বিয়ের পর যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি ভোগায় সেটি হচ্ছে ঘুম। ঠিক মতো ঘুম হয় না। বিয়ের আগে
অতেত ভালবাসা
ভাবতাম বিবাহিতরা কত সুখে আছে। বউকে জড়িয়ে ধরে কত আরামে ঘুমায়। কিন্তু বিয়ের পর এই ভুল ধারণা ভেঙে গেল আমার। বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর আনন্দ যেমন আছে, বিপদও আছে। অনেক মেয়ে ঘুমের মধ্যে হাত-পা নড়া-চড়া করে খুব বেশি। আমার স্ত্রী শম্পা অনেকটা সেই রকমই বলা যায়। ঘুমানোর সময় তার হাতগুলো বক্সার কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীর মতোই এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে। কখন যে কোন হাত কোন দিকে চলে যায় বলা যায় না। বিয়ের এক সপ্তাহ পার না হতেই সে আমাকে ঘুষি মেরে গাল লাল করে দিল। ঘুমের মধ্যে ঘুষি খেয়ে আমি লাফ দিয়ে উঠে গেলাম। ভাবলাম শম্পা মনে হয় কোনো কারণে রেগে গিয়ে ঘুষি-টুষি মারছে। কিন্তু না, সে মোটামুটি বেহুশ হয়েই ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই তার একটা হাত আমার গালে লাগিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। কারণ নাক বরাবর মারলে রক্তও বের হয়ে যেতে পারত। দুই-তিন দিন পর হালকা-পাতলা একটা লাথিও খেলাম পেটের মধ্যে। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমানোর সময় বউ থেকে দূরে থাকব। সবচেয়ে ভালো হতো আলাদা খাটে ঘুমালে। সেই ছোটবেলা থেকে খাটে একাই ঘুমিয়েছি। কত আরামের ঘুম ছিল সেগুলো! কারো কোনো গুতাগুতি ছিল না। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীকে একই খাটে ঘুমাতে হবে কেন আমি বুঝে পাইনা। কোনো লিখিত ডকুমেন্টও নেই এর পক্ষে। বিয়ের কাবিননামায় এই রকম কোনো শর্ত ছিল বলে মনে পড়ে না। বিয়ের পর কী কী করতে হবে অথবা কী কী করা যাবে তার একটা নিয়মাবলী কাবিননামায় থাকা উচিত ছিল। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যও কাবিননামায় থাকা দরকার। যাই হোক, যেটা বলছিলাম। বউয়ের লাথি খেয়ে ঘুম ভাঙার পর ঠিক করলাম আলাদা খাটে না হোক অন্তত বউ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমাতে হবে। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমানোর সময় একজন থাকবে খাটের এক কোনায় আর অন্যজন আরেক কোনায়। মাঝখানে থাকবে কোলবালিশ। কেউ কারো ঘুমের ডিস্টার্ব করব না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। নতুন সিদ্ধান্তে ব্যাপক কাজ হলো। খুব শান্তিতে ঘুমালাম আমি। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল পরের দিনই। খাটের কিনার ঘেঁষে ঘুমানোর কারণে খাট থেকে পড়ে গেলাম ঘুমের মধ্যেই। একেই মনে হয় বাংলায় ধপাস করে পড়ে যাওয়া বলে। ছোটবেলা থেকেই ঘুমানোর সময় খাটে গড়াগড়ি করা আমার অভ্যাস। তার কুফল পেলাম এবার। ঘুমন্ত অবস্থায় উপর থেকে নিচে পড়লে শরীরের হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। আমার হাড্ডি ভাঙল না, তবে প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম। বিরাট শব্দ হলো রুমের ভেতর। শব্দটা এতো জোরেই হলো যে শম্পার গভীর ঘুম ভেঙে গেল এবং ছুটে এলো আমার কাছে। আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। কারণ বাসর রাতের পরের দিনেও খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। বিয়ের পরপর এত ঘনঘন খাট থেকে পড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই খুব লজ্জাজনক ব্যাপার। তাই স্বীকার করলাম না পড়ে যাওয়ার কথা। বললাম, ‘টয়লেটে যাচ্ছিলাম, অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়েছি। তেমন একটা ব্যথা পাইনি।’ শম্পা আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকল। সম্ভবত ভাবছিল, শুকনো জায়গায় আমি কিভাবে পিছলা খেয়ে পড়ে গেলাম! ব্যথা পাইনি বললেও সপ্তাহ খানেক কোমড় নিয়ে নড়াচড়া করতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। চিত হয়ে শুতে পারতাম না, উপুত হয়ে শোয়া লাগত ব্যথার কারণে।

সব মেয়েই শোয়ার পর ঘণ্টাখানেক স্বামীর সঙ্গে বকবক করে। শম্পাও এর ব্যতিক্রম না। ফলে ঘুম ধরলেও ঘুমাতে পারি না। অফিস থেকে যেহেতু রাত ১১টার পর বাসায় ফিরি। তাই শোয়ার পরই শুরু হয়ে যায় তার নানান প্যাচাল। সারা দিন বাসায় কী হলো, বান্ধবীদের কী হলো তার বিরাট কাহিনী শুনতে হয় একটার পর একটা। তবে এক ধরনের কথাই খুব বেশি শুনি তার মুখ থেকে। মিতার হাজবেন্ড মিতাকে নতুন একটা থ্রি পিস কিনে দিয়েছে। ৬ হাজার টাকা দাম। জয়ার হাজবেন্ড জয়াকে হিরার আংটি কিনে দিল। জয়া অনেক বকা দিয়েছে কেন হিরার আংটি কিনল। তার হাজবেন্ড নাকি শুধুশুধু টাকা খরচ করে। অবাক কাণ্ড হলো, পরের দিনেই নাকি আবার নিয়ে এসেছে জামদানি শাড়ি। অনেক দামি! শাড়ি দেখে জয়া তো রেগে ফায়ার। জামদানি শাড়ি সে পড়ে না, তারপরও এনেছে। জয়া বলেছে এই শাড়ি সে ছুঁয়েও দেখবে না। কত বড় বোকা মেয়ে দেখেছ? আসলে তার হাজবেন্ডের মনটা খুব ভালো। জয়াকে খুব ভালোবাসে বলেই এটাসেটা গিফট দেয়। এতে রাগ করার কী হলো তুমিই বলো। আসলে সুখে থাকতে ভুতে কিলায় বলে একটা কথা আছে না। জয়ার হয়েছে সেই রোগ। একটু থেমে শম্পা আবার বলে, গানিয়ার ফেসওয়াশটা আমার একদম সুট করছে না। গতমাসে জনসন ফেসওয়াশ বাদ দিলাম মুখ তেলতেলা হয়ে যায় সেই কারণে, এখন দেখি গানিয়ারও বাদ দিতে হবে। এই ফেসওয়াশ দিলে মুখে ব্রণ ওঠে। তুমি কিন্তু আগামী মাসের বেতন পেয়েই একটা নিম ফেসওয়াশ কিনে আনবা। নিম ফেসওয়াশ দিলে ব্রণ ওঠে না। একটা ডাব সাবানও নিয়ে আসবা, ডাব সাবান ইউজ করলে শরীরের স্কিন খুব মোলায়েম থাকে।

আমি শুয়ে শুয়ে শম্পার সব কথাই শুনতে থাকি এবং কোনো কথা না বলে মাঝে মাঝে ‘হু’ ‘হু’ করি। তার বকবকানির মধ্যেই ঘুমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু ঘুম আসেনা। শম্পার সব সময় গরম বেশি লাগে। তাই ফুল স্পিডে ফ্যান চালায়। আমি আবার ফ্যানের বাতাস সহ্য করতে পারি না, শীত লাগে। তাই মাঝে মাঝে ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দেই। কিন্তু পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই শম্পা আবার বাড়িয়ে দেয়। এক রাতেই ফ্যানের স্পিড কয়েকবার বাড়ানো-কমানো হয়। এক পর্যায়ে ফ্যান নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। শম্পা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ‘খবরদার। ফ্যানের স্পিড কমাবে না। ঘেমে ছেড়াভেড়া হয়ে যাচ্ছি আর তুমি ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিচ্ছ। কী গরম পড়েছে। আব্বা-আম্মা দুইটা ফ্যান ছেড়েছে আর তোমার এক ফ্যানের বাতাসেই শীত লাগে। আজব মানুষ!’ আমি বলি, ‘আমাদের এই ফ্যানের বাতাস খুব বেশি। এই দেখ, শীতে কাঁপতেছি আমি। এত জোরে ফ্যান ছাড়ে নাকি মানুষ। সবকিছু তো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’

আমি আর ঝগড়া বাড়াই না, তাই ফ্যানের স্পিডও কমাই না। মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করা মানে চরম বোকামি। একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকি আর চেষ্টা করতে থাকি ঘুমানোর। ফ্যানের তীব্র বাতাস, বউয়ের ঘুষি আর খাট থেকে পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক নিয়েই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
 
Top