অ্যালার্মের শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠল জয়। আজ তার অফিসের প্রথম দিন আর আজকেই যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে খুব খারাপ হবে। তাড়াতাড়ি বিছনা থেকে নামলো সে ।গোসল করে তৈরি হয়ে নিল।“ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো” তার স্বপ্নের কর্মক্ষেত্র। সারাজীবন এইখানে চাকরি করার স্বপ্ন দেখেছে সে।আজ তার স্বপ্ন পূরণের দিন।রায়া অবশ্য তাকে সবসময় খেপাত এই জন্য।বলত “এতো পড়াশুনা করে শেষপর্যন্ত বিড়ি বিক্রি করবা?” জয় খুব হাসত শুনে।“পাগলি একটা” কথাটা মনে পড়ে যাওয়াতে মনে মনে বলে সে।এই পাগলিটার জন্যই তার এতো কিছু করা। তাড়াতাড়ি পড়াশুনা শেষ করতে হবে, ভালো চাকরি পেতে হবে,পাগলি টাকে বিয়ে করতে হবে...সব কিছু প্ল্যান করে রেখেছিল জয়।কিন্তু কিছুই হলনা। কারন সে ভালবেসেছিল একটা বিশ্বাসঘাতককে।চারটা বছর ধরে তাকে ভালবাসার স্বপ্ন দেখিয়ে স্বার্থপরের মত চলে গেছে রায়া ।তাই মুহূর্তেই মুখের হাসিটা বিলিন হয়ে যায় তার।নাস্তা না করেই রওয়ানা দেয় অফিসের উদ্দেশে।

অফিসের প্রথম দিন খুব ভালো কাটল জয়ের। প্রথমদিনেই বসের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল সে। হবে নাইবা কেন। খুব অল্প বয়সেই অনেক বড় পোস্টে চাকরি পেয়েছে।ভাগ্য নয়, যোগ্যতার বলেই তার চাকরি পাওয়া। এতো ভালো রেজাল্ট ওর,বহু নামীদামী কোম্পানির কাছ থেকেই চাকরির অফার পেয়েছিল সে!!! অবশ্য এর পিছনেও রায়ার ই অবদান বেশি।রায়াকে বিয়ে করবে বলেই গত পাঁচটা বছর নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়াশুনা করেছে জয়। সেই জন্যই আজ এতো ভালো চাকরি জুটেছে কপালে।জয় অবশ্য এসব নিয়ে এখন আর অত ভাবেনা। যখন রাতের পর রাত রায়ার সাথে ফোনে কথা বলে নির্ঘুম কাটাত,ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত দুজনে মিলে তখন ভাবত। কিভাবে সংসার সাজাবে,কিভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে...কত কথা,কত হাসি ,কত কান্না, খুনসুটি... সব আজ অতীত। সময়ের নির্মম আঘাতে আলোকোজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন হারিয়ে গেছে অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে।জয় ভাবতে চায়না ,তাও মনে পড়ে যায় ঐ অকৃতজ্ঞ মেয়েটার কথা। যাবেই তো ,সে তো আর রায়ার মত অকৃতজ্ঞ না যে, সব কথা, ভালোবাসা এতো সহজে ভুলে যাবে।জয় ভোলেনি, ভুলবেও না। তবে রায়া যেমন তাকে কথা দিয়ে রাখেনি সেও রায়াকে দেয়া একটা কথা রাখবেনা ঐ কথাটা না রেখে সে প্রতিশোধ নেবে রায়ার উপর।

রাতে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করতে করতে হটাত একটা ফাইল চোখে পড়ে যায়। অনেকদিন ফাইলটা নজরে পড়েনি জয়ের। ফাইল ভর্তি রায়ার ছবি। ইচ্ছা করেই এতদিন ছবি গুলো দেখেনি জয়।তবে আজ আর নিজেকে সামলাতে পারল না সে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভাবে জয় ফিরে যায় আজ থেকে তিন বছর আগে...।

রায়ার সাথে খুব ভালভাবে দিন কাটছিল জয়ের।কী সুখেই না ছিল তারা!!পাগলের মত ভালবাসত একজন আরেকজনকে।রায়াকে সবসময় বউয়ের মতই ভালবেসেছিল জয়। রায়ার হাসি,কান্না,আনন্দ সবকিছুই ছিল জয়কে ঘিরে,আর জয়ের সব কিছু ঘিরে ছিল রায়া । কিন্তু হঠাৎ করে একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেল।রায়ার মা বাবার মধ্যে অনেক দিন ধরেই ঝামেলা চলছিল। একদিনআচমকা সেই ঝামেলা বিশালাকার ধারণ করল।সারাদিন রায়াদের বাড়িতে ঝামেলা লেগেই থাকত।চোখের সামনে প্রতিনিয়ত মা বাবার ঝগড়া দেখে রায়ার খুব কষ্ট হত। কিন্তু জয়কে আঁকড়ে ধরে ভালো থাকার চেষ্টা করছিল সে।কিন্তু একদিন জয়ের সাথে প্রচণ্ড কথাকাটাকাটি হল ।দুই তিন দিন ধরে চলতেই থাকল। একেতো মা বাবার অশান্তি তার উপর জয়ের কাছ থেকে আচমকা আঘাত পেয়ে একদম চুপ হয়ে গেল রায়া । ঐ এক রাতের মধ্যেই জয়ের কাছ থেকে কেমন যেন দূরে সরে গেল সে।তার আগের মত হাসি,কথা,জয়ের সাথে খুনসুটি কিছুই রইল না।জয় যখন বুঝতে পারল রায়ার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময়টাতে সে কিছুই করতে পারেনি,বরং সামান্য একটা কারণে রায়াকে কষ্ট দিয়েছে নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল জয়ের। যে সময়ে রায়ার খুব দরকার ছিল তাকে, ঠিক সেই সময়েই রায়াকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। নিজের ভুলগুলো শোধরানোর জন্য পাগল হয়ে উঠল জয়। কিন্তু ততদিনে খুব দেরি হয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও রায়া আর তার সম্পর্ক টাকে আগের মত সহজ করতে পারলনা জয়। রায়া রাতে ঘুমাতে পারেনা,সময় মত খায়না,সারাদিন একা একা থাকে। জয়ের সাথে আগের মত কথাও বলেনা। জয় সব দেখে, বঝে,কিন্তু কিছুতেই রায়াকে আগের মত করতে পারেনা। এদিকে নিজের প্রতি অবহেলার কারনে আর অসহনীয় মানসিক কষ্টের কারণে রায়ার শরীরে বাসা বাধে এক দুরারোগ্য ব্যাধি। জয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না কথা টা শুনে। সে থাকতে তার রায়ার কিছু হবে এটা কিছুতেই মানতে পারছিলনা সে।ছুটে গেল রায়ার কাছে। জয়ের কথা সব জানত বলে ক্লিনিকের রুমে জয়কে ঢুকতে দেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল রায়ার মা। বিছানায়ে শোয়া রায়ার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল জয়। এ কাকে দেখছে সে??!! রায়ার যে চোখ দুটোর জন্য সে পাগল ছিল সেই চোখ আজ কোটরাগত,চোখের নিচে জমেছে কালি। নিষ্পাপ মুখে দুর্বলতার স্পষ্ট ছায়া,রক্তশূন্য ফ্যাঁকাসে মু্‌খে কোন হাসি নেই। এ তো জয়ের রায়া না!!! জয়ের রায়া তো সেই হাসি খুশি নিষ্পাপ মেয়েটা, যার চোখে মুখে সবসময় খেলা করত দুষ্টুমি আর জয়ের জন্য অনেক ভালোবাসা। জয় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। জয়কে দেখে মুখে হাসি ফুটল রায়ার ।কিন্তু এই হাসি জয় কখনই দেখতে চায়নি ।হাতের ইশারায়ে রায়া কাছে ডাকল জয়কে।কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার।তবুও বল্ল
"আমাকে মাফ করে দিও।আমি মনে হয় আমার কথা রাখতে পারবনা। তোমার সাথে সারাটা জীবন কাটানো হবেনা আমার।’’
এ কথার পর দুজনে কান্নায়ে ভেঙে পড়ল।
রায়ার শীর্ণ হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল
“না...তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।আমি কোথাও যেতে দেবনা তোমাকে।”
“না সোনা... আমাকে তো যেতেই হবে। এভাবে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।”
“আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। তুমি এরকম বলনা।”
“আমাকে যেতেই হবে,আমার হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একটা কথা দিতে হবে তোমার। আমাদের স্বপ্ন গুলো তুমি পূরণ করবা। খুব ভালো করে লেখাপড়া করবা। ভালো রেজাল্ট করবা। তারপর বিড়ি বিক্রি করবা।”
রায়া হেসে ফেলে,কিন্তু জয় হাসতে পারেনা।
“তারপর তুমি সুন্দর দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করবে।অনেক ভালবাসবে তাকে।”
“না রায়া...এ হয়না। তুমি এসব বলনাতো। থাম তুমি...কিচ্ছু হবেনা তোমার।’”
“না...আমাকে বলতে দাও। তুমি বিয়ে করবে জয়। আমরা যেমন ঠিক করে রেখেছিলাম আমাদের মেয়ে হলে নাম টুনটুনি হবে,সেরকম তোমার মেয়ে হলে নাম টুনটুনি রাখবে।
“বাবু... প্লিজ চুপ করো।”
জয় আর্তনাদ করে ওঠে।
“না।।চুপ করবনা।তুমি আমাকে কথা দাও, প্লিজ প্লিজ।তুমি কথা না দেয়া পর্যন্ত আমি থামবনা।”
রায়ার কষ্টটা স্পষ্ট দেখতে পায় জয়।
“আচ্ছা।।তুমি যা বলবে তাই হবে।এইবার শান্ত হউ।”রায়াকে চুপ করানোর জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় সে। তারপর আবার দুজনে ভেঙে পড়ে কান্নায়। একজন আরেকজনকে হারানোর ভয়ে পাগলের মত কাঁদতে থাকে তারা। এই ঘটনার দুইদিন পর জয়কে ছেড়ে স্বার্থপরের মত চলে যায় রায়া। সব ভালোবাসা মিথ্যা করে দিয়ে জয়কে একা রেখে চলে যায় সে।জয় ভাবতে থাকে রায়ার মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করবে সে? রায়ার মা বাবাকে নাকি নিজেকে??অনেকদিন রায়ার ছবি সামনে নিয়ে প্রশ্ন করেছে জয়...কিন্তু কোন উত্তর পায়নি। পাবেওনা কোনদিন। আর পেয়েও বা কি লাভ?? উত্তর পেয়ে তো সে তার রায়াকে ফিরে পাবেনা।

সম্বিত ফিরে পায় জয়।নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার। মনে মনে বলতে থাকে “তুমি যেমন আমাকে দেয়া কথা রাখনি,আমিও রাখবনা রায়া।তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে যাবেনা,কিন্তু তাও চলে গেলে। এতটা স্বার্থপর কেন তুমি?? আমার কথা একবারও ভাবলে না।আমিও ভাববনা তোমাকে দেয়া কথা।তুমি ছাড়া আর কাউকে আমি কোনদিনও ভালবাসতে পারবনা,বিয়ে তো অনেক দূরের ব্যাপার। তুমি ভেবনা যে আজ আমি এতো ভালো চাকরি তোমাকে দেয়া কথার জন্য করছি, এটা শুধু আমার মা বাবার জন্য।তোমাকে দেয়া কথাতো আমি কবেই ভুলে গেছি। তোমার মত স্বার্থপরকে দেয়া কথা ভুলে যাওয়াই উচিৎ। তুমি সারাজীবন উপর থেকে দেখবে যে তোমার জয় কেমন ভাবে একাকীত্বের আগুনে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।আর তখন আমার থেকে কষ্টটা তোমারি বেশি হবে। আর এটাই তোমার শাস্তি। সারাটা জীবন তুমি আমার কাছে স্বার্থপর হয়েই থাকবে। পৃথিবীর সবথেকে বড় স্বার্থপর।’কপট রাগ আর নিখাদ ভালোবাসা নিয়ে রায়া নামের স্বার্থপর মেয়েটার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে জয়। 
 
Top