বাবা, আমি সত্যিই আর দুষ্টু করবো না। প্রমিজ... প্লিজ আর মুখটা ওরকম করে রেখো না।"
ছোট্ট ত্রপার অনেক দুঃখ। বাবার মন খারাপ হলেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাটা এত ভালো কেন? দুষ্টু করলেও বকা দেয় না। অর্থি-অ্যানিদের বাবারে অনেক বকা দেয়। আজকে ত্রপা বিছানার চাদর কেটে বাবার জন্য পাঞ্জাবী বানাতে গিয়েছিল। বাবার পাঞ্জাবীটা ছিঁড়ে গেছে পকেটের কাছে। বাবা দেখেনি। নিচে আইসক্রীমওয়ালার কাছে আইসক্রীম কিনতে যাওয়ার সময় ২ টাকার নোট বের করতে গিয়ে দেখেছে ত্রপা। বাবা অনেকক্ষণ ধরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।ত্রপা জানে বাবা কি দেখছে।
- বাবা, তুমি মা-কে দেখছ?
- কই মামণি, নাতো!!
- আমি জানি বাবা, তোমার মন খারাপ হলেই তুমি মাকে দেখ। আচ্ছা বাবা, মা-টা এত্তগুলা পঁচা কেন? একদিন ফোন করতে পারে না?
- কি জানি মামণি!! মামণির মোবাইলটা হারিয়ে গেছে বোধহয়।
- তাহলে তো মা'র সাথে তোমার কথা হবে না। তুমি আসবে বাবা আমার ঘরে? আমি তোমাকে গল্প শোনাবো।
পাঁচ বছরের একটা ছোট্ট বাচ্চার জন্য রাত দেড়টা অনেক রাত। কালকে আবার স্কুল আছে। কিশোরী বয়সে এমনিতেই অনেক রাত বালিশে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিতে হবে এই মেয়েকে। মায়াবতীরা একটু বেশিই কষ্ট পায়।পর্দার ফাঁক দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো ত্রপার মুখে এসে পড়েছে। লোপার মায়াকাড়া চোখ দুটই যেন কেউ এনে বসিয়ে দিয়েছে ত্রপার চোখে।আত্নত্যাগের শিল্পকর্মগুলো অসাধারণ হয়। ত্রপার জন্ম দিতে গিয়েই লোপা মারা গেছে। শাহেদ ত্রপাকে কোলে তুলে নিল।
-বাবা, তোমার অফিসের বস বকা দিয়েছে?তোমার মন খারাপ কেন বাবা ?বলোনা
-আমার মন তো খারাপ না মামণি। তোমাকে কোলে নিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেছে।
মাস শেষে শুণ্য মানিব্যাগের কথা শিশুদের বলা যায় না। আগামী মাসে বাড়ি ছাড়ার নোটিশের কথাও বলা যায় না। পাঁচ হাজার টাকা বেতনের চাকরীটা নিয়ে টানাটানির কথাও বলা যায় না। লোপাকে বলা যেত। হাসিখুসি মেয়েটা সব ম্যানেজ করে নিত।শুধু নিজের মৃত্যুর ব্যাপারটাই ম্যানেজ করতে পারে নি।হাসপাতালের বেডে শুয়ে লোপা বলেছিল "শাহেদ, আমি বোধহয় আর বাঁচব না।" শাহেদ বিশ্বাস করতে পারে নি। হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়েছিল। লোপা আলতো করে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলেছিল সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয় শাহেদ। আমাকে হয়ত আর দেখতেই পারবে না। এখনই দেখে নাও।দেখ তো কাজলটা ঠিক হয়েছে কিনা। কিছু মানুষের চোখে জন্ম-কাজল পরানো থাকে। লোপাও সেরকম একজন। তবুও প্রেগন্যান্সির তীব্র পেইন নিয়েই লোপা চোখে কাজল দিয়েছিল। মুখে হালকা করে পাউডার। কয়েক ফোঁটা শ্যানেল নাম্বার ফাইভ- ওদের বিয়ের উপহার। তিন বছরের বিবাহিত জীবনে শাহেদ লোপাকে কিছু দেয়নি। বলা ভালো দিতে পারে নি।লোপা শাহেদকে অনেক স্মৃতি উপহার দিয়েছিল।হুডখোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভেজার স্মৃতি, কফি বুথের আলো-আঁধারি ঘেরা ছায়ায় চুমু খাওয়ার স্মৃতি। শাহেদের চোখে পানি - তখনো ছিল। এখন আরো বেড়েছে। স্ট্রেচারে করে অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার পথে হড়বড় করে কথা বলছিল ত্রপা। যেন শেষ বারের মত কথা বলে নিচ্ছে।
চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছতে মুছতে লোপা বলেছিল- আমি মারা গেলে তুমি আবার একটা বিয়ে করবে শাহেদ। যখন আমি থাকবো না, প্রতি রাতে চোখ বন্ধ করে আমাকে মনে করার চেষ্টা করবে। যেদিন পারবে না, চেহারাটা মুছে যাবে মন থেকে সেদিন।ই বিয়ে করে ফেলবে। আমার মত থ্যাবড়ানো নাকওয়ালা কাউকে না-পরীর মত সুন্দর কাউকে। আর শোন উত্তরার ওই কাজী অফিসে যাবে না। ওখানের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখলে তোমার বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে পড়ে যাবে। একটু চালাক হতে হয় মিস্টার। কৃষ্ণচুড়া গাছে পাতা কম। ওরা বৃষ্টি আটকাতে পারে না। ঝর ঝর বৃষ্টির দিনে তোমার টুকটুকে বৌটাকে নিয়ে বেড়াতে গেলে পাতাওয়ালা একটা গাছের নিচে দাঁড়াবে। আর হ্যাঁ,সব মেয়েরা আমার মত নির্লজ্জ না। ওরা রিকশায় উঠলে আমার মত নিজে থেকে জড়িয়ে ধরবে না। বৌয়ের সাথে রিকশায় উঠলে জড়িয়ে ধরে বসতে হয়। নাহলে ওরা ভয় পায়। শাহেদ শুধু শুনে গেছে সব। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করছিল।লোপার ভিতরে অজস্র রক্তঃক্ষরণ।শাহেদের ভেতরে তখন তুমুল ঝড়ে সব লন্ডভন্ড অবস্থা।তবুও থামেনি লোপা। অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগ পর্যন্ত হড়বড় করে কথা বলে গেছে। শেষ কথা। প্রথম বাসরের দিনটির মত নিচু চোখে ওর কথা কেবল শুনেই গেছে শাহেদ।
ত্রপাটা ওর মা'কে দেখেনি। শাহেদ আকাশের তারা দেখিয়ে লোপাকে চিনিয়েছে-"ওইটা তোমার মামণি"।
এখন ত্রপার চেয়ে শাহেদেরই বেশি দেখতে হয় তারাটাকে।শ্যাওড়াপাড়ার ছোট্ট বাসাটার আনাচে কানাচে লোপার গায়ের গন্ধ। ভাঙ্গা বালতিতে লাগানো অর্কিড, বারান্দাজোড়া অ্যালমানডা।সবুজ পাতা,হলুদ ফুলে লোপার প্রতিচ্ছবি। লোপার শখের বারান্দাওয়ালা বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। নোটিশ এসেছে।খারাপ না। গা থেকে স্মৃতির গন্ধ ঝেড়ে ফেলা বড়ই কঠিন। লোপা মারা যাওয়ার পর রাস্তায় চলতে খুব সমস্যা হত। হঠাৎ রিকশা করে যাওয়া তরুণির খিলখিল হাসি শুনে লোপা বলে ভুল হত। অফিস যাওয়ার আগে খুঁজে পাওয়া যেত না কিছুই। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। ত্রপার টিফিনও এখন শাহেদ বানিয়ে নিতে পারে। লোপা ডাল রাঁধতে পারত না। ডালে যত বাগাড় দেওয়া যায় ততই ভালো। ভার্সিটির পানি ডাল খাওয়া শাহেদ কিছুই টের পেত না। আজও পায় না। লোপাও নিজেই খেতে গিয়ে কেঁদে কেটে একসা হত শাহেদ খেতে পারেনি ভেবে। এখন দিব্যি চলে যায়। বুয়া না আসলে দু-মুঠো চাল, বাগারবিহীন ডাল, আলু ভর্তা- বেশ চালিয়ে নিতে পারে। লোপাটা খুব স্বার্থপর। বারবার ঘুরে ফিরে আসে। চোখ বন্ধ করে অনেকবার সব ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে শাহেদ। পারেনি। মাঝে মাঝে ত্রপাকে নিয়ে পার্কে যায়। কাঠবাদাম গাছের নিচে ওদের রিজার্ভ করা বেঞ্চিতে আরেকজোড়া শাহেদ-লোপা বসে থাকে। শাহেদ এর চোখ ঝাঁঝাঁ করে। বর্শণ হয়। অবিস্রান্ত বর্ষন। রাতের ঢাকা আরো নীরব হয়ে উঠলে তারাটা মিলিয়ে যায়।
" Come not when I'm dead
To drop thy foolish tears upon my grave"
তবুও অশ্রু ঝরে যায়।থামানো যায় না। তারপর একসময় ঘুমিয়ে যেতে হয়। ত্রপাটা লোপার মতই মায়াবতী হয়েছে। দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে। শাহেদের কোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা ত্রপার গায়ে লোপার ঘ্রাণ। মায়াবতীরা এমনই হয় বোধহয়।
****
বাবাটা বড্ড বোকা। প্রতিদিন রাতেই ত্রপাকে শুইয়ে দিয়ে একা একা মাকে খোঁজে। মা যে ওখানে নেই ত্রপা তা জানে। মা আছে বুকশেলফের কালো ডায়েরীর ভেতর। মাস্টার মাস্টার খেলতে গিয়ে মা'কে খুঁজে পেয়েছে ত্রপা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছে ।মায়ের ছবিটা ওর মতই। বাবাটা বোকা ।তবুও বোকা বাবাটাকেই ভালো লাগে ওর। প্রতিদিন তারা দেখে রাত করে ঘুমুতে আসা বাবাকে দেখে কান্না পায়।কাল বাবার মানিব্যাগে ছবিটা ঢুকিয়ে দেবে ।বালিশের নিচে মা'র ছবিটা রেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে ও। বাবার গায়ে মিমি চকলেটের ঘ্রাণ। মিষ্টি... খুব মিষ্টি।
ছোট্ট ত্রপার অনেক দুঃখ। বাবার মন খারাপ হলেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাটা এত ভালো কেন? দুষ্টু করলেও বকা দেয় না। অর্থি-অ্যানিদের বাবারে অনেক বকা দেয়। আজকে ত্রপা বিছানার চাদর কেটে বাবার জন্য পাঞ্জাবী বানাতে গিয়েছিল। বাবার পাঞ্জাবীটা ছিঁড়ে গেছে পকেটের কাছে। বাবা দেখেনি। নিচে আইসক্রীমওয়ালার কাছে আইসক্রীম কিনতে যাওয়ার সময় ২ টাকার নোট বের করতে গিয়ে দেখেছে ত্রপা। বাবা অনেকক্ষণ ধরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।ত্রপা জানে বাবা কি দেখছে।
- বাবা, তুমি মা-কে দেখছ?
- কই মামণি, নাতো!!
- আমি জানি বাবা, তোমার মন খারাপ হলেই তুমি মাকে দেখ। আচ্ছা বাবা, মা-টা এত্তগুলা পঁচা কেন? একদিন ফোন করতে পারে না?
- কি জানি মামণি!! মামণির মোবাইলটা হারিয়ে গেছে বোধহয়।
- তাহলে তো মা'র সাথে তোমার কথা হবে না। তুমি আসবে বাবা আমার ঘরে? আমি তোমাকে গল্প শোনাবো।
পাঁচ বছরের একটা ছোট্ট বাচ্চার জন্য রাত দেড়টা অনেক রাত। কালকে আবার স্কুল আছে। কিশোরী বয়সে এমনিতেই অনেক রাত বালিশে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিতে হবে এই মেয়েকে। মায়াবতীরা একটু বেশিই কষ্ট পায়।পর্দার ফাঁক দিয়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো ত্রপার মুখে এসে পড়েছে। লোপার মায়াকাড়া চোখ দুটই যেন কেউ এনে বসিয়ে দিয়েছে ত্রপার চোখে।আত্নত্যাগের শিল্পকর্মগুলো অসাধারণ হয়। ত্রপার জন্ম দিতে গিয়েই লোপা মারা গেছে। শাহেদ ত্রপাকে কোলে তুলে নিল।
-বাবা, তোমার অফিসের বস বকা দিয়েছে?তোমার মন খারাপ কেন বাবা ?বলোনা
-আমার মন তো খারাপ না মামণি। তোমাকে কোলে নিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেছে।
মাস শেষে শুণ্য মানিব্যাগের কথা শিশুদের বলা যায় না। আগামী মাসে বাড়ি ছাড়ার নোটিশের কথাও বলা যায় না। পাঁচ হাজার টাকা বেতনের চাকরীটা নিয়ে টানাটানির কথাও বলা যায় না। লোপাকে বলা যেত। হাসিখুসি মেয়েটা সব ম্যানেজ করে নিত।শুধু নিজের মৃত্যুর ব্যাপারটাই ম্যানেজ করতে পারে নি।হাসপাতালের বেডে শুয়ে লোপা বলেছিল "শাহেদ, আমি বোধহয় আর বাঁচব না।" শাহেদ বিশ্বাস করতে পারে নি। হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়েছিল। লোপা আলতো করে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলেছিল সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয় শাহেদ। আমাকে হয়ত আর দেখতেই পারবে না। এখনই দেখে নাও।দেখ তো কাজলটা ঠিক হয়েছে কিনা। কিছু মানুষের চোখে জন্ম-কাজল পরানো থাকে। লোপাও সেরকম একজন। তবুও প্রেগন্যান্সির তীব্র পেইন নিয়েই লোপা চোখে কাজল দিয়েছিল। মুখে হালকা করে পাউডার। কয়েক ফোঁটা শ্যানেল নাম্বার ফাইভ- ওদের বিয়ের উপহার। তিন বছরের বিবাহিত জীবনে শাহেদ লোপাকে কিছু দেয়নি। বলা ভালো দিতে পারে নি।লোপা শাহেদকে অনেক স্মৃতি উপহার দিয়েছিল।হুডখোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভেজার স্মৃতি, কফি বুথের আলো-আঁধারি ঘেরা ছায়ায় চুমু খাওয়ার স্মৃতি। শাহেদের চোখে পানি - তখনো ছিল। এখন আরো বেড়েছে। স্ট্রেচারে করে অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার পথে হড়বড় করে কথা বলছিল ত্রপা। যেন শেষ বারের মত কথা বলে নিচ্ছে।
চোখের পানিতে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছতে মুছতে লোপা বলেছিল- আমি মারা গেলে তুমি আবার একটা বিয়ে করবে শাহেদ। যখন আমি থাকবো না, প্রতি রাতে চোখ বন্ধ করে আমাকে মনে করার চেষ্টা করবে। যেদিন পারবে না, চেহারাটা মুছে যাবে মন থেকে সেদিন।ই বিয়ে করে ফেলবে। আমার মত থ্যাবড়ানো নাকওয়ালা কাউকে না-পরীর মত সুন্দর কাউকে। আর শোন উত্তরার ওই কাজী অফিসে যাবে না। ওখানের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখলে তোমার বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে পড়ে যাবে। একটু চালাক হতে হয় মিস্টার। কৃষ্ণচুড়া গাছে পাতা কম। ওরা বৃষ্টি আটকাতে পারে না। ঝর ঝর বৃষ্টির দিনে তোমার টুকটুকে বৌটাকে নিয়ে বেড়াতে গেলে পাতাওয়ালা একটা গাছের নিচে দাঁড়াবে। আর হ্যাঁ,সব মেয়েরা আমার মত নির্লজ্জ না। ওরা রিকশায় উঠলে আমার মত নিজে থেকে জড়িয়ে ধরবে না। বৌয়ের সাথে রিকশায় উঠলে জড়িয়ে ধরে বসতে হয়। নাহলে ওরা ভয় পায়। শাহেদ শুধু শুনে গেছে সব। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করছিল।লোপার ভিতরে অজস্র রক্তঃক্ষরণ।শাহেদের ভেতরে তখন তুমুল ঝড়ে সব লন্ডভন্ড অবস্থা।তবুও থামেনি লোপা। অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগ পর্যন্ত হড়বড় করে কথা বলে গেছে। শেষ কথা। প্রথম বাসরের দিনটির মত নিচু চোখে ওর কথা কেবল শুনেই গেছে শাহেদ।
ত্রপাটা ওর মা'কে দেখেনি। শাহেদ আকাশের তারা দেখিয়ে লোপাকে চিনিয়েছে-"ওইটা তোমার মামণি"।
এখন ত্রপার চেয়ে শাহেদেরই বেশি দেখতে হয় তারাটাকে।শ্যাওড়াপাড়ার ছোট্ট বাসাটার আনাচে কানাচে লোপার গায়ের গন্ধ। ভাঙ্গা বালতিতে লাগানো অর্কিড, বারান্দাজোড়া অ্যালমানডা।সবুজ পাতা,হলুদ ফুলে লোপার প্রতিচ্ছবি। লোপার শখের বারান্দাওয়ালা বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। নোটিশ এসেছে।খারাপ না। গা থেকে স্মৃতির গন্ধ ঝেড়ে ফেলা বড়ই কঠিন। লোপা মারা যাওয়ার পর রাস্তায় চলতে খুব সমস্যা হত। হঠাৎ রিকশা করে যাওয়া তরুণির খিলখিল হাসি শুনে লোপা বলে ভুল হত। অফিস যাওয়ার আগে খুঁজে পাওয়া যেত না কিছুই। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। ত্রপার টিফিনও এখন শাহেদ বানিয়ে নিতে পারে। লোপা ডাল রাঁধতে পারত না। ডালে যত বাগাড় দেওয়া যায় ততই ভালো। ভার্সিটির পানি ডাল খাওয়া শাহেদ কিছুই টের পেত না। আজও পায় না। লোপাও নিজেই খেতে গিয়ে কেঁদে কেটে একসা হত শাহেদ খেতে পারেনি ভেবে। এখন দিব্যি চলে যায়। বুয়া না আসলে দু-মুঠো চাল, বাগারবিহীন ডাল, আলু ভর্তা- বেশ চালিয়ে নিতে পারে। লোপাটা খুব স্বার্থপর। বারবার ঘুরে ফিরে আসে। চোখ বন্ধ করে অনেকবার সব ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে শাহেদ। পারেনি। মাঝে মাঝে ত্রপাকে নিয়ে পার্কে যায়। কাঠবাদাম গাছের নিচে ওদের রিজার্ভ করা বেঞ্চিতে আরেকজোড়া শাহেদ-লোপা বসে থাকে। শাহেদ এর চোখ ঝাঁঝাঁ করে। বর্শণ হয়। অবিস্রান্ত বর্ষন। রাতের ঢাকা আরো নীরব হয়ে উঠলে তারাটা মিলিয়ে যায়।
" Come not when I'm dead
To drop thy foolish tears upon my grave"
তবুও অশ্রু ঝরে যায়।থামানো যায় না। তারপর একসময় ঘুমিয়ে যেতে হয়। ত্রপাটা লোপার মতই মায়াবতী হয়েছে। দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে। শাহেদের কোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা ত্রপার গায়ে লোপার ঘ্রাণ। মায়াবতীরা এমনই হয় বোধহয়।
****
বাবাটা বড্ড বোকা। প্রতিদিন রাতেই ত্রপাকে শুইয়ে দিয়ে একা একা মাকে খোঁজে। মা যে ওখানে নেই ত্রপা তা জানে। মা আছে বুকশেলফের কালো ডায়েরীর ভেতর। মাস্টার মাস্টার খেলতে গিয়ে মা'কে খুঁজে পেয়েছে ত্রপা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছে ।মায়ের ছবিটা ওর মতই। বাবাটা বোকা ।তবুও বোকা বাবাটাকেই ভালো লাগে ওর। প্রতিদিন তারা দেখে রাত করে ঘুমুতে আসা বাবাকে দেখে কান্না পায়।কাল বাবার মানিব্যাগে ছবিটা ঢুকিয়ে দেবে ।বালিশের নিচে মা'র ছবিটা রেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে ও। বাবার গায়ে মিমি চকলেটের ঘ্রাণ। মিষ্টি... খুব মিষ্টি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন