ক্লাস শেষ করে মোবাইলটা হাতে নেয় ইশতিয়াক। ওরে বাবা!! 13 missed calls and 6 messages!! ইশতিয়াক জানে এসব কে পাঠিয়েছে। ৪ বছরের সম্পর্কে এটা এই প্রথম না। অর্থী, হা,এই মেয়েটাকে প্রবল ভালবাসে সে।হয়তবা নিজের জীবনের থেকেও বেশি। জীবনের প্রতিটা পদে অর্থী যেন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থী ছাড়া ইশতিয়াক যেন আলো ছাড়া চাঁদ। অর্থীর ছাড়া ইশতিয়াকের অস্তিত্ব যেন অকল্পনীয়। ইশতিয়াকের মতে অর্থীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টা। অর্থীর জীবনে ইশতিয়াক যেন চাঁদের কলঙ্কের মত। কি নেই মেয়েটার?? তবুও সে কেন যে ইশতিয়াকের মত অপদার্থকে ভালবাসে খোদাই জানে!! যদিও এসব কিছুই ইশতিয়াকের নিজস্ব ধারনা!! এসব ভাবতে ভাবতে অর্থীকে ফোন দেয় ইশতিয়াক -'হ্যালো'
'এতক্ষণে স্যার এর সময় হল ফোন ধরার?' আপনে কি জানেন কয়বার আপনে ফোন ও মেসেজ করেছি??'রেগে থাকলে অর্থী সবসময় ইশতিয়াককে "আপনি" বলে সম্বোধন করে।
তবুও ইশতিয়াক স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন করে-'ফোন দিয়েছিলে?? অহ!! ক্লাসে ছিলাম তাই ধরতে পারিনি ।মোবাইল সাইলেন্ট ছিল ।কেন ফোন দিয়েছিলে??'
'ইশ!!ভাবখানা দেখো না স্যার এর। মনে হয় জগতে শুধু সে একাই ক্লাস করেন।থাক! আমার সাথে আর কথা বলতে হবে না। আপনে ক্লাসই করতে থাকেন।' বলেই খুট করে ফোনটা রেখে দেয় অর্থী। ইশতিয়াক আর রাগ ভাঙাতে ফোন দেয় না। কারন জানে সে এই রাগ ক্ষণস্থায়ী। কিছুক্ষণ পর অর্থী আবার ফোন দিবে। সে জানে এবং আবার সে ঝগড়া করবে।পরের বার রাগ করার বিষয় হবে অর্থী রাগ করে ফোন রেখে দেয়ার পরও ইশতিয়াক ফোন দিলো না কেন?আসলে সে তাকে ভালইবাসে না! তাইতো তার রাগের কোন মূল্যই নেই ইশতিয়াকের কাছে।এসব ভাবতে ভাবতেই ইশতিয়াক হেসে ফেলে। কখন যে আপন ভাবনায় সে গেটের সামনে এসে পড়েছে সে জানে না। গেটের সামনে একটা জটলা দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। হা,যা ভাবছিল তাই। ইমরান আজকেও ভেজাল করছে। আজকের মারামারিতে তার প্রতিপক্ষ এক ফুচকাবিক্রেতা।সে ও তার দলের সবাই প্রথমে লোকটার কাছ থেকে ফুচকা খায়।পরে দাম চাইলে তার ভাগ্যে জুটে এই। ইমরানকে ইশতিয়াক চিনে প্রায় ৩ বছর থেকে।এই ভার্সিটিতেই সে, ইমরান ও অর্থী একই সাথে পরত।গত বছর সে এক মহিলা শিক্ষকের সাথে অনৈতিক ব্যাবহারের ফলে ছাড়পত্র পায়। কিন্তু ভার্সিটি এর হোস্টেলে এখনও সে বহাল তরিয়াতে বাস করছে। ইমরানেরও একটি দুর্বলতা আছে এবং সে আর কেউ না "অরথী"।৩ মাস আগে অর্থী ও ইশতিয়াক এর আংটি বদল হয় পরিবারের সম্মতিক্রমে।এরপর অর্থী নিজের ইচ্ছা থেকেই ভার্সিটিতে আসা বন্ধ করে দেয়। ইশতিয়াক অনেক বলার পরও অর্থী ভার্সিটিতে আসে না। অর্থীকে দেখতে না পাওয়ার জন্যই হোক অথবা আংটি বদলের কারনেই হোক এরপর থেকেই ইমরান অর্থী ও ইশতিয়াকের ক্ষতি করতে যেন উঠে পড়ে লাগে।

ইশতিয়াক নিজের খাটে শুয়ে, হাতে নিজের ল্যাপটপ। এফবিতে লগিন করতেই দেখে অর্থী অনলাইনে। সে নিজে থেকে নক করে না।কিছুখন পর অর্থী নিজের থেকে নক করে
'ওঁই'
'কি বল??'
কই তুমি??'
"এইতো বাসায়" ইশতিয়াকের জবাব।
'আজ আমি আর সায়মা 6 to 9 শোতে মুভি দেখব,তুমি যাবা??'
ইশতিয়াক কিছুখন ভেবে বলে 'না,তোমরা যাও,have fun,,,আমার শরীর টা ভাল লাগছে না।'
'তোমার শরীর ভালো থাকে কবে শুনি??হা,আমরা তো মজা করবই,তোমার আর তা বলতে হবে না! বাই,আমি তোমার সাথে আর কথা বলব না' বলেই অর্থী অফলাইনে চলে যায়।ইসতিয়াক শুধু মুচকি হাসে।

রাত নয়টা ত্রিশ। অর্থী ও সায়মা রিক্সাতে 'দোস্ত, মুভিটা কিন্তু অনেক জোশ ছিল।'
'তোর ভালো লাগসে?আমার তো পুরাই বাজে লাগসে।'
'হা, তোমার ভালো লাগবে কেমনে? ইশতিয়াক ছিল না যে!'
'বাজে বকিস না, ওই দেখ তোর বাসা এসে পরেছি,নাম।'
'ওকে দোস্ত, বাসায় যেয়ে ফোন দিস'।

রাত ১১টা ৫,সায়মা হাতপা ভয়ে রীতিমতো কাপতে শুরু করেছে। অর্থীতো কখনও এমন করে ,নিশ্চয় তার কোন বিপদ হয়েছে। তার এখন কি করা উচিত, ইশতিয়াককে ফোন দিবে নাকি অর্থীর বাসায়।অরথীর পারসনাল নাম্বার সুইটচ অফ। অর্থীর বাসা থেকে ফোন তার সকল দ্বিধা কাটিয়ে দিলো। মুঠোফোনের অপর প্রান্তে অর্থীর বাবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম এইযে অর্থী এখনও বাসায় আসেনি।এর আগে অর্থী কখনও এমন করেনি। অর্থীর বাসা থেকে ইশতিয়াককে ফোন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া অর্থীর বাবা যাচ্ছেন পুলিশকে খবর দিতে। সায়মা যদি কোন খবর পায় তবে তাদের যেন জানায়।

সায়মাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে আগে যেতে থাকে অর্থী।পাগলিটা এতো বুঝে কিভাবে তাঁকে? দূর থেকে একটা গাড়ির আলো চোখে এসে পরায় তার ভাবনায় ছেদ পরল। গাড়িটা ঠিক তার রিক্সার সামনে এসে থামল।রিক্সাওয়ালাকে হার্ড ব্রেক করে সংঘর্ষ থামাতে হল। গাড়ি থেকে ইমরান নেমে আস্ল,তাকে দেখেই অর্থীর মন যেন ভয়ে কেমন করে উঠল। অন্ধকারে ইমরানের চোখ দুটো যেন হিংস্র চতুষ্পদী জন্তুর মত জ্বলছিল। ইমরানের সাথিরা রিক্সাওয়ালাকে ভাগিয়ে দিলো। ইমরান অর্থীকে অদূরে একটি অর্ধনির্মিত ভবনে টেনে হিছড়ে নিয়ে গেল। সে যেন অর্থীর সমস্ত সম্পদ ধংস করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্থী তার সর্বস্ব দ্বারা প্রতিহত করার চেষ্টা করলো। যেই রিক্সাওয়ালে ইমরানের সাথিরা ভাগিয়ে দিয়েছিল সে লোকজন জড় করে নিয়া আসছে।তা দেখে ইমরানের বন্ধুরা পালিয়ে যায়। ইমরানও পালিয়ে যেতে নেয়,কিন্তু যাওয়ার আগে অর্থীর জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করে জায়।কি একটা যেন সে অর্থীর চেহারার দিকে ছুড়ে মারে। অর্থী জানেনা তা কি ছিল।কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা যেন কারো জীবনে আর না আসে।সেই তরল পদার্থ যেইদিক দিয়ে যাচ্ছিলো তার চামড়া মাংস যেন জলসে যাচ্ছিলো ।এরপর চারিদিক অন্ধকার হয়ে পড়ে।এরপরের আরকিছুই মনে নেই।

অর্থীর খবর পেয়েই ইশতিয়াক হসপিটালে ছুটে গেল। হসপিটালের ওয়েটিং রুমে অর্থীর বাবামার বিধ্বস্ত চেহারা যেন অর্থীর উপর বয়ে যাওয়া ঝরের পরের চিত্র। ডাক্তার এর কাছ থেকে জানতে পারল অর্থীর প্রায় ৮৫ শতাংশ এসিডের তেজে ঝলসে গেছে। ডাক্তারকে ইশতিয়াক জিজ্ঞেস করে 'আমি কি অর্থীকে একবার দেখতে পারব ?'
'আপনি তার কি হন?'
"আমি ওর বাগদত্তা"
ডাক্তার এই প্রথম চোখ তুলে ইশতিয়াকের দিকে তাকালেন ।তার চোখে বিস্ময়ের উপস্থিতি স্পষ্ট। 'হা, যান।কিন্তু খেয়াল রাখবেন রোগীর যেন কোন অসুবিধা না হয়'।

রুমের গেট খুলে ইশতিয়াক অর্থীর সামনে গেলাম।কিন্তু একি!!আমার অর্থীকে চেনার যে কোন উপায়ই নেই।তার সারা মুখে ব্যান্ডেজ। গেট খোলার শব্দে অর্থী চোখ খুলে তাকাল। কিন্তু সে ইশতিয়াককে দেখেই হাত দুটো দিয়ে চেহারা দেখে ফেলল। সে চায় না ইশতিয়াক তার এই কুৎসিত রুপ দেখুক। ইশতিয়াক তার সামনে চেয়ারটায় বসে এবং হাত দুটো মুখ থেকে সরায় এবং বলে "ভালোবাসা মানে শুধু সুন্দর মুহূর্তে শুধু পরস্পরএর হাত ধরা না,খারাপ সময় একজন আরেকজনের সঙ্গি হিসেবে তা জয় করা। আমার ভালোবাসা এতটা দুর্বল না যে তোমার চেহারা দেখে তা ঘৃণায় পরিনত হবে।আমি আজও তোমাকে আগের মতই ভালবাসি,আজ থেকে শুরু হল আমাদের নতুন জীবন।"

ইমরান এখন কারাগারে।তার ৩ বছরের শাস্তি হয়েছে।তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল যে সে এক জনৈক অর্থীর মুখে এসিড নিক্ষেপ করেছে। ইমরান হাসে এবং ভাবে " একটা জীবন ধ্বংসের বিপরীতে মাত্র ৩বছরের কারাগার।খারাপ কি?৩বছর পর তো বের হয়েই যাব, কিন্তু অর্থী যে এসিডের দাগটা সারাজীবন বহন করবে অভিশাপ হিসেবে ,এটাই আমার সার্থকতা।"

এখন পাঠকদের কাছে আমার প্রশ্ন এসিড নিক্ষেপকারীদের সর্বনিম্ন শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও কি কম হত না??তবে কারাগার কি আর এমন শাস্তি?

উৎসর্গ- এসিডের তেজস্ক্রিওতায় জলসানো সকল প্রান। জীবনকে ২য় বার সুযোগ দেন। ভুলবেন না আমরাই হচ্ছি সমাজ কিন্তু আপনেরা হচ্ছেন এই সমাজের গর্ব।

লিখেছেনঃ Safat Shoeb
 
Top