছোট্ট একটা বাসা নিয়েছে।রনির পাশাপাশি মৌও বাচ্চাদের স্কুলে চাকরী নিয়েছে।দুজন একসাথে বেরুলে আমার চেম্বারে একবার ঢুঁ মেরে এককাপ কফি চাইই চাই।আগেই বলেছি দুজনেই খুব হাসিখুশি স্বভাবের।আগের সেই হাসিমুখের সাথে এখনকারটায় কোথায় যেন সুক্ষ অমিল।মৌয়ের মায়াময়ী চোখগুলোর মাঝে কেমন যেন গভীর কষ্ট লুকিয়ে আছে।একদিন মৌ একা চেম্বারে এসে সেই কষ্টগুলোর কথা আমাকে বলল।গত ৫ টা বছর ওরা সন্তান নেবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।দেশের এমন কোন infertility বিষয়ক ডাক্তার নেই যাদের কাছে ওরা যায়নি।অনেক ডাক্তার বলেছেন সমস্যাটা মৌয়েরই,কিন্তু কি সমস্যা সেটা তারা ধরতে পারছেন না।যে রনিবাবু পাগলের মত বাচ্চাদের পছন্দ করে সেই রনিবাবুকে সন্তান না দিতে পেরে মৌ প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছিল।তাছাড়া মৌয়ের শ্বশুরবাড়ির ওরাও খোটা মারতে ছাড়ত না।বাচ্চাপাগল রনি বাবা হতে পারবে না এটা মৌ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।তবে রনি কখনই কোন আচরনে মৌকে সেটা বুঝতে দেয়নি।মৌয়ের সমস্যা আমি জেনে যাই সেটাও সে চায়নি।সেজন্যই আমার কাছে কখনোই খুলে বলেনি।সেদিন চেম্বারে মৌয়ের কান্না আমি কখনোই ভুলতে পারব না।সবচেয়ে খারাপ লাগলো যেদিন ওদের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলাম।পুরোটা ঘর কিউট কিউট বাচ্চাদের ছবি দিয়ে সাঁটানো।ওদের বেডরুমটা সুন্দর সুন্দর পুতুল দিয়ে সাজানো।সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।বিধাতার বিবেচনাকে বড্ড এলোমেলো মনে হচ্ছিল।নাহলে যে ছেলেটা সারাটাজীবন বাচ্চাদের জন্য উৎসর্গ করলো,সে কেন বাবা হতে পারবেনা।
কোনভাবেই এটা মেনে নিতে পারছিলাম না।রনিকে অনেকটা জোর করেই ইন্ডিয়ায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি করালাম।৩ মাস চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে রনি কোন সুসংবাদ দিতে পারল না।ওখানেও কোন সমস্যা খুজে পেল না।শুধু বলল চেষ্টা চালিয়ে যেতে।আমারও হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছিল না।আমার কলেজের এক বড়ভাই ইংল্যান্ড থেকে infertility এঁর উপর ডিগ্রি নিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন,তার কাছে পাঠালাম।তিনি কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন।কেন জানিনা উনার চিকিৎসা রনি আর মৌকে খুব আশাবাদী করে তুলল।কিন্তু ৬ মাসেও কিছু না হওয়ায় ওরা খুব বেশি হতাশ হয়ে পরল।তখন মনে হচ্ছিল এতো কিছু না করানোই বরং ভাল ছিল।নিরাশ মানুষকে আশা দেখিয়ে আবার নিরাশ করলে সে নিরাশার অতল গহবরে হারিয়ে যায়।
আজকে সকালে আমার ল্যাবে মৌয়ের ৭ম pregnancy test হয়েছে।গত ৬টা রিপোর্ট নেগেটিভ লিখে সাইন করতে হয়েছে।খামটা যখন সাইনের দেবার জন্য খুলছি,তখনি রনি মৌ এসে হাজির।সেই চিরাচরিত হাসি হেসে বলল,দাদা তোমার বানানো ম্যাক-কফি খেতে হাজির হয়ে গেলাম।কে বলবে এই হাসি মুখদুটোর মাঝে একটা গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে।এই হাসিমাখা মুখ দুটোকে ৭ম বারের মত নেগেটিভ শব্দটা শুনাতে মনটা চাইছিল না।কিন্তু সাইন করতে গিয়ে আমি মনে হয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেললাম।pregnancy Test POSITIVE লেখাটা কেমন যেন স্বপ্নময় মনে হল।আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে রনি-মৌ খুব অবাক হয়ে গেল।ওদের কিছু না বলে ল্যাবে গিয়ে নিজ হাতে মৌয়ের প্রেগনেন্সির কনফার্মেটরী টেস্ট আবার করালাম এবং পজিটিভ পেলাম।দৌড়ে গিয়ে শুধু রনিকে জড়িয়ে ধরলাম,মুখে কিছু বলার ভাষা ছিল না।পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাবা তখন আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল।আর পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মাটা তখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি।আমার কেন জানি খুব কাদতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু পুরুষ মানুষেরতো কাঁদতে হয় না।আমিও কাঁদছি না।শুধু চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পরেই যাচ্ছে,এই যা আর কি?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন