নদীর তীর ঘেঁষে সিড়ি দেওয়া একটা ছেলে বসে আছে সকাল বেলাতে।সকাল বেলার এই সময়টাতে কেউ আসে না এই জায়গায়।ছেলেটির মন খারাপ বলে সে সকালে এসে একা একা বসে আছে এখানটাতে।ছেলেটির নাম প্রাচুর্য।প্রাচুর্য আকাশ দেখছে।আকাশে আজকে মেঘ করছে মনে হচ্ছে তার মন খারাপের কারনে আকাশও কাঁদবে আজ।মন খারাপের কারন আজ একজনের বিয়ে।তার খুব কাছের একজনের বিয়ে।বিয়েটা সে মানতে পারছে না।তার কাছে থেকে এত দূরে চলে যাবে কাছের মানুষটা এটা মনে করলেই খালি তার কান্না পাচ্ছে।আচ্ছা বিয়ে করলে মেয়ে মানুষকে শ্বশুর বাড়ি কেন যেতে হয় এই প্রশ্নটা খালি তার মনের কোনে আসছে।জানে সে এটা ছেলেমানুষী প্রশ্ন তবুও সবাইকে প্রশ্নটা করতে খুব ইচ্ছে করছে আর চোখ ভিজে যাচ্ছে।

এদিকে যাকে নিয়ে মন খারাপ সেই মেয়েটির নাম ঐশ্বর্য।আজ তার বিয়ে।বিয়ের দিন কেন জানি সকল মেয়েকে অনেকক্ষন ধরে ঘুমাতে দেওয়া হয়।হয়তোবা বাবার বাসায় শেষ ঘুম বলে।কিন্তু ঐশ্বর্য আজ খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে।তারও মনটা খুব খারাপ হবে স্বাভাবিকভাবে।কিন্তু তার মনটা আজ একটু বেশিই খারাপ।বেশি খারাপের কারন আর কিছু নয় প্রাচুর্য।সকাল থেকে তার কোন খোঁজ নেই।এতবার ফোন দিচ্ছে কিন্তু বেয়াদপ মহিলাটা ঘ্যান ঘ্যান করে বলেই যাচ্ছে,আপনার কাংখিত নম্বরটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।তার রাগ আর কষ্ট দুইটাই একিসাথে লাগছে।আজকের দিনেও ফাজিলটার সাথে ঝগড়া হবে এটা ভেবে রাগ উঠছে খুব।
প্রাচুর্য ইচ্ছে করেই ফোনটা অফ করে আছে।জানে এতক্ষনে ফোন দিয়ে না পেয়ে একশো একটা গালি দিচ্ছে ঐশ্বর্য।আজকেও হয়তোবা ঝগড়া হবে তাদের মাঝে।এটাই শেষ ঝগড়া বোধহয় এটা ভেবে আবার চোখের কোনে জল চলে আসছে তার।পুরোন দিনের কথাগুলো হঠ্যাৎ করে মনে পড়ছে খুব।

বাবা মা দুজনেই চাকুরী করার কারনে প্রাচুর্য মার থেকে বেশি আদর পেয়েছে ঐশ্বর্য নামের এই চার বছরের বড় বোনটার কাছে থেকে।খাওয়ানো থেকে আরম্ভ করে গোসল করানো পর্যন্ত এই বোনটি করেছে।একটু বড় হলে যে ঝগড়া নামক বিষয়টির উৎপত্তি হয়েছে তা এত বড় হওয়া স্বত্তেও থামেনি।তাদের দুজনের ঝগড়া বিষয়বস্তুগুলো ছিল একটু অন্যরকম।কিন্তু সেই অন্যরকম বিষয়গুলো থেকে কত বড় যে ঝগড়ার সৃষ্টি হত তা দেখে মা দুজনকেই বকা দিতেন।সেই বকা খেয়ে আধাঘন্টার মত রাগ করে আবার মজার গল্পে মেতে উঠত দুজনে।একবার দুজনের চরম ঝগড়া লেগেছে। বিষয়বস্তু হল নাম নিয়ে।ঐশ্বর্যের ভাষ্যমতে প্রাচুর্য নাম সুন্দর না ঐশ্বর্য নাম সুন্দর।প্রাচুর্য তখন চোখ ছল ছল করে বলে,

-হু তোমাকে বলছে।ঐশ্বর্য তো কাজের বুয়ার বাচ্চার নাম রাখে।আমি ঐ দিন শুনছি আমাদের কাজের বুয়াকে ডাকতে।প্রাচুর্য নাম সুন্দর ছেলেদের রাখে ।দেখিস না আমি কত সুন্দর।
ঐশ্বর্য এই কথা শুনে আর যায় কোথায়।সে আরো চেঁচিয়ে বলে,
-এহহ কি আমার সুন্দরটা।প্রাচুর্য নাম সুন্দর না বলেই তো তুই কালো আর আমি যদি কাজের বুয়ার মেয়ে হতাম তাহলে কি এত ফর্সা হতাম।তুই কাজের বুয়ার ছেলে বলে তো এত কালো।আম্মু তোকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসছে কুড়ায়া।

প্রাচুর্য নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই কালো ভেবে বসল।তারপর হঠ্যাৎ ভ্যা করে কেঁদে মার কাছে গিয়ে বলল,
-মা আমি নাকি কাজের বুয়ার ছেলে।এই কথা বলে আবার কান্না শুরু।মা দিত দুজনকেই রামবোকা।ঐশ্বর্য ওদিকে যত হাসে প্রাচুর্যের কান্না তত বাড়ে।

এই পুরোন দিনের কথা মনে করতে করতে প্রাচুর্য ভুলে গিয়েছিল তার বোনের আজ চলে যাবার দুঃখটা।আপনমনে হাসতে লাগল সেদিনের কথা ভেবে।যখন বাস্তবতায় ফিরে আসল হাসতে হাসতে আবার দুচোখের কোনে জল আসতে লাগল তার।

এদিকে ঐশ্বর্য ফোন দিয়ে যাচ্ছে বারবার।ফাজিলটার কোন আক্কেলজ্ঞান নেই।আজকের এই দিনে এভাবে নিরুদ্দেশ হওয়ার কোন কারন আছে।গাধাটা আজ কই আনন্দ করবে নাহ সে হারিয়ে আছে সকাল থেকে।আজকে তো ওর আনন্দের দিন।এই দিনটা নিয়ে একদিন কত ঝগড়া করল।চোখ ঝাপসা হতে হতে মনে পড়ে গেল সেই ঝগড়ার কথা।

-ওই তুই আমার আম্মুকে ধরবি না।তুই অই দিকে যা,মাকে জড়িয়ে বলল ঐশ্বর্য।
-এহহ আমার আম্মুকে আমি ধরব না তো কি তুই ধরবি।যাহ তুই অন্য খানে যা,ঐশ্বর্যের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল প্রাচুর্য।
-থাক প্রাচুর্য তোর বোনকে ধরতে দে।তোর বোনের তো বিয়ে হয়ে যাবে তখন কে আমাকে ধরবে?মা হেসে বলতে থাকে প্রাচুর্যকে
-হি হি।মা এখনি এটার বিয়ে দিয়ে দাও তাহলে তুমি শুধু আমার থাকবে।প্রাচুর্য হাসতে হাসতে বলে উঠল।
-আমি আমার মাকে ছেড়ে কোন দিন শ্বশুর বাড়ি যাব না,আরো জোরে মাকে জড়িয়ে বলল ঐশ্বর্য ।
-তুই না গেলে তোকে জোড় করে ধাক্কা দিয়ে পাঠাবো,আবার হাতটা সরিয়ে বলে প্রাচুর্য।
-আমি গেলে খুব খুশি হোস তুই তাই না?
-হু অনেক খুশি হই।
আস্তে করে হাতটা সরিয়ে ঐশ্বর্য ঊঠে অন্য রুমে চলে গিয়ে নিশব্দে কাঁদতে লাগল।হঠ্যাৎ পিছনে প্রাচুর্য বলে উঠল,
-আপি তুই যাস না।তুই চলে গেলে কার সাথে আমি ঝগড়া করব?কাকে আমি আমার গল্প শোনাবো?কে বা আমাকে মুখে তুলে খাওয়াই দিবে।

সেদিনের সেই কথা আজো কানে বাজে ঐশ্বর্যের।আজ তো যেতেই হবে তবুও পাগলটা মন খারাপ করে সকাল থেকে এভাবে হারিয়ে আছে।ঐশ্বর্য মাকে দেখতে পেয়ে বলল,
-মা প্রাচুর্য কই?সকাল থেকে দেখছি না।
-জানি না কই গেছে।আমার হয়েছে শত চিন্তা।তোর বাবাটাকেও খুঁজে পাচ্ছি না।মেয়ের বিয়ে তার আর সব কাজ আমাকেই করা লাগছে।মা তুই রেডি হয়ে নে।পার্লারে যাবার জন্য গাড়ী আসবে একটু পর।
-আচ্ছা।মন খারাপ করা কন্ঠ্যে বলে উঠে সে।

পার্লার থেকে এসেও প্রাচুর্যকে দেখতে না পেয়ে মনটা কেমন কেমন জানি করে উঠে।ফোন দেয় কিন্তু ফোন বন্ধ পায় সে আবারো।সবাইকে জিজ্ঞেস করে প্রাচুর্য কই?কিন্তু কেউ বলতে পারে না ঠিক মত।সকলেই তার বিয়ের আনন্দে আছে কিন্তু সে একবারো সেই আনন্দে সামিল হতে পারছে না।বার বার তার কাজল দেওয়া চোখ ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে।একসময় কবুল বলাটাও হয়ে যায় তবুও তার সেই লক্ষীছাড়া ভাইটির খবর নেই।যাবার সময় ঘনিয়ে আস্তে আস্তে।চারদিকে বার বার খুঁজে বেড়ায় ঐশ্বর্যের চোখ।যাবার বেলাটা খুব কষ্টের।সকলকে বিদায় দিতে খুবি কষ্ট হচ্ছে ঐশ্বর্যের।বারবার মাকে বলছে,
-মা প্রাচুর্য কই?পাজিটা কি আসবে না আমাকে বিদায় দিতে।
চারদিকে খোঁজ পড়ে প্রাচুর্যের।নাহ কোথাও নেই ফাজিল ছেলেটা।এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে বার বার তাগাদা দিতে থাকে সবাই।গাড়িতে উঠতে যাবে ঐশ্বর্য হঠ্যাৎ পিছন ফিরে কেউ কান্নাভরা কন্ঠ্যে বলে উঠে,

-আপি আমাকে ছেড়ে যাস না।যাস না আমাকে ছেড়ে।
-এই শয়তান,ফাজিল,পাজি কোথাকার সারাদিন কই ছিলি তুই আমাকে ছেড়ে?জানিস আমার কত কষ্ট হচ্ছিল তোকে ছাড়া।কত চিন্তা করছিলাম তোকে নিয়ে।আজকের দিনেও আমাকে এত চিন্তা ফেলে রাখছিস।কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে ঐশ্বর্য।
-আপি যাস না আমাকে ছেড়ে প্লীজ়।আমি আর ঝগড়া করব না প্রমিজ।আর টেনশন করাবো না প্লীজ় যাস না।এই বলে জড়িয়ে ধরে প্রাচুর্য ঐশ্বর্যকে।

প্রাচুর্যের কান্না দেখে সকলের চোখের কোণে কখন যে পানি এসে পড়েছে তা কেউ বলতে পারবে না।সকলেই অবাক হয়ে দেখছে ভাই বোনের এই অদ্ভুত ভালবাসা।

কিছু কথাঃআমার মনে হয় পৃ্থিবীতে শ্রেষ্ট ভালবাসা বুঝি এই ভালবাসা।আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি এই ভালবাসা পেয়েছি।অনেকে বলে আমি নাকি বোনকপালী।আল্লাহ আমাকে এক বড় বোন দেওয়া স্বত্তেও আরো অনেক বোনের ভাই বানিয়েছেন ফেসবুকের কল্যানে।রিয়াপু,নুহাপু,তিশাপু,কুম্পু,বীথিভাবিপু,পাগ্লীপু,জোহরাপু,মউপু,দিশাপু,কল্পপু,তরুপু,মেঘপু আরো যে কত আপু আমি পেয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না।তাদের ভালবাসায় সিক্ত এই ছোট ভাইটি আমি মাঝে মাঝে এক চিন্তায় পড়ে যাই ।চিন্তাটা হল এত আদরের বোনদের আমি কি করে বিদায় দিব?আমার সকল আপুদের জন্য তার এই ভাই এর ছোট্ট উপহার।এই গল্পটি আমার সকল আপুদের জন্য অনেক আবেগ নিয়ে লিখলাম।জানি না সকল আপুরা পছন্দ করবে কিনা।কিন্তু সকল আপুদের প্রতি ভালবাসাটা হয়তোবা আমি লিখে প্রকাশ করতে পারব না কোনদিন।অনেক ভালবাসি তোমাদের আপু।
 
Top