সমাজঃ এইছেলে?? কী করো তুমি?? কোথায় পড়??
ডাক্তারঃ জ্বী মানে আমার পড়া শেষ। আমি এখন মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ণি করছি।
সমাজঃ ও তুমি ডাক্তার?? আরে নাহ তুমি তো কসাই। যা শুরু করেছো না তোমরা?
ডাক্তারঃ কেন?? আমরা কি শুরু করেছি??
সমাজঃ কী কর নাই বলো? তোমাদের কাজই তো মানুষকে জিম্মি করে, তাদের অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে টাকা কামানো।
ডাক্তারঃ আপনি নিজে দেখেছেন কখনো এমন করতে কাউকে??
সমাজঃ দেখবো না কেন?? এই সেদিনই তো আমি আমার এক আত্নীয়কে নিয়ে গেলাম তার ডাক্তারের কাছে। সেইবার তার ৩য় বারের মত যাওয়া। তারপরও তার কাছ থেকে ভিজিট নিলো। আরে আমার রোগ এখনো সারেনি। যে রোগের জন্য চিকিৎসা তা না সারিয়েই এভাবে প্রতিবার ভিজিট নেবার কোন অর্থ হয়?? ভন্ডামি আর কসাইগিরি নাতো কি??
ডাক্তারঃ তা ঠিক বলেছেন। তা কি সমস্যা ছিলো আপনার আত্নীয়ের?
সমাজঃ আরে সমস্যা হলো প্রেসার আর ডায়াবেটিস। বয়স হয়েছে তো।
ডাক্তারঃ আহা। খারাপ কথা। আচ্ছা ঐ কসাইটা কি পুরো ভিজিট নিয়েছিলো??
সমাজঃ আরে পুরো ভিজিট নিলে কি আর আমার হাত থেকে রেহাই পেত?? থাপ্পড় দিয়ে দাঁত গুলা ফেলে দিতাম না বদমাইশটার। অর্ধেক টাকা নিয়েছে।
ডাক্তারঃ ও আচ্ছা। ভালো কথা, আপনি কি কখনো কোন উকিলের কাছে গিয়েছেন??
সমাজঃ হুম গিয়েছি তো। আর বলো না আমার গ্রামে দেড় বিঘার মত একটা ধানী জমি আমার চাচাতো ভাইয়েরা মেরে দিচ্ছিলো প্রায়। হাইকোর্টের এক বড় উকিল ঠিক করলাম। ৬ মাসের মাথায় আমার নামে রায় হয়ে গেলো। আহা কি জাঁদরেল উকিল। এমন প্যাঁচ কষলো, সে আর কি বলবো। শেষে তাদের হলো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। তার ফি অবশ্য বেশি। প্রতিবার কোর্টের ফি ছাড়াও ৫০ হাজার করে দিতে হয়েছে। তাও দিয়েছি। কোটি টাকার জিনিস বলে কথা। ভালো কথা, উকিলের প্রসঙ্গ আসলো কেন??
ডাক্তারঃ পরে বলছি। আচ্ছা তার আগে আরেকটা কথা বলেন। আপনার বাচ্চা কি প্রাইভেট পড়ে??
সমাজঃ হুম পড়ে তো। স্কুলের এক টিচারের কাছে। খুবই ভালো টিচার। অংকের জাহাজ। এবার আমার মেয়ে পরীক্ষায় ৯৫ পেয়েছে।
ডাক্তারঃ বাহ! খুব ভালো কথা। তাকে কত করে দেন মাসে??
সমাজঃ তা তাকে অবশ্য একটু বেশীই দিতে হয়। মাসে প্রায় ৬ হাজার।
ডাক্তারঃ আপনার মেয়ে সপ্তাহে কয়দিন পড়ে??
সমাজঃ আরে ছোকড়া তুমি এত কিছু জানতে চাচ্ছো কেন???
ডাক্তারঃ আহা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? বলেন না। একটু পরেই বলছি কেন জিজ্ঞেস করছি।
সমাজঃ তা আমার মেয়ে সপ্তাহে ২ দিন যায়।
ডাক্তারঃ মানে মাসে ৮ দিন। তার অর্থ হলো প্রতিদিনের জন্য প্রায় হাজারের কাছাকাছি। আচ্ছা অংক ঠিক আছে তো না??
সমাজঃ তোমার উদ্দেশ্য কি বলতো?? এত হিসাব কিসের জন্য??
ডাক্তারঃ না তেমন কিছু না। হিসাব করে দেখছিলাম আপনার স্বাস্থ্য আপনার ধানী জমি আর আপনার মেয়ের জীবনের কাছে কত তুচ্ছ।
সমাজঃ মানে?? কি বলতে চাও???
ডাক্তারঃ কি বলতে চাই শুনবেন?? ভালো লাগবে বললে?? আমাদের কথা শোনার মানুষ তো খুব একটা নেই এখন। আপনি শুনবেন??
সমাজঃ আরে এত ভণিতা না করে কি বলবে বলে ফেলো।
ডাক্তারঃ কথা হচ্ছে আপনি প্রতিবার আপনার উকিলকে কোর্ট ফি বাবদ ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। কেস কিন্তু একটাই ছিলো। এই টাকা দিতে আপনার কোন কষ্ট হয়নি। আপনি আপনার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য একদিন ২ ঘন্টা পড়ানোর খরচ হিসাবে প্রায় হাজার টাকা দিতে পারেন। আপনার কোন ক্ষোভ নেই তাতে। আপনার যত অভিযোগ আপনার আত্নীয়ের স্বাস্থ্যের যত্ন যিনি নিচ্ছেন তার প্রতি। তিনি কেন প্রতি বার রোগী দেখে ভিজিটের টাকা নেবেন। যদিও সে টাকার পরিমাণ খুব সামান্য হোক না কেন। আপনার আত্নীয়তো আর প্রতি দিন ডাক্তারের কাছে যান না। বা মাসে দুই বারের বেশি যাবার দরকারও হয় না। তাহলে মাসে আপনার আত্নীয় স্বাস্থ্য সেবা দানকারী ডাক্তার নামের মানুষটাকে যে সামান্য অর্থ দিচ্ছে তার জন্য আপনার এত কষ্ট কেন?? আপনার আত্নীয় যে রোগে ভুগছে তাতো নিরাময় যোগ্য নয়। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব কেবল। তাহলে প্রতিবার যাবার জন্য সেই ডাক্তার ভিজিট নিয়ে কি খুব বেশী ভুল করছেন। ধরেন আমি আপনাকে একটা সম্ভাবনার কথা বলছি। সেই ডাক্তার যদি পুরোনো রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করে দেন এবং তার রোগীর সংখ্যা যদি দিনে ৫০ হয় এবং তার অর্ধেক রোগীও যদি পুরনো হয় তাহলে সেই বেচারা কীভাবে জীবন চালাবে???? তার বাচ্চাকেও তো তার ভালো স্কুলে পড়াতে হবে তাইনা?? ধরেন সেই বেচারার যদি আপনার মত ধানী জমি নিয়ে কোন সমস্যা হয় তাহলে তারও তো উকিলকে টাকা দিতে হবে আপনার মত। তখন?? আপনারা শুধু ডাক্তারদের টাকা নেয়াটাই দেখেন। অন্যকিছু দেখেন না। কেন???
সমাজঃ এত বড় বড় কথা বলো না। তোমরা তো ডায়াগনস্টিকের কাছ থেকে ভালো টাকা পাও। অহেতুক টেস্ট দিয়ে আমাদের বাড়োটা বাজাও।
ডাক্তারঃ আপনার এই কথা সত্য। আমাদের ডাক্তারদের মধ্যে এই অসম্ভব খারাপ একটা জিনিস খুব বাজে ভাবে ঢুকে গেছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখবেন স্বাস্থ্য সেবার যে কাঠামো তাতে সরকারী ডাক্তারদের কিন্তু এই সুযোগ খুব একটা নেই। এই খারাপ কাজটা করে থাকে প্রাইভেট প্রাকটিস করা কিছু মানুষ। এর জন্য অবশ্যই ডাক্তার সমাজ দায়ী। তবে এর জন্য সরকারের দায়িত্ব এড়ানো মনোভাবের একটা বড় ভূমিকা আছে।
সমাজঃ কীভাবে??
ডাক্তারঃ ধরেন সরকার যদি একটা নীতিমালা ঠিক করে দিতো যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিটি টেস্টের খরচ কত পড়বে তাহলে ওদের মধ্যে এই অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যেতো। আপনি নায্য খরচে টেস্ট করাতে পারতেন। সেক্ষেত্রে এই মনোপলি ব্যবসা একসময় বন্ধ হয়ে যেত। ডাক্তাররা সেখানেই আপনাকে টেস্ট করতে বলতেন যেখানে টেস্ট ভালো হয়। তখন মানের সাথে আপস করে ডাক্তারকে টাকা বাড়িয়ে দেবার মত অসুস্থ্য ঘটনা অনেক কমে যেত।
সমাজঃ কিন্তু তোমরা এত এত টেস্ট দাও কেন???
ডাক্তারঃ আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো, কিছু কিছু রোগের সাথে টেস্টের সম্পর্ক এত বেশি যে সেই টেস্ট ছাড়া ডায়াগনসিস করা সম্ভব না। এখন আমি টেস্ট না করে যদি ভুল ডায়াগনসিস করি তাহলে তো সমস্যাটা আপনারই হবে। তবে অবশ্যই ডাক্তারদের এথিকাল প্রাকটিস করা উচিত। যেটা করার পরিবেশ এখন আমাদের দেশে নাই।
সমাজঃ কেন নাই??? তোমরা চাইলেই পার। তা না করে তোমরা দলবাজি করে নিজেদের সুনাম নষ্ট করছো। শুনেছি তোমাদের নাকি কী সব ইথিক্স মেনে চলতে হয়। সেখানে নাকি বলা আছে তোমরা পার্টি পলিটিক্স, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এসব করতে পারবেনা। তাহলে তোমরা এগুলো কর কেন??
ডাক্তারঃ আপনার এই কথাটাও সত্য। ডাক্তাররা নীতিগত ভাবে পলিটিক্স করতে পারেনা।
সমাজঃ তুমি কি পলিটিক্স কর। অবশ্যই কর। তাইনা??
ডাক্তারঃ জ্বী আমাকেও কোন না কোন দলের খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে। কেন জানেন?? শুনতে চান একজন তরুণ চিকিৎসক কীভাবে প্রতিমুহুর্তে তার নিজের পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে। তাহলে শোনেন।
সমাজঃ বল। শুনছি।
ডাক্তারঃ যখন মেডিকেলে ভর্তি হলাম তখন অনেক আশা ছিল দেশের মানুষের জন্য কিছু করব। আমার ভাবনায় তখন মানবিকতা, মানব সেবা আর মানুষের হাসি মুখ দেখার ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা। দিন যায় আমি অবাক হতে শুরু করি। চারপাশের বড় ভাইদেরকে দেখি। আমাদের টিচারদের দেখি। কোথায় আমার স্বপ্নের জীবন। এতো স্বপ্ন নয়। এ বিভীষিকা। আমি প্রতিটি দিন একটু একটু করে বুঝতে শিখি এখানে পাস করতে গেলে আমাকে দল করতে হবে। আমার ক্লাশের কিছু ছেলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাদিন সিনিয়রদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সেই ছেলেদের দাপটে আমাদের অবস্থা খারাপ। তারা যা বলে ক্লাশে তাই হয়। আমাদের কথার কোন দাম নেই। তারা পরীক্ষা না দিয়েও প্রফেশনাল পরীক্ষার এডমিট কার্ড হাতে পাচ্ছে। আর আমরা আইটেম নামের সারাজীবনের বোঝা মাথা থেকে নামানোর জন্য সব কিছু উৎসর্গ করে চলেছি। এই মেডিকেলের ৫টি বছর জীবনের কত কিছু বাদ দিতে হয়েছে জানেন?? কত দিন ভুলে যেতে হয়েছে আমিও মানুষ। আমারও একটা সামাজিক জীবন আছে, বন্ধু আছে। আমারও ইচ্ছা করে দূর পাহাড়ে কারো সাথে ঘুরে আসতে। কেউ আমার সময়ের জন্য অপেক্ষার ডালি সাজিয়ে বসে থাকে। আমি পারি না। আমরা পারিনা। আমরা শুধু আইটেম ক্লিয়ার করতে পারি। ক্লিয়ার না হলে মন খারাপ করতে পারি। একটা সময় মন খারাপ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। কারণ তখন মনটাই নষ্ট হয়ে যায়। এরপর অতিকষ্টে প্রফের টেবিলে বসি। ভাগ্য ভালো হলে একবারে পাস করে যাই। আর না হলে আবার সেই চক্রে বাঁধা পড়ি। কোন রকমে সবকিছু শেষ করে যখন বের হই তখন জীবনের সুন্দর সময় গুলো আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বসন্ত বাতাস আর আমাদের ছুঁয়ে যায় না। আমাদের তখন পেটের দায়। এতদিন বাবার হোটেলে খেয়ে জীবন কেটেছে। আর কত?? অন্য প্রফেশনের বন্ধুরা বিয়ে করে ফেসবুকে কী সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করে। আর আমরা আমাদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে রাতে বিয়ের কথা তুললেই ঝগড়া করি। পায়ের নিচের মাটি যে একেবারে নরম। ওকে নিয়ে কীভাবে দাঁড়ায় বলেন?? তখনি দেখি, বুঝতে শিখি পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে গেলে আমাকে একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে। যদি ক্ষমতাশীন পক্ষ বেছে নেই তবে আমি পাবো কাঙ্ক্ষিত চাকরী। বিসিএস হয়ে যাবে আমার। তখন দুজন একসাথে দাড়াতে পারবো জীবনের পলল ভূমিতে। তখন দেখার সময় কোথায় চাকরী কি সৎ ভাবে এলো না অসৎ ভাবে। তারপর শুরু হবে তেনাদের যন্ত্রণা। আজ চাঁদা, কাল মিটিং, পরশু নির্বাচন। বাঁচি আর মরি উপস্থিত থাকতেই হবে। না হলে যে পায়ের নিচের মাটি আবার নরম হয়ে যাবে। কে চায় বলেন নিজের ক্ষতি। সময়ের নিষ্ঠুর প্রয়োজনের শিকলে বন্দী আমার বিবেক। আমি পারি না এই শিকল ভাঙতে। উপরে ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় রাজনীতি নামের পাহারাদার। সে দরজা না খুললে আমার যে কিছুই হবেনা। এখন বলেন একজন তরুণ ডাক্তার হিসাবে আমি কী করতে পারি?? কীভাবে আমি মানব সেবা করবো??
সমাজঃ হুম। কিন্তু তোমাদের নিজেদের মধ্যে এই দলাদলি করে লাভ কি??
ডাক্তারঃ লাভের কথায় তো এতক্ষন বললাম। জাগতিক লাভের জালে বন্দী হয়েই তো আমাদের এই দশা। আরো মজা হলো, আমি যে উচ্চতর ডিগ্রি নেবো সেখানেও রাজনীতির মাধ্যমে যেতে হবে। প্রাইভেট হাসপাতালে আমাদের মেডিকেল অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়। ৮ ঘন্টা ডিউটি করে আমরা ৩৫০ টাকা পাই। এবার বলেন একজন রিকশাচালক ৮ ঘন্টা রিকশা চালিয়ে এই টাকা উপার্জন করতে পারে কি না?? যদি পারে তাহলে আমরা কোথায় আছি??
সমাজঃ কিন্তু তাই বলেতো তোমরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারনা। প্রায় তোমাদের ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যাবার খবর আসে। এইটা কেন??
ডাক্তারঃ জ্বী। আমাদের ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়। তবে সেই সংখ্যাটা হাজারে কত সেটা কি একটু খেয়াল করেছেন।
সমাজঃ কী হাজারে কত??
ডাক্তারঃ আচ্ছা তাহলে আরেকটু বুঝিয়ে বলি। আচ্ছা ধরেন সরকারী হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগীর চিকিৎসা হয় তার মধ্যে প্রতিদিনই কি রোগী মারা যাচ্ছে ভুল চিকিৎসায়?? না যাচ্ছেনা। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায় নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। এমনও অনেক ডাক্তার আছেন যারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়েও মাঝে মাঝে গরীব রোগীদের চিকিৎসা করেন। কই সেই খবরতো পত্রিকায় আসেনা। প্রতিদিন কত গাইনি ডাক্তার একটা নতুন জীবনকে পৃথিবীতে আনতে সাহায্য করছে এর মাঝে কত কেস যে চ্যালেঞ্জিং কেস থাকে যেখানে সর্বোচ্চ পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়, অনেক ধৈর্য্য আর কষ্ট নিয়ে রোগী ম্যানেজ করতে হয় সে খবর কি আমরা পাই?? না পাই না। আমরা পাই শুধু খারাপ খবর গুলো। এর মধ্যে এমনও কেস থাকে যেগুলো সত্যি অনেক খারাপ অবস্থায় ছিল। এমনও হয় ডাক্তার ঠিক মত সব কিছু করলেও প্রয়োজনীয় উপকরণ বা ওষুধের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। সেটা কেও ডাক্তারের দোষ বলে প্রচার করছে মিডিয়া। কারণ এইসব মিডিয়ার কাজ হচ্ছে খবর বেঁচে ব্যবসা করা। সাধারণ মানুষ যা পড়তে পছন্দ করবে সে ধরণের খবরই তারা বিক্রি করবে।
সমাজঃ তারমানে কি তুমি বলতে চাচ্ছো তোমাদের কোন দোষ নেই?? সব মিডিয়ার দোষ??
ডাক্তারঃ আমি এমন কিছুই বলতে চাচ্ছিনা। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে আমাদের মধ্যে ভালো খারাপ দুই ধরণের মানুষই আছে। সেখানে শুধু খারাপ খবর গুলো প্রকাশ করে আমাদেরকে সমাজের একটা নষ্ট অংশ হিসাবে প্রচার করে কি খুব বেশী লাভ আছে?? সাধারণ মানুষের মনে যদি ডাক্তার সম্পর্কে খারাপ ধারণার জন্ম হয় তবে তো সে আর নিজের চিকিৎসকের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবেনা। এর ফলাফল কত খারাপ হবে ভেবে দেখেছেন কি?? আমাদের ভুল গুলো তুলে ধরার সাথে সাথে ভালো উদাহরণ গুলো তুলে ধরলেই তো আর সমস্যাটা হয়না।
সমাজঃ তোমাদের ভালো খবরগুলো কি আসেনা বলতে চাচ্ছো???
ডাক্তারঃ ভালো খবর?? একজন ডাক্তারকে ধর্ষণ করতে যেয়ে না পেরে মেরে ফেললেও সে খবর পেপারে আসে না। তার জন্য আমাদের সমাজের কোন সহানুভূতি নেই। সেতো ডাক্তার, সে তো মানুষ না। সে হলো কসাই। সমাজের উঁচু স্তরের কোন মানুষ যদি একটা মহান পেশা সম্পর্কে ঢালাও ভাবে এধরণের মন্তব্য করতে পারেন তাহলে সেই মন্তব্য তো আমাদের মত হুজুগে পাগল জাতি লুফে নেবেই। তার অনিবার্য পরিণতি হলো এই পেশা সম্পর্কে মানুষের অযাচিত ভুল ধারণা। আমাদের এক বোন মারা গেলেন। তাকে খুন করা হল। তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হল। আমাদের সেই বোন অনেক মেধাবী ছিলেন। প্রফে প্লেস করা ছাত্রী ছিলেন। হয়তো ভবিষ্যতে অনেকদূর যেতে পারতেন তিনি। এই সমাজ তার জন্য চোখের পানি ফেলছে না। দেশের বিবেক নামের তথাকথিত বিবেকহীন মানুষগুলো এখন নিশ্চুপ। একজন অখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়ার মারা গেলেও পেপারে তাকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অথচ তার তুলনায় সমাজের জন্য আমার সেই বোনটা কত বেশি মূল্যবান ছিল ভেবে দেখেনতো। আমরা আসলে বুঝতে পারিনা আমাদের কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমাদেরকে সেই দিক নির্দেশনা দেবে এমন লোকও নেই।
সমাজঃ কিন্তু তোমাদের সংগঠনও তো চুপ। সেই কথাটা বলো না কেন?? তারা কী করছে??
ডাক্তারঃ আমাদের নিজেদের সংগঠন কাজ করছে তো। তারা বিএমএ ভবনে বসে চা-পানি খাচ্ছে। কাকে কোথায় পোস্টিং দেয়া যায় তা আলোচনা করছে। কত টাকা কোন খাত থেকে পাওয়া সম্ভব সেই অংক করছে। তাদের আর কাজ কি?? আসলে এই ব্যাপারে আমাদের ডাক্তারদের লজ্জিত হওয়া উচিত যে সাংগঠনিক ভাবে আমরা এত দূর্বল। কিন্তু ঐ যে রাজনীতি। সেই কারণে আমরাও এখানে নিরব দর্শক।
সমাজঃ আসলে আমরা খুব খারাপ একটা সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।
ডাক্তারঃ শুধু একটা অনুরোধ করবো আপনাকে।
সমাজঃ কি অনুরোধ??
ডাক্তারঃ আপনার পরিচিত কেউ যদি মেডিকেলে পড়তে চায় তবে কষ্ট করে তাকে নিরুৎসাহিত করবেন। জীবনের এই নিদারুণ অপচয় আর ভালো লাগেনা। সহ্য হয়না।
লিখেছেন- Dr. Tanvir- UH, UK
ডাক্তারঃ জ্বী মানে আমার পড়া শেষ। আমি এখন মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ণি করছি।
সমাজঃ ও তুমি ডাক্তার?? আরে নাহ তুমি তো কসাই। যা শুরু করেছো না তোমরা?
ডাক্তারঃ কেন?? আমরা কি শুরু করেছি??
সমাজঃ কী কর নাই বলো? তোমাদের কাজই তো মানুষকে জিম্মি করে, তাদের অসহায় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে টাকা কামানো।
ডাক্তারঃ আপনি নিজে দেখেছেন কখনো এমন করতে কাউকে??
সমাজঃ দেখবো না কেন?? এই সেদিনই তো আমি আমার এক আত্নীয়কে নিয়ে গেলাম তার ডাক্তারের কাছে। সেইবার তার ৩য় বারের মত যাওয়া। তারপরও তার কাছ থেকে ভিজিট নিলো। আরে আমার রোগ এখনো সারেনি। যে রোগের জন্য চিকিৎসা তা না সারিয়েই এভাবে প্রতিবার ভিজিট নেবার কোন অর্থ হয়?? ভন্ডামি আর কসাইগিরি নাতো কি??
ডাক্তারঃ তা ঠিক বলেছেন। তা কি সমস্যা ছিলো আপনার আত্নীয়ের?
সমাজঃ আরে সমস্যা হলো প্রেসার আর ডায়াবেটিস। বয়স হয়েছে তো।
ডাক্তারঃ আহা। খারাপ কথা। আচ্ছা ঐ কসাইটা কি পুরো ভিজিট নিয়েছিলো??
সমাজঃ আরে পুরো ভিজিট নিলে কি আর আমার হাত থেকে রেহাই পেত?? থাপ্পড় দিয়ে দাঁত গুলা ফেলে দিতাম না বদমাইশটার। অর্ধেক টাকা নিয়েছে।
ডাক্তারঃ ও আচ্ছা। ভালো কথা, আপনি কি কখনো কোন উকিলের কাছে গিয়েছেন??
সমাজঃ হুম গিয়েছি তো। আর বলো না আমার গ্রামে দেড় বিঘার মত একটা ধানী জমি আমার চাচাতো ভাইয়েরা মেরে দিচ্ছিলো প্রায়। হাইকোর্টের এক বড় উকিল ঠিক করলাম। ৬ মাসের মাথায় আমার নামে রায় হয়ে গেলো। আহা কি জাঁদরেল উকিল। এমন প্যাঁচ কষলো, সে আর কি বলবো। শেষে তাদের হলো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। তার ফি অবশ্য বেশি। প্রতিবার কোর্টের ফি ছাড়াও ৫০ হাজার করে দিতে হয়েছে। তাও দিয়েছি। কোটি টাকার জিনিস বলে কথা। ভালো কথা, উকিলের প্রসঙ্গ আসলো কেন??
ডাক্তারঃ পরে বলছি। আচ্ছা তার আগে আরেকটা কথা বলেন। আপনার বাচ্চা কি প্রাইভেট পড়ে??
সমাজঃ হুম পড়ে তো। স্কুলের এক টিচারের কাছে। খুবই ভালো টিচার। অংকের জাহাজ। এবার আমার মেয়ে পরীক্ষায় ৯৫ পেয়েছে।
ডাক্তারঃ বাহ! খুব ভালো কথা। তাকে কত করে দেন মাসে??
সমাজঃ তা তাকে অবশ্য একটু বেশীই দিতে হয়। মাসে প্রায় ৬ হাজার।
ডাক্তারঃ আপনার মেয়ে সপ্তাহে কয়দিন পড়ে??
সমাজঃ আরে ছোকড়া তুমি এত কিছু জানতে চাচ্ছো কেন???
ডাক্তারঃ আহা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? বলেন না। একটু পরেই বলছি কেন জিজ্ঞেস করছি।
সমাজঃ তা আমার মেয়ে সপ্তাহে ২ দিন যায়।
ডাক্তারঃ মানে মাসে ৮ দিন। তার অর্থ হলো প্রতিদিনের জন্য প্রায় হাজারের কাছাকাছি। আচ্ছা অংক ঠিক আছে তো না??
সমাজঃ তোমার উদ্দেশ্য কি বলতো?? এত হিসাব কিসের জন্য??
ডাক্তারঃ না তেমন কিছু না। হিসাব করে দেখছিলাম আপনার স্বাস্থ্য আপনার ধানী জমি আর আপনার মেয়ের জীবনের কাছে কত তুচ্ছ।
সমাজঃ মানে?? কি বলতে চাও???
ডাক্তারঃ কি বলতে চাই শুনবেন?? ভালো লাগবে বললে?? আমাদের কথা শোনার মানুষ তো খুব একটা নেই এখন। আপনি শুনবেন??
সমাজঃ আরে এত ভণিতা না করে কি বলবে বলে ফেলো।
ডাক্তারঃ কথা হচ্ছে আপনি প্রতিবার আপনার উকিলকে কোর্ট ফি বাবদ ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। কেস কিন্তু একটাই ছিলো। এই টাকা দিতে আপনার কোন কষ্ট হয়নি। আপনি আপনার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য একদিন ২ ঘন্টা পড়ানোর খরচ হিসাবে প্রায় হাজার টাকা দিতে পারেন। আপনার কোন ক্ষোভ নেই তাতে। আপনার যত অভিযোগ আপনার আত্নীয়ের স্বাস্থ্যের যত্ন যিনি নিচ্ছেন তার প্রতি। তিনি কেন প্রতি বার রোগী দেখে ভিজিটের টাকা নেবেন। যদিও সে টাকার পরিমাণ খুব সামান্য হোক না কেন। আপনার আত্নীয়তো আর প্রতি দিন ডাক্তারের কাছে যান না। বা মাসে দুই বারের বেশি যাবার দরকারও হয় না। তাহলে মাসে আপনার আত্নীয় স্বাস্থ্য সেবা দানকারী ডাক্তার নামের মানুষটাকে যে সামান্য অর্থ দিচ্ছে তার জন্য আপনার এত কষ্ট কেন?? আপনার আত্নীয় যে রোগে ভুগছে তাতো নিরাময় যোগ্য নয়। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব কেবল। তাহলে প্রতিবার যাবার জন্য সেই ডাক্তার ভিজিট নিয়ে কি খুব বেশী ভুল করছেন। ধরেন আমি আপনাকে একটা সম্ভাবনার কথা বলছি। সেই ডাক্তার যদি পুরোনো রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করে দেন এবং তার রোগীর সংখ্যা যদি দিনে ৫০ হয় এবং তার অর্ধেক রোগীও যদি পুরনো হয় তাহলে সেই বেচারা কীভাবে জীবন চালাবে???? তার বাচ্চাকেও তো তার ভালো স্কুলে পড়াতে হবে তাইনা?? ধরেন সেই বেচারার যদি আপনার মত ধানী জমি নিয়ে কোন সমস্যা হয় তাহলে তারও তো উকিলকে টাকা দিতে হবে আপনার মত। তখন?? আপনারা শুধু ডাক্তারদের টাকা নেয়াটাই দেখেন। অন্যকিছু দেখেন না। কেন???
সমাজঃ এত বড় বড় কথা বলো না। তোমরা তো ডায়াগনস্টিকের কাছ থেকে ভালো টাকা পাও। অহেতুক টেস্ট দিয়ে আমাদের বাড়োটা বাজাও।
ডাক্তারঃ আপনার এই কথা সত্য। আমাদের ডাক্তারদের মধ্যে এই অসম্ভব খারাপ একটা জিনিস খুব বাজে ভাবে ঢুকে গেছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখবেন স্বাস্থ্য সেবার যে কাঠামো তাতে সরকারী ডাক্তারদের কিন্তু এই সুযোগ খুব একটা নেই। এই খারাপ কাজটা করে থাকে প্রাইভেট প্রাকটিস করা কিছু মানুষ। এর জন্য অবশ্যই ডাক্তার সমাজ দায়ী। তবে এর জন্য সরকারের দায়িত্ব এড়ানো মনোভাবের একটা বড় ভূমিকা আছে।
সমাজঃ কীভাবে??
ডাক্তারঃ ধরেন সরকার যদি একটা নীতিমালা ঠিক করে দিতো যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রতিটি টেস্টের খরচ কত পড়বে তাহলে ওদের মধ্যে এই অশুভ প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যেতো। আপনি নায্য খরচে টেস্ট করাতে পারতেন। সেক্ষেত্রে এই মনোপলি ব্যবসা একসময় বন্ধ হয়ে যেত। ডাক্তাররা সেখানেই আপনাকে টেস্ট করতে বলতেন যেখানে টেস্ট ভালো হয়। তখন মানের সাথে আপস করে ডাক্তারকে টাকা বাড়িয়ে দেবার মত অসুস্থ্য ঘটনা অনেক কমে যেত।
সমাজঃ কিন্তু তোমরা এত এত টেস্ট দাও কেন???
ডাক্তারঃ আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে বলবো, কিছু কিছু রোগের সাথে টেস্টের সম্পর্ক এত বেশি যে সেই টেস্ট ছাড়া ডায়াগনসিস করা সম্ভব না। এখন আমি টেস্ট না করে যদি ভুল ডায়াগনসিস করি তাহলে তো সমস্যাটা আপনারই হবে। তবে অবশ্যই ডাক্তারদের এথিকাল প্রাকটিস করা উচিত। যেটা করার পরিবেশ এখন আমাদের দেশে নাই।
সমাজঃ কেন নাই??? তোমরা চাইলেই পার। তা না করে তোমরা দলবাজি করে নিজেদের সুনাম নষ্ট করছো। শুনেছি তোমাদের নাকি কী সব ইথিক্স মেনে চলতে হয়। সেখানে নাকি বলা আছে তোমরা পার্টি পলিটিক্স, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এসব করতে পারবেনা। তাহলে তোমরা এগুলো কর কেন??
ডাক্তারঃ আপনার এই কথাটাও সত্য। ডাক্তাররা নীতিগত ভাবে পলিটিক্স করতে পারেনা।
সমাজঃ তুমি কি পলিটিক্স কর। অবশ্যই কর। তাইনা??
ডাক্তারঃ জ্বী আমাকেও কোন না কোন দলের খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে। কেন জানেন?? শুনতে চান একজন তরুণ চিকিৎসক কীভাবে প্রতিমুহুর্তে তার নিজের পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে। তাহলে শোনেন।
সমাজঃ বল। শুনছি।
ডাক্তারঃ যখন মেডিকেলে ভর্তি হলাম তখন অনেক আশা ছিল দেশের মানুষের জন্য কিছু করব। আমার ভাবনায় তখন মানবিকতা, মানব সেবা আর মানুষের হাসি মুখ দেখার ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা। দিন যায় আমি অবাক হতে শুরু করি। চারপাশের বড় ভাইদেরকে দেখি। আমাদের টিচারদের দেখি। কোথায় আমার স্বপ্নের জীবন। এতো স্বপ্ন নয়। এ বিভীষিকা। আমি প্রতিটি দিন একটু একটু করে বুঝতে শিখি এখানে পাস করতে গেলে আমাকে দল করতে হবে। আমার ক্লাশের কিছু ছেলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সারাদিন সিনিয়রদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সেই ছেলেদের দাপটে আমাদের অবস্থা খারাপ। তারা যা বলে ক্লাশে তাই হয়। আমাদের কথার কোন দাম নেই। তারা পরীক্ষা না দিয়েও প্রফেশনাল পরীক্ষার এডমিট কার্ড হাতে পাচ্ছে। আর আমরা আইটেম নামের সারাজীবনের বোঝা মাথা থেকে নামানোর জন্য সব কিছু উৎসর্গ করে চলেছি। এই মেডিকেলের ৫টি বছর জীবনের কত কিছু বাদ দিতে হয়েছে জানেন?? কত দিন ভুলে যেতে হয়েছে আমিও মানুষ। আমারও একটা সামাজিক জীবন আছে, বন্ধু আছে। আমারও ইচ্ছা করে দূর পাহাড়ে কারো সাথে ঘুরে আসতে। কেউ আমার সময়ের জন্য অপেক্ষার ডালি সাজিয়ে বসে থাকে। আমি পারি না। আমরা পারিনা। আমরা শুধু আইটেম ক্লিয়ার করতে পারি। ক্লিয়ার না হলে মন খারাপ করতে পারি। একটা সময় মন খারাপ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। কারণ তখন মনটাই নষ্ট হয়ে যায়। এরপর অতিকষ্টে প্রফের টেবিলে বসি। ভাগ্য ভালো হলে একবারে পাস করে যাই। আর না হলে আবার সেই চক্রে বাঁধা পড়ি। কোন রকমে সবকিছু শেষ করে যখন বের হই তখন জীবনের সুন্দর সময় গুলো আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বসন্ত বাতাস আর আমাদের ছুঁয়ে যায় না। আমাদের তখন পেটের দায়। এতদিন বাবার হোটেলে খেয়ে জীবন কেটেছে। আর কত?? অন্য প্রফেশনের বন্ধুরা বিয়ে করে ফেসবুকে কী সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করে। আর আমরা আমাদের গার্লফ্রেন্ডদের সাথে রাতে বিয়ের কথা তুললেই ঝগড়া করি। পায়ের নিচের মাটি যে একেবারে নরম। ওকে নিয়ে কীভাবে দাঁড়ায় বলেন?? তখনি দেখি, বুঝতে শিখি পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে গেলে আমাকে একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে। যদি ক্ষমতাশীন পক্ষ বেছে নেই তবে আমি পাবো কাঙ্ক্ষিত চাকরী। বিসিএস হয়ে যাবে আমার। তখন দুজন একসাথে দাড়াতে পারবো জীবনের পলল ভূমিতে। তখন দেখার সময় কোথায় চাকরী কি সৎ ভাবে এলো না অসৎ ভাবে। তারপর শুরু হবে তেনাদের যন্ত্রণা। আজ চাঁদা, কাল মিটিং, পরশু নির্বাচন। বাঁচি আর মরি উপস্থিত থাকতেই হবে। না হলে যে পায়ের নিচের মাটি আবার নরম হয়ে যাবে। কে চায় বলেন নিজের ক্ষতি। সময়ের নিষ্ঠুর প্রয়োজনের শিকলে বন্দী আমার বিবেক। আমি পারি না এই শিকল ভাঙতে। উপরে ওঠার সিঁড়ির গোড়ায় রাজনীতি নামের পাহারাদার। সে দরজা না খুললে আমার যে কিছুই হবেনা। এখন বলেন একজন তরুণ ডাক্তার হিসাবে আমি কী করতে পারি?? কীভাবে আমি মানব সেবা করবো??
সমাজঃ হুম। কিন্তু তোমাদের নিজেদের মধ্যে এই দলাদলি করে লাভ কি??
ডাক্তারঃ লাভের কথায় তো এতক্ষন বললাম। জাগতিক লাভের জালে বন্দী হয়েই তো আমাদের এই দশা। আরো মজা হলো, আমি যে উচ্চতর ডিগ্রি নেবো সেখানেও রাজনীতির মাধ্যমে যেতে হবে। প্রাইভেট হাসপাতালে আমাদের মেডিকেল অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়। ৮ ঘন্টা ডিউটি করে আমরা ৩৫০ টাকা পাই। এবার বলেন একজন রিকশাচালক ৮ ঘন্টা রিকশা চালিয়ে এই টাকা উপার্জন করতে পারে কি না?? যদি পারে তাহলে আমরা কোথায় আছি??
সমাজঃ কিন্তু তাই বলেতো তোমরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারনা। প্রায় তোমাদের ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যাবার খবর আসে। এইটা কেন??
ডাক্তারঃ জ্বী। আমাদের ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়। তবে সেই সংখ্যাটা হাজারে কত সেটা কি একটু খেয়াল করেছেন।
সমাজঃ কী হাজারে কত??
ডাক্তারঃ আচ্ছা তাহলে আরেকটু বুঝিয়ে বলি। আচ্ছা ধরেন সরকারী হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগীর চিকিৎসা হয় তার মধ্যে প্রতিদিনই কি রোগী মারা যাচ্ছে ভুল চিকিৎসায়?? না যাচ্ছেনা। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায় নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছে। এমনও অনেক ডাক্তার আছেন যারা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়েও মাঝে মাঝে গরীব রোগীদের চিকিৎসা করেন। কই সেই খবরতো পত্রিকায় আসেনা। প্রতিদিন কত গাইনি ডাক্তার একটা নতুন জীবনকে পৃথিবীতে আনতে সাহায্য করছে এর মাঝে কত কেস যে চ্যালেঞ্জিং কেস থাকে যেখানে সর্বোচ্চ পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়, অনেক ধৈর্য্য আর কষ্ট নিয়ে রোগী ম্যানেজ করতে হয় সে খবর কি আমরা পাই?? না পাই না। আমরা পাই শুধু খারাপ খবর গুলো। এর মধ্যে এমনও কেস থাকে যেগুলো সত্যি অনেক খারাপ অবস্থায় ছিল। এমনও হয় ডাক্তার ঠিক মত সব কিছু করলেও প্রয়োজনীয় উপকরণ বা ওষুধের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। সেটা কেও ডাক্তারের দোষ বলে প্রচার করছে মিডিয়া। কারণ এইসব মিডিয়ার কাজ হচ্ছে খবর বেঁচে ব্যবসা করা। সাধারণ মানুষ যা পড়তে পছন্দ করবে সে ধরণের খবরই তারা বিক্রি করবে।
সমাজঃ তারমানে কি তুমি বলতে চাচ্ছো তোমাদের কোন দোষ নেই?? সব মিডিয়ার দোষ??
ডাক্তারঃ আমি এমন কিছুই বলতে চাচ্ছিনা। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে আমাদের মধ্যে ভালো খারাপ দুই ধরণের মানুষই আছে। সেখানে শুধু খারাপ খবর গুলো প্রকাশ করে আমাদেরকে সমাজের একটা নষ্ট অংশ হিসাবে প্রচার করে কি খুব বেশী লাভ আছে?? সাধারণ মানুষের মনে যদি ডাক্তার সম্পর্কে খারাপ ধারণার জন্ম হয় তবে তো সে আর নিজের চিকিৎসকের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবেনা। এর ফলাফল কত খারাপ হবে ভেবে দেখেছেন কি?? আমাদের ভুল গুলো তুলে ধরার সাথে সাথে ভালো উদাহরণ গুলো তুলে ধরলেই তো আর সমস্যাটা হয়না।
সমাজঃ তোমাদের ভালো খবরগুলো কি আসেনা বলতে চাচ্ছো???
ডাক্তারঃ ভালো খবর?? একজন ডাক্তারকে ধর্ষণ করতে যেয়ে না পেরে মেরে ফেললেও সে খবর পেপারে আসে না। তার জন্য আমাদের সমাজের কোন সহানুভূতি নেই। সেতো ডাক্তার, সে তো মানুষ না। সে হলো কসাই। সমাজের উঁচু স্তরের কোন মানুষ যদি একটা মহান পেশা সম্পর্কে ঢালাও ভাবে এধরণের মন্তব্য করতে পারেন তাহলে সেই মন্তব্য তো আমাদের মত হুজুগে পাগল জাতি লুফে নেবেই। তার অনিবার্য পরিণতি হলো এই পেশা সম্পর্কে মানুষের অযাচিত ভুল ধারণা। আমাদের এক বোন মারা গেলেন। তাকে খুন করা হল। তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হল। আমাদের সেই বোন অনেক মেধাবী ছিলেন। প্রফে প্লেস করা ছাত্রী ছিলেন। হয়তো ভবিষ্যতে অনেকদূর যেতে পারতেন তিনি। এই সমাজ তার জন্য চোখের পানি ফেলছে না। দেশের বিবেক নামের তথাকথিত বিবেকহীন মানুষগুলো এখন নিশ্চুপ। একজন অখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়ার মারা গেলেও পেপারে তাকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অথচ তার তুলনায় সমাজের জন্য আমার সেই বোনটা কত বেশি মূল্যবান ছিল ভেবে দেখেনতো। আমরা আসলে বুঝতে পারিনা আমাদের কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমাদেরকে সেই দিক নির্দেশনা দেবে এমন লোকও নেই।
সমাজঃ কিন্তু তোমাদের সংগঠনও তো চুপ। সেই কথাটা বলো না কেন?? তারা কী করছে??
ডাক্তারঃ আমাদের নিজেদের সংগঠন কাজ করছে তো। তারা বিএমএ ভবনে বসে চা-পানি খাচ্ছে। কাকে কোথায় পোস্টিং দেয়া যায় তা আলোচনা করছে। কত টাকা কোন খাত থেকে পাওয়া সম্ভব সেই অংক করছে। তাদের আর কাজ কি?? আসলে এই ব্যাপারে আমাদের ডাক্তারদের লজ্জিত হওয়া উচিত যে সাংগঠনিক ভাবে আমরা এত দূর্বল। কিন্তু ঐ যে রাজনীতি। সেই কারণে আমরাও এখানে নিরব দর্শক।
সমাজঃ আসলে আমরা খুব খারাপ একটা সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি।
ডাক্তারঃ শুধু একটা অনুরোধ করবো আপনাকে।
সমাজঃ কি অনুরোধ??
ডাক্তারঃ আপনার পরিচিত কেউ যদি মেডিকেলে পড়তে চায় তবে কষ্ট করে তাকে নিরুৎসাহিত করবেন। জীবনের এই নিদারুণ অপচয় আর ভালো লাগেনা। সহ্য হয়না।
লিখেছেন- Dr. Tanvir- UH, UK
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন