‘কুদ্দুস পার্টি’তে যোগ দিয়ে ভালই ঝামেলায় পড়েছি। সদ্য ভার্সিটিতে উঠেছি তো। রক্ত একটু বেশীই গরম। ভেবেছিলাম পার্টির লেবাস লাগিয়ে যদি কোন মেয়েকে পটানো যায়। কিন্তু আমার চাওয়া দিয়ে যে পৃথিবী চলে না—বুঝতে বেশী দিন গেল না।
যথাসম্ভব ভাব আর চেহারায় অতি কষ্টে একটা ভালো মানুষী গম্বিরতা এনে অরিত্রিকে বলেছিলাম,’ দেখো, আমি প্রেম-ভালবাসাতে বিশ্বাসী নই; ডাইরেক্ট অ্যাকশনে বিশ্বাসী। তোমারে আমার ভালো লাগসে। জারুল তলায় চল। ডেটিং মেরে আসি।’
অরিত্রি কয়েক সেকেন্ড নিরবে দাঁড়িয়েছিলো। কাজ মনে হয় হয়ে গেছে। হবেনা আবার! এমন টাইট দিয়েছি যে যমদূতও বাবা ডেকে দৌড় দিবে। ‘আগে প্যান্টের চেইন লাগা। ভালো লেগেছে ভালো কথা। তোর সাহস দেখে আমি মুগ্ধ। সন্ধ্যেবেলা পিনিক তলায় আসিস। দুজন মিলে চুটিয়ে প্রেম করব। ঠিক আছে?’
ভয় পেয়ে গেলাম। বুঝতে দেয়া যাবে না। পার্টির একটা ইজ্জত বলে তো কথা আছে! আমি তো দেখছি জ্বলন্ত পিটকয়লাতে হাত দিয়ে দিয়েছি। হাঁটুগেড়ে দু’বাহু প্রসারিত করে অরিত্রিকে বললাম, ‘তোমার জন্য সারা পৃথিবী তন্য তন্য করে এনেছি একটি সাদা গোলাপ।’
‘একটা গোলাপ আনতে পৃথিবী তন্য তন্য করে ফেললি? তোর ক্ষমতা দেখে তো এক্ষনি পিনিক তলায় যেতে ইচ্ছা করছে।’
অরিত্রি খুব আস্তে কথা বলে। কিন্তু প্রত্যেকটা কথাই চিরতার রসের মত। ‘শার্টের বোতাম খুলে হাঁটছিস কেন? ঠাণ্ডা লাগিয়ে তো নিউমোনিয়া বাঁধাবি।’ অরিত্রি যেভাবে আমার ধরিত্রি কাঁপাচ্ছে___ সামনে দাঁড়ানোর আর সাহস পেলাম না। আশেপাশে একটা ছোটোখাটো জটলার মত হয়ে গিয়েছে। পাবলিকের কিউরিয়াস মাইন্ড জানতে চায় এখানে কি হয়েছে। সন্ধ্যেবেলা পার্টি অফিস থেকে পার্টির নিবেদিত প্রাণ ইসলাম ভাইয়ের ফোন।
‘ অংকন, তাড়াতাড়ি অফিসে আয়।’
মনে হয় নতুন কোন দান মারতে হবে। ধাই ধাই করে নাচতে নাচতে অফিসে ছুটলাম। হাতে অনেকদিন ধরে টাকা-পয়সা নাই। উপরওয়ালা চোখ তুলে মনে হয় তাকালেন এইবার!
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আনন্দ আরও দ্বিগুণ পরিমানে বেড়ে গেল। পার্টির বাঘা বাঘা শুঁটকি নেতারা ভাব নিয়ে বসা। আমিও ভাব ধরলাম। চেয়ারে বসার আগেই ইসলাম ভাই হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘তুই অরিত্রিকে কি বলেছিসরে?’
চোখে মরিচ ফুল দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে। এই খবরটা এখানে আসলো কিভাবে এটাই বুঝতে পারছি না। সব শয়তানগুলোর মুখ বন্ধ রাখার জন্য তো দুপুরে খাবারের বন্যা ছুটিয়ে দিয়েছিলাম।
‘কি হল, বাসর ঘরের বউ সেজে বসে আছিস কেন? জবাব দে। অরিত্রিকে কি বলেছিস?’
ভণিতা না করে বলেই ফেললাম,‘ভাই এই মাইয়ারে দেখলেই মাথা ঘুরায়। ট্যাবলেট আনতে গেসিলাম।’
ঠাস করে একটা শব্দ হল। গালটা খুব জ্বলছে।
‘হারামজাদা, নাক টিপলে এখনো দুধ বেরোবে। সে গিয়েছে অরিত্রিকে প্রস্তাব দিতে। আমি গত ৩ বছর ধইরা কুত্তার মত ঘুরতেসি। আমারেই পাত্তা দেয় না। সে “ভার্সিটি নারী বাঁচাও আন্দোলন”র প্রেসিডেন্ট এইটা জানস? পার্টির তো শ্রাদ্ধ খেয়ে এলি।’ আবার ঠাস করে শব্দ। তারপর থেকে আমি অরিত্রিকে আপু বলে ডাকি। দেখলে ১হাত লম্বা সালাম দেই।
ঘুম ভাঙল ইসলাম ভাইয়ের ফোন পেয়ে। ‘অফিসে আয় কুইক।’
এই জ্বালা আর প্রানে সহে না। ভোঁদৌড় দিলাম অফিসের দিকে। নেতার ফোন বলে কথা।
‘ভাই, বলেন; সাতসকালে জরুরী তলব।’
‘ব্লুটুথ অন কর। একটা জিনিস দিব। এইটা এখন থেকে মোবাইলের রিংটোন করবি। ঠিক আছে?’
শান্ত,শিষ্ট,মিষ্ট, সুবোধ ছেলে হয়ে বললাম,
‘অবশ্যই ভাই।’ মোবাইলে রিংটোন এসেছে। ওপেন করতেই একটা গরিলা চিৎকার করে উঠল,
‘ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার......’
‘কি, সুন্দর না রিংটোনটা?’ অনেক কষ্টে বললাম, ‘হ ভাই, বড়ই সৌন্দর্য।’ ‘হাহা বুঝতে হবেনা কার কণ্ঠ। পার্টির কেন্দ্রিয় নেতা আক্কাস ভাইয়ের। রিংটোন সেট কর। তারপর দূর হবি। আমি এখন একটু মাল খাব। ছোট ভাইয়ের সামনে আর যা করি এইটা তো করতে পারিনা।’ সকালটা মালের গন্ধ দিয়ে শুরু হল। খুব খারাপ। সারাদিন আজ বোধহয় খারাপ-ই যাবে।
‘ ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার’___ ভাষণ শুরু হয়েছে। এখন আবার কে ফোন দিলো। মিল্টনের ফোন। ভয়ে ভয়ে ফোন ধরলাম। তার ফোন মানেই সমস্যার শুরু। আমি শিওর এখন বলবে___ ‘দোস্ত, মনটা খুব খারাপ। অপরাজিতাকে মনে পড়ছে।’
‘ হ্যাঁ মিল্টন বল কি খবর।’ সে বাজখাই গলায় বলে উঠল, ‘ সখা তুই কই। সখা দারুণ একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। তোর সাহায্য দরকার। তুই তাড়াতাড়ি কবির মামার টং এ আয়। তাড়াতাড়ি। এইবার সখা আমি অপরাজিতাকে বলেই দিব।’ আমার দিন গেলরে। আজ আর রক্ষে নেই। পাগলাটা ঘ্যানঘ্যান করে আজ মাথা শেষ করবে। নিজের প্রেমের নাই ঠিক। উনি আসছেন উনার প্রেমের সমাধান নিতে। এমন অকর্মা জীবনেও দেখি নি। ৩ বছর একসাথে কাটিয়ে ফেলল। আজ পর্যন্ত মনের কথাটা জানাতেই পারল না! কবিরের টং এ পাগলটা বসে আছে। এমনিতে টাইম টেবিলের কোন ঠিক থাকে না। আজ ঠিকই এসে বসে আছে। আমাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসে পাগলটা। সাথে সাথে সব বিরক্তি কেন জানি হাওয়ায় উড়ে গেল। খুব ইচ্ছা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করব, ‘আচ্ছা মিল্টন, তুই এত্ত সুন্দর করে হাসিস কেমনে?’ __সখা নতুন আইডিয়া। না বলে শান্তি পাচ্ছি না। তোর মন ভালো তো? বলব? __ আরে বাবা ভণিতা না করে বল। প্রেমের দুনিয়ায় আমার দুয়ার চিরদিন জাগ্রত। পাগলটা কি সুন্দর হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে। ___ শোন সখা, অনেক কষ্টে অপরাজিতাকে ম্যানেজ করেছি। আজ বিকালে আমরা দুজন সেন্ট্রাল মাঠে বসে থাকব। তুই তখন একটা পিচ্চিকে মাঠে পাঠাবি। পিচ্চি আমাদের সামনে ঘুড়ি উড়াবে। সাদা ঘুড়িতে নীল কালিতে লেখা থাকবে, তোমার জন্য সন্ন্যাসী ভাবনা/ আলেয়া রাতের কড়াকড়ি, তোমার জন্য হৃদি জুড়ে নিতি/ বর্ষা বাদল ছড়াছড়ি। লেখার নিচে ঘুড়ি বানানর খরচাপাতি লিখে দিস। আমি কথায় বাঁধা দিয়ে বললাম, ‘ তুই যে কবিতার ছন্দে ছন্দে বলবি,তোর পাগলিটা কি কবিতা বুঝে?’ ___তাও তো কথা। ওর তো আবার কবিতা,গল্পে অ্যালার্জি আছে। মিল্টন চুপসে যায়। আমি অভয় দিয়ে বলি, ‘ওসব ভাবিস না। তুই খালি অপরাজিতাকে আনার ব্যবস্থা কর। আর যাবার সময় ঘুড়ির সব কিছু কিনে দিয়ে যা।’ ‘ ২০০ টাকা ধার দে। জিনিসপত্র কিনতে হবে।’ ‘মানে কি!! প্রেম করবি তুই আর টাকা দিব আমি? কক্ষনো না। এ পর্যন্ত কত টাকা ধার নিয়েছিস মনে আছে?’ ‘ওসব তুই-ই হিসেব রাখ। শালা তোর জন্মই হয়েছে আমাকে টাকা ধার দেবার জন্য’ পাগলটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। আমি কিছু আর বলতে পারিনা। তার আনন্দের বুকে ভাটা জাগাতে মন চায় না। শুধু প্রার্থনা করি__আজ যেন সে অপরাজিতার জীবন জুড়ে অপরাজিত হয়ে ফুটে থাকার অনুমতি পায়।
পিচ্চি যোগাড় করেছি। ৫০টাকায় এক ঘন্টা। সেই রকম ডিমান্ড। পাগলটার কথামত নীল কালিতে ঘুড়ির গায়ে লিখলাম ---
সুতা= ৩০ টাকা
পলিথিন= ১০ টাকা
নাটাই= ২৫ টাকা
পিচ্চি= ৫০ টাকা
মোট= ১০৫ টাকা
আমার ভালোবাসার দেনমোহর। গ্রহণ করো অপরাজিতা।
অপরাজিতাকে নিয়ে মিল্টন মাঠে বসে আছে। মিল্টন ছাই রঙ এর একটা পাঞ্জাবী পরেছে। অপরাজিতার পরনে নীল রঙের সাদা পাঁড়ের শাড়ি। কি সুন্দর-ই না লাগছে দুটোকে। পিচ্চিকে মাঠে পাঠিয়ে আমি বাসায় ফিরি। সব যেন ঠিকঠাক মত হয় খোদা। রাতে মিল্টনের ফোন। একরাশ আগ্রহ নিয়ে ফোন ধরি। ‘ কিরে পাগল? প্রেম জমল কেমন?’ মিল্টন খেঁকিয়ে ওঠে, ‘আরে ব্যাটা কি পিচ্চি আনলি। সেতো নাটাই ঘুড়ি সব নিয়ে পালিয়েছে। হল নারে সখা। এইবারও হল না’
ওপাশটা নিরব হয়ে যায় কিছুক্ষণ। ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পাচ্ছি। কান্না আমার একদম ভালো লাগে না। ফোনটা কেটে দেই। বাইরে শুক্লা রাত। জানালা খুলি। জোছনা এসে উপচে পরে ঘরের ভেতর। দুএকটা নীল জোনাকিও আসলো। এরকম প্রেমের মুহূর্তে রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালো জমে। হেডফোন লাগিয়ে ফুল ভলিউমে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে দিলাম। জোছনার সাথে তাল মিলিয়ে কানে বাজে রবির গান____ “ এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না কেবল সুখ চলে যায়...” সকালে ঘুম ভেঙ্গে জেগে দেখি বালিশটা নোনা জলে ভিজে আছে। পাগলটাকে একটা ফোন দেয়া দরকার। কোথায় আছে, কি করছে কে জানে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন