সাজত পুলকের সাথে বিশেষ কোনদিনে ঘুরতে বের হবে বলে। তনু অতটা সুন্দরী নয় তবে সাজগোজ করলে খারাপ লাগে না দেখতে। শোবার ঘরটাকে ফুলদিয়ে সাজিয়েছে সেই প্রথমরাতের মত করে। অনেক কিছু রান্নাও করেছে। ছোটখাট সংসার ওদের ইনকাম ও সীমিত তাই অনেক শখই ইচ্ছে থাকলেও অপূর্নতার খোলস ছেড়ে বেরুতে পারে না। পুলক এসবের কিছুই জানে না,ওকে সারপ্রাইজ দিবে বলেই তনুর এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। পুলক কে আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরতে বলেছিল তনু। ঘড়ির কাঁটা দেখতে দেখতে দশটার ঘর পেরিয়েছে সবে। তনুর ধৈর্যের প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু পিলারটিও এবার ধূলার সাথে মোলাকাত করল। তনুর ভাবনার চরে এসে আটকে গেল আগের দিনের স্মৃতিগুলো.......
তনু ছোটবেলা থেকেই অনেক পড়ুয়া আর লক্ষী একটা মেয়ে।সবসময় নিজের ভুবনে ডুবে থাকত,কেউ নিজে থেকে কথা বললে কেবল উত্তরটা দিত। দেখতে অত আহামরি না হওয়ায় ওর আবেগের মধুতে ভ্রমর এসে হানা দিত না। একার নদীতে সে ইচ্ছেমত বিচরন করত।কখনো গভীর জলে ডুব দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকত কখনোবা সাঁতার কাঁটত আবার কখনো পালতোলা নৌকায় করে হারিয়ে যেত দূর দূরান্তে।সুখের সিংহাসনে ছিল ওর একছত্র অধীকার।একটা পাবলিক ভার্সিটিতে বি বি এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তনু। একই গ্রুপে কাজ করতে করতে পুলকের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল তনু। ছেলেটা অসম্ভব রকমের ভালো।
তনুর ভালো লাগার মুহুর্তগুলোকে অলংকার পরিয়ে দিত পুলক আর মন খারাপের অন্ধকার আকাশটাতে পূর্নিমার আলো ছড়িয়ে দিত। একা একা থাকার কারনে তনুর পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছিল।পুলকের স্পর্শে তনুর ছোট্র নদীটা একদিন বিশাল সাগরের বুকে ঝাপ দেওয়ার দূর্বার সাহসে মাতোয়ারা হয়ে উঠল।তনুর অবাধ্য মনটা কখন জানি পুলক কে মনমন্দিরে দেবতার আসনে বসিয়ে পূঁজা দিতে শুরু করল নিজের অজান্তেই।পুলক কে নিয়ে একটার পর একটা নতুন নতুন স্বপ্নের সিঁড়ি বানিয়ে ফেলল তনু।মাঝে মাঝেই তনু আর পুলক দূরের পথে হাঁটতে যেত।পায়ে হাটার ক্লান্তিগুলোকে আড়াল করে দিত পুলকের নানারকম গল্পের ঝুড়িগুলো। তনুই যতই শুনত ততই মুগ্ধ হত। ও ভেবে পেত না একজন মানুষের কথা কি করে এত প্রানবন্ত হয়। তনুর মনে হত পুলক যখন গল্প বলে তখন ওর প্রত্যেকটা কথা জীবিত হয়ে এক একটা দৃশ্যপট তৈরী করে।
একদিন পুলক তনুর একটা বই নিয়ে গিয়েছিল। বইটার শেষপাতায় লেখা ছিলঃএই পুলক,তুই ভালো কেন রে?কেন তোকে আমার এত ভালো লাগে? কেন আমার কল্পনার কালপুরুষের ফ্রেমে বারবার তোর অবয়ব দেখতে পাই বলতে পারবি?যাহ !! তুই আবার কেমনি পারবি,তুইতো আস্ত একটা মাথামোটা। তুই মোটেও আমার দৃষ্টির সাগরে ডুবতে জানিস না। পুলক এটা নিয়ে তনুকে কিছু বলেনি।তনুও বলেনি।ওদের দুজনেরই ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। আগের মত আর পুলকের সাথে সময় কাটানো হয় না তনুর। হঠাত্ ই একদিন পুলক তনুকে ডেকে বলল,এই যে ম্যাডাম আপনি আমার মায়ের একমাত্র পুত্রের পুত্রবধু হবেন? সেই মুহুর্তটার কথা মনে হলে তনুর অনুভূতিগুলো আজো আনন্দে শিহরিত হয়।
সাতবছর হল পুলকের সাথে বিয়ে হয়েছে।এখনো ওদের ছোট্র ঘরটাতে গুটি গুটি পায়ের পদাংঙ্কন হয়নি।ডাক্তার দেখিয়েছে বেশ কয়েকবার কিন্তু কারোর ই কোন সমস্যা প্রমানিত হয় নি।কি আর করা হয়ত হাতের লেখা সহমত জানায়নি।তনু চাকরী করুক এটা পুলকের পছন্দ নয়।তাই তনু সারাটাদিন বোবার মত ঘরে বসে থাকে,কখনোবা ছোটদের মত আবদার করে বসে পুলকের কাছেঃচলনা আজ সন্ধ্যায় একটু বাইরে বের হই!পুলকের সেই মুখস্ত করা উত্তর,"আজ একদমই সময় নেই লক্ষীটি আরেকদিন"শুনতে শুনতে একঘেয়েমী এসে গেছে তনুর।
আজ ওদের বিবাহবার্ষিকি।তনু একসপ্তাহ আগে থেকে পুলক কে বলে রেখেছিল আজকের দিনটায় যেন একটু খানি সময় তনুর জন্য বরাদ্দ করা হয়।এগারটা বাজে,তনুর আকাশটা ভেঙে বৃষ্টির অঝোর ধারা নামতে শুরু করল।সব আয়োজন পন্ড করে তনু যখন শুয়েছে তখন পুলক আসল।এতদিনের জমে থাকা ক্ষোভ যেন নতুন করে জেগে উঠল তনুর।তোমার সাথে থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না পুলক।দয়া করে সকালের ট্রেনের টিকিট টা এনে দিয়ে আমার শেষ উপকারটা কর।পুলকঃমাত্র তো বাসায় আসলাম এখন আর যাবো না বিকেলের ট্রেনে যেও।নাহ্ তুমি এক্ষুনি যাও।পুলক সাড়ে বারোটায় বাসায় ফিরল।পুলকঃএই নাও তোমার তোমার টিকিট।খুব সকালের ট্রেন কিন্তু ।এখন ই ব্যাগ গুছিয়ে নাও।তনুঃএকি এটা তো সিলেটের টিকিট!পুলকঃহ্যা সিলেট ই তো। তোমাকে বলেছিলাম না সামনের ম্যারেজ ডে তে আমরা সিলেট যাবো।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন