আই সি ইউ রুম এ জীবনের সাথে পাঞ্জা লড়ছে জয়ন্ত, রুম এর বাইরে বসে আছে ঊর্মিলা। ওর ভিতর
ভালবাসার ছবিজুড়ে শুধু উৎকণ্ঠা। জয়ন্তর ব্রেইন টিউমার এর একটা অপারেশন করা হয়েছিল কিন্তু সমস্যাটা অনেক
জটিল হওয়ায় তা সফল হয়নি। অবশ্য ডাক্তার অপারেশন এর আগেই বলেছিলেন যে, যেকোনো কিছু হতে পারে হয় তা ভালো না হয় খারাপ।
অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে ঊর্মিলা জয়ন্তকে বলেছিল, শোন জয়ন্ত তুই আমাকে কথা দে আমার শেষ নিশ্বাস থাকা পর্যন্ত তুই আমার সাথে থাকবি তখন জয়ন্ত কিছু বলেনি শুধু একটি মলিন হাসি দিয়েছিল। হয়তো জয়ন্তর কাছে সেটা অবাস্তব লেগেছিল।
এই দেশে বলতে জয়ন্তর কেউ নেই ওর পুরো পরিবার কানাডায় থাকে তাই খুব কাছের বলতে একমাত্র ঊর্মিলাই আছে। তাই জয়ন্তর দেখাশুনা ঐ করে। অবশ্য হয়তো সেটা বেশি কেয়ার রাখা হত। কিছুক্ষণ পর পর ঊর্মিলা জয়ন্তকে ফোন দিয়ে বলতো এটা করেছিস নাকি ওটা করেছিস ঠিক মত খেয়েছিস, সময়মত ঘুমিয়েছিস নাকি। যদি ঊর্মিলা জয়ন্তকে ফোন দিয়ে শুনত যে দেরি করে ঘুমিয়েছে তখন ও জয়ন্তকে হাজারটা কথা শুনিয়ে দিত মাঝে মাঝে জয়ন্তও ওর উপর রাগ করে বলতো তুই আমার কে যে তোকে আমার সব খবর রাখতে হবে কিন্তু ঊর্মিলা কখনই ওর কোথায় কিছু মনে করতো না।
আই সি ইউ রুম থেকে ডাক্তারকে বের হতে দেখে ঊর্মিলা তার দিকে ছুটে আসে,

- স্যার জয়ন্তর এখন কি অবস্থা?
- উনার হাতে সময় এখন অনেক কম। আমরা এখন তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছি। যদি চান তার সাথে দেখা করতে পারেন কিন্তু তিনি এখন কথা বলার অবস্থা নেই।
রুম এ ঢুকে ঊর্মিলা জয়ন্তর মাথায় হাত রাখে ও জানে এই প্রিয় মুখ কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে অনেক দূরের দেশে চলে যাবে। জয়ন্তর উপর এই প্রথম ওর রাগ হচ্ছে। ঊর্মিলার খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু ও কাঁদবে না তাতে হয়তো জয়ন্ত অনেক কষ্ট পাবে যা ও প্রকাশ করতে পারবে না। ঊর্মিলা দেখল জয়ন্ত ওকে আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। ঊর্মিলা তখন দেখল জয়ন্ত টেবিলের উপর রাখা ডাইরিটাকে ইঙ্গিত করছে। ঊর্মিলা ডাইরিটা হাতে নিলো এই ডাইরিটা জয়ন্তর প্রিয় ডাইরি এই ডাইরির মধ্যে জয়ন্ত কিসব জানি লিখত কিন্তু কখনই তা ঊর্মিলাকে দেখাতো না। ঊর্মিলা ডাইরিটা খুলে তার পাতার পর পাতা উল্টাতে থাকে, পুরো ডাইরি জুড়ে শুধু ওদের দুজনের কিছু স্মরণীয় ঘটনা। পাতা উল্টাতে উল্টাতে হটাৎ ও থমকে যায় একটা পাতার প্রথম লাইন ও পড়তে থাকে-

ঊর্মিলা আমি এতদিন তোকে আমার এই ডাইরিটা ধরতে দেইনি কিন্তু একসময় আসবে যখন আমি নিজেই তোকে ডাইরিটা দিব। আমি জানি যখন তুই এই ডাইরির প্রত্যেকটা পাতা যখন পড়বি তখন তুই এই পাতাটাও পড়বি। তুই যে মুহূর্তে লেখাগুলো পড়বি তখন হয়তো আমি আর এই পৃথিবীতে থাকবো না। আমি নিজের মনকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি তোকে ছেড়ে থাকার কিন্তু তা হয়তো অসম্ভব। আমার খুব কষ্ট হবে তোকে ছেড়ে থাকবার কিন্ত আমাকে আমার মৃত্যুর কাছে হার মানতে হবে। আমি আমার জীবনের সব কথা তোর সাথে ভাগ করে দিয়েছি এমনকি আমার এই কঠিন বাস্তবও তোর কাছ থেকে দূরে রাখিনি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে অন্য কেউ থাকলে মনে হয় আমাকে ছেড়ে অনেক আগেই চলে যেত কিন্তু তুই আমাকে ছেড়ে যাসনি আমার এই খারাপ মুহূর্ততে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ এ আমার সঙ্গে থেকেছিস। শুধুমাত্র তোর অনুপ্রেরনায় আমি এতদিন লড়াই করে বেঁচে ছিলাম। হয়তো আমি আর তোকে আর আমার মনের ভিতর জমে থাকা কথাগুলো বলতে পারব না, আমার সুখ দুখুগুলো শেয়ার করতে পারব না, তোর উপর আমার মিষ্টি রাগগুলো ঝাড়তে পারব না। আসলে তোকে হয়তো আমি এতই ভালবাসি যে তোকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হবে। আমি এতদিন এই ডাইরিটাতে আমার মনের সব কথা লিখেছি, এখন থেকে এটা তোর কাছে থাকবে। ধরে নে এটাই হয়তো তোকে দেওয়া আমার শেষ উপহার। লেখাগুলো পড়ে ঊর্মিলার ভেতর পুরো চুরমার হয়ে গেলো কিন্তু ও আর ওর আবেগটাকে চেপে রাখতে পারল না।

ভোর ৫:১৭ চারিদিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, কফিন এ শুয়ে আছে জয়ন্তর প্রাণহীন দেহটা। ঊর্মিলা জানে জয়ন্ত ওকে ছেড়ে চলে যায়নি। জয়ন্ত সবসময় ঊর্মিলার সৃতির মধ্যে বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকবে ওদের টুকরো টুকরো ভালোবাসা।
 
Top