ভালবাসার ডাকগুলশান লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটেই মনজুর অফিসে যায়, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সে আছে তিন
বছর ধরে। তিন বছর আগে... যখন সুফিয়া খুব করে বলল, এবার তাদের বিয়ে করে ফেলতেই হবে; কারন তাকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। সুফিয়ার কথা মনে পরলেই মনজুর সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে যদিও সে সিগারেটে অভ্যস্ত হতে পারেনি। সিগারেট ধরিয়েই সে খুক খুক করে কাশতে লাগলো । সাড়ে নটা থেকে অফিস, এখন বাজে নটা পাঁচ। হাতে সময় আছে- কিছুক্ষণ এই ময়লা লেকের সামনে একা দাড়িয়ে থাকা যায় , সুফিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। সুফিয়া ভালো আছে তো? থাকার ই কথা! এতো দিনে হয়ত ওর কোন বাচ্চাও আছে, যে অস্পষ্ট ভাবে ছোট ছোট কথা বলে , সারা ঘরে দৌড়ায়, খিল খিল করে হাসে! মনজুর ভাবল এরকম একটা বাচ্চা তো, তাদের ও হতে পারতো। সে ছোট করে নিঃশ্বাস ফেললো; যা নেই তা নিয়ে ভাবার কোনও মানে হয় না। হাতের সিগারেট অনেক আগেই নিভে গেছে সে লেকের পানিতে সিগারেট ছুড়ে ফেলে আবার হাঁটা শুরু করলো। মনজুরের সাহস কম, তার উপর তখন চাকরি নেই, তবু সে সাহস করে বাসায় বলেই ফেললো- সে বিয়ে করবে। যা ভেবেছিল তাই হল বড় ভাই রাগারাগি শুরু করলেন, মনজুরও তর্ক চালালো; এক পর্যায়ে বড় ভাই বলল বাসা থেকে বের হয়ে যা। বড় ভাইয়ের টাকায় সংসার চলে তো সে ই এখানে কর্তা। বাবা কিছু বললেন না। মনজুর বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো। কেউ আটকালো না। মিতু বারান্দায় দাড়িয়ে রইলো, মা দরজা পর্যন্ত এসে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না, শুধু চোখ মুছলেন। কিছু দিন মনজুর বন্ধুদের বাসায় রইলো। সেখান থেকে নানান জায়গায় ইন্টারভিউ দিল । কিছুই হল না, অবশেষে সুফিয়ার বিয়ের আগের দিন সে কল করে বলল- সুফিয়া তুমি চলে আসো, চিন্তা নেই চাকরি একটা হবেই,সব হবে শুধু তুমি পাশে থাকো। সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল- আচ্ছা তুমি মোড়ে এসে দাড়াও আমি আসছি, যেভাবেই হোক আমি আসছি! কত দিন গেলো , সুফিয়া আর এলো না ! ওর কোনও দোষ নেই, চাকরি নেই, ঠিকানা নেই এমন এক ছেলের কাছে সে কোন হিসেবে চলে আসবে? পৃথিবী আবেগে চলে না। সুফিয়ার বিয়ের ঠিক এক মাস পরেই তার চাকরি হল, পোড়া কপাল বলেই হয়ত এমন হল। মাঝে মাঝে মনজুরের নিজেকে খুব একা লাগে, মনে হয় পুরো পৃথিবীতে তার নিজের বলে কেউ নেই!সে অফিসের কাছে চলে এসেছে, লিফটের কাছে জটলা লেগে আছে। গতকাল থেকে আরেকটা লিফট নষ্ট , তাই এই অবস্থা। সে লিফটের জন্য অপেক্ষা করবে নাকি সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাবে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলো। 

কার্নিশে বসে কর্কশ কণ্ঠে কাক ডাকছে, কাকের ডাকেই নীলার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার পরই নীলার মনে হল , সে এখনো কেন বেঁচে আছে?প্রতিটা সকাল তার কাছে দুর্বিষহ! ঘরে লাইট জ্বলছে, জানালা খোলা । পর্দাও সরানো । সাধারণত সে জানালায় ভালো মত পর্দা দিয়ে ঘুমায় । এক ফোটা আলো থাকলে সে ঘুমাতে পারে না আর সকালে চোখে রোদ পরলে সারা দিনই মাথা ব্যথা করে। কাল রাতে সে কখন ঘুমিয়েছে মনে করতে পারছে না। মাথার কাছে বই পরে আছে, মেঝেতে বালিশ । সে বিছানা থেকে উঠে সাইড টেবিল থেকে মোবাইল নিলো, এগারোটা বাজে। মোবাইলে তিনটা মিসড কল আর একটা মেসেজ উঠে আছে। মিতু কল করেছিল। মেসেজও নিশ্চয়ই ও দিয়েছে। মেসেজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। এই মেয়ে পড়ালেখা ছাড়া কিছু বুঝে না। আজ কেন নীলা কলেজে গেলো না, নিশ্চয়ই এই নিয়ে বিশাল এক ভাষণ লিখেছে মেসেজে! অনেক বেলা হয়ে গেছে বাসায় কারো থাকার কথা না। নীলার বাবা অফিসে চলে গেছেন আর বুয়া হয়তবা রান্না বসিয়েছে। নিচে গিয়ে কফি নিয়ে আসতে হবে আগে হাত মুখ ধুয়ে নেয়া যাক। 

বাথরুমের আয়নায় বড় বড় চোখের এক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, মোমের মত গায়ের রঙ। বোঁচা নাক। পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো ঝরঝরে চুল। মা ছোট বেলায় নীলাকে বুচি ডাকতো কি যে ভালো লাগতো! তিনি বেঁচে থাকলে খুব ভালো হত। মন ভরে গল্প করা যেত;কোনও দিন চুপি চুপি বলে দেয়া যেত ওই ব্যাপারটা-যা নীলার মনে বোঝার মত হয়ে আছে! যে কারনে নীলা শান্তি মত ঘুমাতে পারে না। হাসতেও পারে না। কিছু ভালো লাগে না কিচ্ছু না! আবার ভাবতে গেলে ব্যাপারটা কিছুই না ! মাঝে মাঝে সব ঠিক হয়ে যায় আবার মাঝে মাঝে সব এলোমেলো লাগে। কেন হয় এমন? হাত মুখ ধুয়ে কফি হাতে নীলা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে এখন কিছুটা ভালো লাগছে, সে রাস্তায় মানুষজনকে দেখছে। কি ব্যস্ততা একেকজনের ভিতর। যেন কোনও প্রতিযোগিতায় নেমেছে কার আগে কে পৌঁছাবে! রিক্সা করে একটা ছেলে আর মেয়ে হাসতে হাসতে যাচ্ছে, মেয়েটার পরনে নীল শাড়ি আর ছেলেটার নীল পাঞ্জাবী , কি যে ভালো লাগছে ওদের দেখে। নীলা ঘরে এসে মায়ের আলমারি খুলে সেখান থেকে লাল পারের সাথে হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি বের করলো। সে কখনও শাড়ি পড়েনি, তবে পড়তে জানে, মা কে দেখেছে। জিন্স আর টি শার্ট নীলার প্রিয় পোশাক। তবু আজ সে শাড়ি পড়লো, চোখে মোটা করে কাজল দিল। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। তার কাছে চুড়ি নেই, সবুজ কাঁচের চুড়ি থাকলে ভালো হত। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নীলার কান্না পেয়ে গেলো। রিক্সায় করে যারা যাচ্ছিলো ওরা কত সুখী কিন্তু নীলার জীবনে কখনও এমন সুন্দর সময় আসবেনা। সে আর মনজুর কখনও একসাথে ঘুরতে পারবেনা, সে কখনও মনজুরের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে পারবেনা, অল্প আলোর রেস্টুরেন্টে অনেক সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা মুখোমুখি বসে থাকতে পারবেনা, মনজুর কখনও নীলার জন্য নীল রঙের কাঁচের চুড়ি নিয়ে আসবেনা, তারা কখনও একসাথে রাতের তারা দেখতে পারবেনা। 

মনজুরের কাছে নীলা বাচ্চা একটা মেয়ে, একবার মিতুর সাথে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল , নীলা একা আসবে তাই মিতু বলল মনজুর ভাই তোকে রিক্সা করে দিয়ে আসুক। শুনেই নীলার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সারা রাস্তা মনজুর নীলাকে নানা উপদেশ দিল। 

‘মিতু বলে তুমি নাকি ঠিক মত ক্লাস করো না, কোচিং করো না, এমন করলে তো হবে না ,সময় হাতে নেই বুঝলে, সামনেই এইচ এস সি , এখন মনে হচ্ছে অনেক সময় আছে এক সময় দেখবে সময় নেই রাত পেরুলেই পরীক্ষা......... 
নীলা মনে মনে বলল- আপনি চুপ করুন তো। প্লিজ চুপ করুন। আমি কি বলি,শুনুন। আমি আপনাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি অনেক... ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি... আপনি শুনতে পান না??? 
মনজুর বলল- কি ব্যাপার কথা বলছ না কেন? তোমাদের বাসা কোন গলিতে ডানে নাকি বায়ে? 
নীলা চমকে উঠে বলল- হু... জানিনা, ভুলে গেছি! 
এই কথায় মনজুর হেসে ফেললো, কি সুন্দর সে হাসি। সারা জীবন এই হাসি শুনে কাটিয়ে দেয়া যায়! নীলা আয়নার সামনে দাড়িয়ে দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। সে একটু পর পর কেপে কেপে উঠছে। কাজলে তার সারা মুখ মাখামাখি।
 
Top