ভালবাসারাত প্রায় ১২টা। কিছুক্ষন আগের ব্যাস্ত রাস্তার পাশ ধরে হেটে যাচ্ছে দুটি ছেলে। বয়স কতই বা হবে? বড়জনের ১৯-২০ আর ছোটজনের ১৮-১৯। দুজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। রাস্তার নিয়ন আলো তৈরি করেছে এক রহস্যময় পরিবেশ। যে পরিবেশে সব কিছু অচেনা লাগে। মাঝে মাঝে দু-একটি গাড়ি চলে যাচ্ছে, দুরপাল্লার বাসগুলো কিছুক্ষন পর-পর তাদের যাত্রী নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে, রিকশাওয়ালাগুলোও ঝিম ভেঙ্গে ঘুম-ঘুম চোখে যাত্রীর আশায় তাকাচ্ছে। যান্ত্রিক কোলাহল যেন অবসাদ গ্রস্থ হয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিচ্ছে। এরই মাঝে হাটছে তারা, মাঝে মাঝে নিকোটিনের ধোঁয়ায় বুকের শুন্যস্থানগুলো পূর্ণ করে নিচ্ছে।
-“মিশু, চলো, কোথাও বসি। হাটতে ভালো লাগছে না”।
-“কই বসবেন মাফি ভাই? বসার যায়গা তো দেখিনা।”
-“চলো, রেন্ট-এ-কারের দোকানগুলার ওখানে বসার জন্য বেঞ্চ করা আছে। ওইখানে বসি”।
-“চলেন, বসি”।
ছেলে দুইটা একজন আরেকজনের সিনিয়র-জুনিয়র হলেও সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো। একজন
আরেকজনের সাথে সব কথা শেয়ার করে। পড়াশুনার জন্য দুজনে শহরে এসেছে ভিন্ন সময়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ভিন্ন। মেসে হঠাত করেই পরিচয় হয় দুজনের। দুজনেই একই এলাকার। একই জেলা শহরের ছেলে তারা। সেখান থেকে একইসাথে থাকে তারা। মিশু শহরে এসেছে মাফির আগে। এসএসসির পরেই শহরে এসেছে। আর মাফি ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে এসেছে। মিশু একটা পলিটেকনিক কলেজে পড়ছে, আর মাফি এডমিশন কোচিং। মিশুর ডাকেই বাইরে এসেছে মাফি। ছেলেটার মন সন্ধ্যা থেকে খারাপ দেখছিলো মাফি। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলেনি। শেষে কিছুক্ষন আগে বলে, ভাই চলেন, বাইরে থেকে হেটে আসি। মনটা খারাপ লাগছে। দ্বিমত করেনি মাফি।
-“ভাই, আসেন, এই বটগাছের এইখানে বসি” বটের গোড়াটায় ইট দিয়ে প্লাস্টার করে বসার যায়গা করা হয়েছে। পাশে অবশ্য কয়েকটা বেঞ্চ মতো করা আছে। তবু এই জায়গাটা দুজনেরই অনেক পছন্দের। তাই বসে গেলো দুইজন।
-“কি হইছে বলোতো। মন খারাপ কেনো? কোনো সমস্যা?”
-“মিথিলার কথা মনে হচ্ছে বেশি”।
-“ডায়েরি খুলছিলা?”
-“হুম। জিনিসপত্র গোছগাছ করতে গিয়ে সামনে পড়লো”।

মিথিলার সাথে মিশুর সম্পর্ক বছরখানেকের। কিছুদিন আগে তাদের ব্রেক আপ হয়। মিথিলা শুধুমাত্র এটুকুই বলে, তোমার সাথে আমার আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব না। আমাকে আর কোনোদিন ফোন দিবানা। মিশু পরে অনেক যোগাযোগের চেষ্টা করলেও মিথিলা কথা বলেনি। খোঁজ নিয়ে মিশু জানতে পারে অনেক দিন আগে থেকেই মিথিলার সাথে অন্য একটা ছেলের সম্পর্ক চলছিল। মিশু ফোন অনেক বার ওয়েটিং পেলেও বিশ্বাস করত বলে কিছু জানতে চায় নি। সে সময়গুলোতে মিশু ডায়েরী লিখতো। অনেকবার ডায়েরীটা নষ্ট করে ফেলতে চেয়েও মিশু পারেনি। আর তাই আজো ডায়েরীর পাতায় পাতায় মিশে থাকা স্মৃতি গুলোর দিকে চোখ গেলেই মনটা তার কেঁদে ওঠে।
বসে বসে মিশুর কথা শুনছিল মাফি। আর সেই সাথে অনেকক্ষন ধরেই ওরা লক্ষ করছিলো পাশের বেঞ্চে কেউ একজন ঘুমানোর চেষ্টা করছে, পায়ের পাশে একটা কয়েল জ্বালানো। তবে তাতে মশার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেনা বলে হয়ত আপাদমস্তক কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছে মানুষটি। সেই মানুষটিই যখন উঠে বসে, কাঁথার মধ্য থেকে একজন পঞ্চাশোরধ বৃদ্ধ বের হয়ে আসে। তখনো তারা কিছু মনে করেনি কারন রাস্তার পাশে এমন অনেকেই শুয়ে থাকে। কিন্তু তারা কিছুটা অবাক হয় যখন লোকটি তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,
-“আপনাদের কাছে মোবাইল আছে বাবা? একটু বাড়িত কথা কমু”।
-“আছে, কিন্তু টাকা নেই”, মিশু বলে।
উৎসাহী হয়ে পড়ে মাফি। একে তো বৃদ্ধ মানুষ, তার উপর আপনি বলে সম্বোধন করায় কেমন যেন লাগে মাফির। তার মনে হয় বৃদ্ধ কোনো সমস্যায় আছেন। সাধারনত যারা রাস্তার পাশে ঘুমায়, তাদের সাথে সে মানুষটার মিল পায় না। কিছুটা উৎসাহী হয়েই সে তার সেলফোনটি এগিয়ে দিয়ে বলে, -“এই নেন”।
-“বাবা, আপনি একটু নাম্বারডা তুইলে কল দিয়া দিবেন? আমি বুড়ো মানুষ, দেখতি কষ্ট হয়”।
-“হুম, নাম্বার বলেন”।
-“০১৯.........”
-“নেন, রিং হচ্ছে”।

বৃদ্ধ হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে কথা বলতে থাকে। সেদিকে খেয়াল না করলেও কিছু কথা আবছা ভাবে কানে আসছিল তাদের। সেগুলাই বৃদ্ধর প্রতি আগ্রহী করে তোলে দুজনকে। কথা শেষ হলে বৃদ্ধ ফোনটা এগিয়ে দেয়। বৃদ্ধর চোখের কোনায় পানি টলমল করছে। মিশু প্রশ্ন করে,
-“চাচা, কোনো সমস্যা? আপনি মনে হয় কোনো সমস্যায় পড়ছেন”।
-“হ্যা বাবা। এইহাঁনে আইছি আইজ নিয়া তিনদিন হয়। আমাগো বাড়ি ডুমুরিয়ায়। গিরামে। চাষবাস কইরে খাই। আমার একখান ছাওয়াল। বেরেন একটু খারাপ। বোঝেসোঝে কম। আমার সাথে ঝগড়া কইরে বাড়িরতে চইলে আইছে। কনে আছে, কি খাচ্ছে কিচ্ছু জানিনে। গিরামে আয়না চালান দিয়া দেখিছি ছাওয়ালডা এইহানে জোগাইড়ের কাম করতিছে। তাই আইছি এইহানে। ছাওয়ালডারে খুজতিছি। সকাল বেলা লেবাররা এইহানে বসে। তাই সকালে খোজবো। এই দুইদিন অন্য দুই যায়গায় খুজিছি। দেহি, ছাওয়ালডারে পাই কিনা”।
-“কিছু খেয়েছেন আপনি?”, মাফি জিজ্ঞেস করে।
-“খাইছি। চিড়ে আর মুড়ি ছিল, তাই খাইছি”।
-“মিশু, আসতো আমার সাথে”।
-“কই যাবেন ভাই?”
-“আসো”।
একটু পর দুজনে ফিরে আসে। হাতে এক প্যকেট কেক, এক বোতল পানি আর চারটি কলা। বাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধের দিকে,
-“চাচা, খান”।
-“আমি তো খাইছি বাবা। আপনারা আবার এইসব নিয়া আসছেন ক্যান?”
-“চিড়া-মুড়ি খেয়ে আপনার ছেলেকে খুজতে পারবেন? খান, সুস্থ না থাকলে শেষে আপনার বাসা থেকে আসা লাগবে আপনাকে খুঁজতে”।
-“তালি আপনারাও আমার সাথে নেন”।
-“আচ্ছা, নিচ্ছি, আপনিও নেন” বলে দুটি কেক হাতে তুলে নেয় মাফি। একটা মিশুর হাতে তুলে দেয় আরেকটাতে নিজে কামড় বসায়।
-“চাচা, আপনি তাহলে থাকেন, অনেক রাত হয়েছে, আমাদের ফিরতে হবে”।
বৃদ্ধের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে দুজনে যাত্রা করে মেসের রুমের দিকে। তারা খেয়াল করলে হয়তো দেখতে পেত বৃদ্ধের চোখের কোনে একবিন্দু অশ্রু।
-“ভাই, এতোদিন আব্বু-আম্মুকে ভালোভাবে বুঝিনি, তাদের কথা শুনতাম না। তাদের শাষনটাই শুধু চোখে পড়তো, আজ বুঝলাম উনারা আমাদের কতোটা ভালোবাসেন। শুধু শুধু বাইরের এক মেয়ের ভালোবাসা পাইনি বলে মন খারাপ করেছিলাম। কিন্তু যারা আমার জন্য ভালোবাসার ডালি নিয়ে বসে আছেন, তাদের কখনো বলা হয়নি ভালোবাসি। তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আজ এই বৃদ্ধকে না দেখলে বুঝতাম না বাবা-মা সন্তানের জন্য কতটা চিন্তা করেন। আমি আর কখনো কোনো ফালতু মেয়ের জন্য মন খারাপ করবোনা”।
-“উনি আসলেই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। আমিও কখনো আব্বু-আম্মুকে ভালোবাসি বলিনি”।

দুই মিনিট পর...
মাফি এবং মিশু দুজনের বাসার ফোন একই সাথে বেজে উঠলো। দুই বাসায় ফোন রিসিভ করেই প্রথম কথা ছিল, “কি রে? এতো রাতে? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
মাফি বা মিশু দুজন কেউ উত্তর দিতে পারলনা। কিছুক্ষন পর বলল, “তোমাদের জন্য মন খারাপ লাগছিল, তাই ফোন করলাম”।
-“এত রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেনো? যা, ঘুমা”।
-“হ্যা, মা। ঘুমাচ্ছি। ভালো থেকো”।

পরদিন সকাল...
মাফি কোচিং আর মিশু কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো। রাস্তার পাশে তারা খোজ করছিল বৃদ্ধকে। কিন্তু কাউকে দেখলো না তারা। কে জানে, আবার কোথায় গেছে অবুঝ সন্তানকে খুজতে। ছেলেটা আসলেই অবুঝ। সেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য বাবার হৃদয়ের কান্না সে বুঝবে কিভাবে?
 
Top